বাংলায় রাজনৈতিক বিকল্প কিভাবে আসতে পারে এ ব্যাপারে একমাত্র বিজেপি মনে করছে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। গত লোকসভা নির্বাচনে বাংলা সহ দেশজুড়ে অপ্রত্যাশিত ফল করে ফের কেন্দ্রাসীন হওয়ার পর খোয়াব দেখছে বাংলায় তার ক্ষমতায় আসা শুধু যেন সময়ের অপেক্ষা। এখানে তার আসন সংখ্যা ও ভোট শতাংশ বেড়েছে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো। ফলে দাবি করতে পারে এখানে বিকল্প হয়ে ওঠার ব্যাপারে তেমন কোনো বিতর্কের সম্মুখীন হওয়ার গুরুতর অবস্থা নেই। ব্যাপক ভোট পেয়েছে ‘আগে রাম পরে বাম’ মার্কা, ভোট পেয়েছে কম হলেও তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস দুটোই ভেঙ্গে। রাজ্যের বৈদ্যুতিন মিডিয়ায় বিতর্কসভার নামে ইদানিং অতি নিম্নস্তরের যে খোঁচানো আলোচনার সন্ধ্যা-রাতের আসর বসে সেখানে বেশি বেশি জায়গা করে দেওয়া হয় বিজেপির লোকেদেরই। মুদ্রিত দৈনিকগুলোতে গৈরিক রাজনীতির আগ্রাসন নিয়ে থাকছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, কিছু কিছু দৈনিক প্রায় সমর্পিত হচ্ছে। হিন্দুমহাসভার মহানেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর আজকের কাপালিক উত্তরসূরীরা খবরের কাগজে খবর হচ্ছেন।
বিজেপির বাকি ভারতের নির্বাচনী ফলাফলের পেছনকার কারণ এখনও অবিশ্বাস্য থাকলেও বাংলায় তাদের ‘অকাল পৌষ’ আসার পেছনে বোঝা যায় শাসক তৃণমূল বিরোধী অসন্তোষ একটা কারণ, একমাত্র বা মূল কারণ না হলেও, একটা কারণ। সামগ্রিক বিচারে, তৃণমূলের ২০১৪-র তুলনায় ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট শতাংশ প্রায় একইরকম থাকলেও আসনের ফলাফলে বিজেপির কাছে খোয়াতে হয়েছে অভূতপূর্ব ক্ষয়ক্ষতি, পাশাপাশি বাম দলগুলোর এখানে মেলেনি একটিও আসন, পরন্তু ভোট ভিত্তিতে নেমেছে ব্যাপক ধ্বস এবং কংগ্রেস এরাজ্য থেকে বামেদের একাংশের সমর্থনপুষ্ট হয়ে দুটি আসন পেলেও ভোট শতাংশের প্রশ্নে বনে গেছে প্রায় বামন। তাই বিজেপি ভাবছে এগোতে পারবে অস্বাভাবিক অপ্রতিরোধ্য গতিতে, অভিযানের সুর-স্বর তুলছে চরমে। যথেচ্ছ ছড়াচ্ছে নানা গুজব, মিথ্যাচার, অর্ধসত্যের প্রচার; চালাচ্ছে এলাকা ও প্রতিষ্ঠান দখলের সন্ত্রাস, আন্দোলনের নামে অরাজকতা। বিজেপির আশু নিশানায় পয়লা নম্বরে শাসক তৃণমূল, তবে একইসাথে অন্য বিরোধী দলগুলির সামাজিক ভিত্তিও তুলনায় নীরবে গ্রাস করে নিতে আগ্রাসী। আর বলাবাহুল্য, চূড়ান্ত টার্গেটে রয়েছে কমিউনিস্টরা। এহেন ‘বিকল্প’রূপী বিজেপি বিপদ তাই বেড়েই চলেছে।
বিজেপি নিজেকে যে ‘বিকল্পের’ প্রতিনিধি বলে দাবি করছে তার মধ্যে রয়েছে কেবল ক্ষমতার জন্য মরীয়া হওয়ার প্রবণতা। কোনো প্রকৃত বিকল্পের অন্তর্বস্তু তাতে নেই। প্রকৃত বিকল্পের প্রশ্নাতীত বনিয়াদ হওয়া উচিত — একের মধ্যে তিন — গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্বের সমন্বয়। গেরুয়া রাজনৈতিক শক্তিটির ধারণায় ও প্রয়াসে ঐ তিন অন্তর্বস্তুর প্রকৃত অর্থে একটিরও অস্তিত্ব নেই, রয়েছে লোকের চোখে ধূলো দেওয়ার যাবতীয় ভূয়ো বিষয় ।
এখন মাথা ঘামানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণবিষয় হল, প্রথমত দরকার বিজেপি বিপদকে যথাযথভাবে হিসেবের মধ্যে রাখা। তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উৎস-সূ্ত্র নির্ণয় নিয়ে বিতর্ক ও মূল্যায়নের নামে বিপদের গুরুত্বকে লঘু করে দেখলে চলবে না। বিজেপির দর্শন ও মতাদর্শ হল হিন্দুরাষ্ট্রবাদী রাজনৈতিক-সামাজিক একনায়কত্বের ফ্যাসিবাদ যা আবার কর্পোরেট পুঁজির দালালী করে, আর রূপান্তর ঘটিয়ে চলার যে প্রক্রিয়ায় যে পরিণতিতে পৌঁছাচ্ছে সবই আদ্যন্ত সন্দেহাতীতভাবেই ফ্যাসিবাদ। দ্বিতীয়ত, এনিয়ে ভ্রান্তি-বিভ্রান্তিতে থাকলে চলবে না। এমনকি একে মোকাবিলার প্রশ্নে অযথা বাঘের ভয় পেলেও চলবে না। শ্রেণী, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে রাস্তায় থেকে অতিক্রমের রাস্তা বের করতে হবে। অবশ্যই সর্বোপরি প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক দিশা ও অবস্থান।
বাংলায় এখন প্রথাগত বামপন্থার প্রতিনিধিত্বকারী সিপিএমের নীতি-কৌশলের ভাবনার অনুগামী হয়ে বিজেপি ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা সম্ভব নয়। ঐ ‘বাম’ ভাবনার কারবারীরা নিজেদের কৃত গুরুতর বিচ্যুতি ও অধঃপতনগুলো স্বীকার করতে রাজি নন। বৃহত্তর জোটবদ্ধ হওয়ার নামে কংগ্রেস নির্ভরসর্বস্ব হয়ে চলারই পক্ষপাতী। আর, গত লোকসভা নির্বাচনে সুবিধাবাদী স্বার্থবুদ্ধি দলের সর্বস্তরে এমন মাথা খেয়ে বসল যে, তৃণমূলী স্বৈরাচারকে টাইট দেওয়ার নামে ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে মতদানের আত্মবিনাশী কৌশল প্রশ্রয় পেয়ে গেল। নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে তাই তৃণমূলও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি, বিজেপিকে ২৩ শতাংশ ভোট তুলে দিয়েছে, তৃণমূলকে অবশিষ্ট ৭ শতাংশ দিয়ে দিক! এই করুণ পরিস্থিতি বদলাতে হলে, ফ্যাসিবাদকে সত্যিকারের মোকাবিলা করতে হলে ভাবের ঘরে চুরি করে হবে না। কেন্দ্র-রাজ্যের ফ্যাসিবাদী শক্তির স্বরূপ উন্মোচনে, মোকাবিলায় সাচ্চা বৃহত্তর গণউদ্যোগ, গণসচেতনতা, গণপ্রচার, গণসমাবেশ, গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার রাস্তায় চলতে হবে। এই বাংলা অতীতে লড়াইয়ের অনেক দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, বামপন্থী আন্দোলনে, বিপ্লবী আন্দোলনে। তার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে, মূল্য দিয়েছে। এখন আবার এক মহারণের সন্ধিক্ষণ। আবার হতে হবে মুখোমুখি।