গোটা দেশ মুখোমুখি হচ্ছে দুই ধারায়। একদিকে যারা কেন্দ্রের শাসনক্ষমতায় ফিরে এসেছে, তারা মনে করছে চিরকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার — যা খুশী করে চলার একচেটিয়া লাইসেন্স তারা পেয়ে গেছে, তার জন্য পুরোদস্তুর ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমে তারা বদ্ধপরিকর, যা আসলে জীবন-জীবিকা থেকে শুরু করে মতপ্রকাশের অধিকারের জায়গা থেকে কোনও সঙ্গত বিরোধিতা ও ন্যায়বিচারের দাবি সহ্য না করার নামান্তর, সর্বজনীন সমৃদ্ধি-উন্নয়ন-গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-বহুত্বের আবশ্যিকতার ভারতকে বিধ্বস্ত করে কর্পোরেট বৃদ্ধি-লুন্ঠণ-রাষ্ট্রতন্ত্র-দলতন্ত্র-সাম্প্রদায়িকতা-হিন্দুত্বের ভারত তৈরির পথে বেপরোয়া। এই লক্ষ্যে অনেক কিছুই তারা করে চলেছে। সেই উদ্দেশ্যে এক বিশেষ সংযোজন হল, ইউএপিএ এবং এনআইএ কালা কানুন দুটির আরও কালা সংশোধন সারা হল। আর সেটা তারা করলেন সংসদে তাদের গরিষ্ঠতার গায়ের জোরে। দেশজোড়া গণতন্তত্রপ্রিয় শক্তি ও সংসদীয় বিরোধী দলসমূহের সমস্ত আপত্তিকে গ্রাহ্য না করে। এর ফলে সংশোধিত ইউএপিএ-তে যে কাউকে ‘সন্ত্রাসবাদী’-’দেশদ্রোহী’ সন্দেহে যখন তখন গ্রেপ্তার করা যাবে, আর ‘নিয়া’-র জোরে কেন্দ্রের পুলিশ দেশের যে কোনো প্রান্তে গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ বা বন্দী করতে পারবে। এসবের জন্য কোনো রাজ্য সরকারের অনুমোদনেরও দরকার হবে না, কাউকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না। এককথায় কেন্দ্রের হাতে সর্বোচ্চ মাত্রায় বিপজ্জনক কালা কানুন প্রয়োগের একচেটিয়া ক্ষমতা করে নেওয়া হল। অজুহাত দেখানো হচ্ছে ‘ ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ ও ‘শহুরে নকশালবাদে’র। আসলে এই তকমা দিয়ে যে কোনো বিরোধিতাকে দমন করাই উদ্দেশ্য। মোদী-অমিত শা’দের জমানা প্রথম পর্বেযেখানে শেষ করেছে কালা শাসনের অধ্যায়, সেখান থেকেই শুরু করেছে দমনের দ্বিতীয় পর্ব।
তবু এটাই সব নয়। হচ্ছে বিপরীত দিকেরও বিকাশ। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক অন্তর্নিহিত নিয়ম হল তা অবিরাম শাসক ও শাসিতের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে দিয়ে চলে। এর বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় স্থান-কাল-পরিস্থিতির দ্বারা। তাই আজ কেন্দ্রের ফ্যসিবাদী জমানা যেমন তার রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রবহির্ভূত সংঘশক্তির জোরে জনতার ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে, তেমনি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধও উঠছে। ঠিক এই সময়ে লক্ষ্যণীয়, বাংলা থেকে শুরু করে দেশজুড়ে বুদ্ধিজীবীরা আরও একবার সোচ্চার হচ্ছেন। এহেন বিরুদ্ধতায় সরব হওয়ার প্রকাশ গত লোকসভা নির্বাচনের আগেও ঘটেছিল। শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী-সমাজবিজ্ঞানীরা খোলাখুলি মুখর হয়েছিলেন প্রবল বিরোধিতায়। মোদী আমলের জনবিরোধী কর্পোরেটমুখী অর্থনীতি ও বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি-সমাজনীতি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে। লোকসভা নির্বাচনের পরেও একইভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটছে ক্ষোভের, বিরোধিতার। শিক্ষাক্ষেত্রের ও অন্যান্য পেশাগত ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনেরা বিভিন্ন প্রশ্নে পত্রাঘাত করেছেন নির্বাচন কমিশনকে, বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে এবং বিজেপির চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতার প্রতি কমিশনের নীরবতা নিয়ে অভিযোগ করে। আজ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন তার প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তারপরে প্রায় একই অভিযোগগুচ্ছের “খোলা চিঠি” দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি, সামরিক-অসামরিক অফিসারবর্গের শতাধিকজন। মোদী সরকার তারও কোন প্রত্যুত্তর দেয়নি। আর সদ্য আরও নজীর স্থাপন করলেন বাংলার তথা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন প্রান্তের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা। অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সংগঠিতভাবে। তারা প্রশ্নে বিদ্ধ করছেন কেন্দ্রের শাসককে। বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে ভিড় ঘটিয়ে মুসলিম, দলিত ও খ্রীস্টানদের নিষ্ঠুর হত্যালীলা চলতে দেওয়া হচ্ছে কেন? এই খুনোখুনি বন্ধ করতে আইনগত যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? তার বদলে দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে প্রশ্ন তোলা, সরকার ও রাষ্ট্রের নীতি-আচরণের সমালোচনা ও বিরোধিতা, শাসকদলের উৎপীড়ন চালানোর বিরুদ্ধতা, কালা কানুনের বিরোধিতা, নাগরিক তথ্য পঞ্জিকরণের নামে লক্ষ লক্ষ লোকের নামে ‘অনুপ্রবেশকারী’ তকমা লাগিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা — এহেন সমস্ত বিরোধিতার কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে কেন্দ্রের সরকারপক্ষ উঠেপড়ে লেগেছে। তার জন্য ‘শহুরে নকশাল’, ‘এই বা ঐ রাজ্য শাসকের দালাল’, ‘মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের ঢাল’, এমনকি পাকিস্তানের ঘাপটি মেরে থাকা দালাল’ ইত্যাদি দাগিয়ে দিতে তারা উন্মত্ত। বুদ্ধিজীবীদের দৃঢ় প্রতিবাদ এই সমস্ত হীন রীতিনীতি-আচরণের বিরুদ্ধেই। এই সোচ্চার হওয়া অত্যন্ত সময়োচিত সুচিন্তিত সাহসোচিত। দেশের স্বার্থবিরোধী ও জনবিরোধী শাসক নীতি ও আচরণের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবিদের সরব হওয়া কোন নতুন ব্যাপার নয়, এর এক পরম্পরা রয়েছে এই রাজ্যে — এই দেশে।
সুদূর অতীতের কথার পুনরুক্তি থাক। যে রাম রাজনীতি ভাঙ্গিয়ে বিজেপির আজ এত রমরমা, তার যাত্রা শুরু করেছিল ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্বের যে ন্যূনতম বনিয়াদের প্রতীককে আক্রমণ করে, সেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিরুদ্ধতা করার সময় থেকেই বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে আসছেন। তারপরে গুজরাট গণহত্যা, সিঙ্গুরের কৃষিজমির কর্পোরেট হস্তান্তর, নন্দীগ্রাম গণহত্যা, দেশের বিভিন্ন অংশে সাম্প্রদায়িক ও তীব্র জাতিভেদপন্থী ফ্যাসিস্টদের হাতে যুক্তিবাদী লড়াকু বিশিষ্টদের হত্যাকাণ্ড, কথায় কথায় তাড়িয়ে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি, কামদুনি থেকে কাঠুয়ায় গণধর্ষণ ও হত্যার নৃশংসতা, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়ন’, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পঞ্চায়েত ও পৌর ভোট লুঠ, ভাটপাড়ায় সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন ইত্যাদি ন্যক্কারজনক আক্রমণের বিরুদ্ধে বরাবর সক্রিয় বিরোধিতায় থেকেছেন সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবীবর্গ। আর এটা প্রমাণ করেছে তাদের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে কোনও শাসকের রঙ না দেখে, কোনও টোপ না খেয়ে, কোনও ভয় না পেয়ে। এখন প্রতিবাদ বর্ষণের ধাক্কায় গেরুয়া ফ্যাসিবাদী অজানা কন্ঠে শোনানো হচ্ছে প্রাণে মেরে দেওয়ার ভয় দেখানো হুমকি। এসব কিন্তু বুঝিয়ে দিচ্ছে আসলে প্রতিবাদ শক্তিশালী হচ্ছে, আর আধিপত্যকামী আগ্রাসী আক্রমণকারী ফ্যাসিস্টরা প্রতিবাদী আত্মঘোষণায় চমকে উঠছে। সংগঠিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ভীষণ কার্যকরী, তাই আজ এটাই সবচেয়ে জরুরী।