চাই প্রতিরোধের বামপন্থা

বিরোধী শক্তিগুলোর সমস্ত প্রত্যাশায় জল দিয়ে মোদী সরকার পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়েছে শুধু নয়, এসেছে প্রথমবারের তুলনায় আরও বিশাল গরিষ্ঠতা নিয়ে। তবু এই পুনরাভিষেক হতে পারা নিয়ে প্রশ্নগুচ্ছ থাকছেই। যে ইস্যুগুলো গত লোকসভা নির্বাচনে মোদী জমানার পতন সুনিশ্চিত করতে জ্বলন্ত হয়ে উঠেছিল সেসব কিন্তু নিভন্ত হয়ে যায়নি। এমনকি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় পর্ব পর্যন্ত বিজেপি ছিল শঙ্কায়। তারপরই মরীয়া হয় তার পক্ষে হাওয়া ঘোরাতে। তার জন্য বেছে নেয় জনতার জাতিয়তাবাদের আবেগকে কঠোর রাষ্ট্রবাদের সপক্ষে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশল। পুলওয়ামার ক্ষতি আর বালাকোটে বদলা নেওয়াকে প্রচারের সবচেয়ে বড় ইস্যু করে। আরও কিছু হাতিয়ারও ব্যবহার করে যাবতীয় বিরোধিতাকে কোনরকম গ্রাহ্য না করে। একাজে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব পেয়েছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের। ৯০০০ কোটি টাকার মতো বিপুল ব্যয় করা হয়েছে যে নির্বাচন সাঙ্গ করতে, তার ৬০ শতাংশ খরচ করা হয়েছে যে ইভিএম কেনা বাবদ, সেই প্রযুক্তি যন্ত্র সম্পর্কে উঠেছে হাজারো সন্দেহ, প্রশ্ন; উঠেছে মেশিন হটাও দাবি। নির্বাচনী দলগুলোর প্রতি যে কর্পোরেট অর্থমূল্যের সাহায্য ‘উদারহস্ত’ হয় তার ৯২.৯৪ শতাংশই ঢুকেছে বিজেপির একাউন্টে, তার অঙ্কটা মোট ১৭৩১ কোটি টাকার মধ্যে (বিজেপির ভাগে) ৯১৫.৫৯৬ কোটিটাকা। আশ্চর্যজনকভাবেনির্বাচন কমিশনের কাছে এসব কোনোকিছুই প্রশ্নবোধক মনে হয়নি। অথচ কমিশনের কাছে জমা পড়েছিল ভুরিভরি অভিযোগ, যার প্রাথমিক মূল্যায়নে ধরা পড়েছিল ৫৪ শতাংশ অভিযোগপত্রের কোনও প্রাপ্তিস্বীকারই কমিশন করেনি। এভাবে মোদী সরকারের ক্ষমতায় আসার রাস্তা বিরোধিতার যাবতীয় কাঁটা-মুক্ত হয়েছে।

তারপরেও দেশের ১৪৫ জন বিশেষ পদাধিকারী, যারা শিক্ষাক্ষেত্রের প্রথিতযশা থেকে শুরু করে পুলিশ-প্রশাসন ও সেনা বিভাগের প্রাক্তন সর্বোচ্চ স্তরের অফিসারবর্গ, চিঠি দিয়েছেন খোদ নির্বাচন কমিশনের কাজে নানা অনিয়মের জবাব দাবি করে। নির্বাচন কমিশন তারও কোনো প্রত্যুত্তর দেয়নি। ঐ পত্রাঘাতের মধ্যে রয়েছে নির্বাচন দিনক্ষণ ঘোষণা, সাত দফা নির্বাচনের পর্বভাগ, তালিকায় বহু ভোটারের নাম বাদ, পুলওয়ামাকাণ্ডকে উগ্রজাতিয়তাবাদী উন্মাদনা তৈরির ইস্যু করতে দেওয়া, নমো টিভি চ্যানেলকে বেআইনি ছাড়, ইলেক্টোরাল বন্ডের ব্যবহার, ইভিএম ইত্যাদি বিষয়াদি। এই প্রশ্নগুলো নিয়েও আজও মোকাবিলা করার আছে। মোদী জমানার প্রথম পর্বকার জ্বলম্ত সমস্যাগুলো যেমন ছিল তেমনই অবহেলিত রয়েছে। পরন্তু দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হয়ে যে শতদিনের এ্যাকশন পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, তার ছত্রে ছত্রে ধরা পড়ছে নামতে চলেছে জনগণের জীবন-জীবিকার ওপর উত্তরোত্তর হামলা। তাই এই সমস্ত আক্রমণের বিরুদ্ধে লাগতে হবে নতুন করে। জনগণের স্বার্থে জনগণের উপর নির্ভর করে জনশক্তি নিয়েই। এই লক্ষ্যে সর্বোপরি চাই বামপন্থী শক্তিগুলোর দৃষ্টান্ত স্থাপন। চাই সংগ্রামী ঐক্য-সংহতি গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ। আর এই কঠিন প্রয়াস নিতে গেলে সবচেয়ে জরুরী হল বাম শক্তিগুলোর মধ্যে সংক্রামিত হওয়া আত্ম বিনাশক ভাবনাগুলোর নির্মূলীকরণ। যেমন, গত লোকসভা নির্বাচনে ‘আগে রাম, পরে বাম’ ভোটদান কৌশল। ঐ হীন কৌশল সর্বনাশ ঘটিয়েছে বাম ভোটারদের শুধুমাত্র নয়, পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করেছে বাম চেতনায়, বাম ভাবমূর্তিতে।

নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বাংলার রাজনীতি নিয়ে মুখ খুলেছেন, বিজেপির ‘রাম রাজনীতি’র তুলোধোনা করেছেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে তৃণমূলকে আগে মোকাবিলার নামে বিজেপিকে প্রচ্ছন্ন হাতিয়ার করার আত্মঘাতী কৌশলেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিজেপি বলাবাহুল্য, শ্রীযুক্ত সেনকে প্রবাসে থাকা অভিজাত ও ভারতীয় সংস্কৃতি বিরোধী বলে গাল পাড়ে। কিন্তু তাঁর সমালোচনার প্রত্যুত্তরে সিপিএম কি ভাবছে? সত্যের অপলাপ সুবিধাবাদের পাঁকেই আরও ডোবায়। নীতিনিষ্ঠ বিতর্কথেকে বিমুখ থাকছে বলেই বাংলার সবচেয়ে বড় ‘বাম’ সুবিধাবদী দলটি নিমজ্জিত হচ্ছে ক্রমাগত অনীতিনিষ্ঠ বিতর্ক চালানোর চক্রাবর্তে। ত্রিপুরার বাম নেতা বাংলায় এসে বলছেন, চিন্তায় দূষণের যত দোষ সব বাম মনস্ক কর্মী-সমর্থকদের! ধিক্কার থেকে নিস্কৃতি পেতে দলের অঘোষিত পুনর্বিবেচনায় উঁকি দিচ্ছে আবার কংগ্রসের হাত ধরায় ফেরার লক্ষণ, কোনো বিধায়ক আবার বলছেন, বিজেপির মোকাবিলায় তৃণমূলেরও হাত ধরতে আপত্তি নেই, ‘জনচিত্ত’ আকর্ষণ করতে নেমে পড়ছেন জগন্নাথের রথ টানতেও। আর দলের সদর দপ্তর থেকে মাঝেমধ্যে প্রচারিত হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য ‘শুদ্ধি’র বাণী।

কমরেড চারু মজুমদার দৃঢ়তার সাথে বলতেন, সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত-রাজনৈতিক সংগ্রাম না করে এক পা-ও এগোনো যাবে না। আজও বোঝা যায় ঐ সূত্রায়নের ঐতিহাসিক মূল্য কি অপরিসীম! সুবিধাবাদ সংশোধনবাদেরই দান। আমরা কদম ফেলেছি কমরেড চারু মজুমদারের জন্মশতবর্ষে, ভারতের বুকে বিপ্লবী পার্টি সিপিআই(এমএল) গঠনের পঞ্চাশ বছরে। সামনে চ্যালেঞ্জ ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলার, বাম শক্তির সংহতি-ঐক্য-প্রতিরোধ গড়ে তোলার।

খণ্ড-26
সংখ্যা-21