বৃষ্টিহীন আষাঢ় সন্ধ্যা। হলে তিল ধারণের জায়গা নেই। সূচ পতন স্তব্ধতার মাঝে বক্তা বলে চলেছেন, মাঝে মাঝে প্রবল হর্ষধ্বনি তরঙ্গায়িত হচ্ছিল হলজুড়ে, স্বভাবরসিক বক্তার কোনো সরস মন্তব্যে।
এই রকমই ছবিটা ছিল গত ৫ জুলাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গান্ধী ভবন অডিটোরিয়ামে। বক্তা অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। বিষয় — স্বাধীনতা পরবর্তী কলকাতা: তাঁর স্মৃতিতে। তাঁর নিবিড় স্মৃতিকথনে ছাত্রজীবন ও পরবর্তীতে অধ্যাপনা শুরুর সময়কার কলকাতা, এই শহরের মনন ও বৌদ্ধিক চর্চার পীঠস্থান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ কফি হাউসসহ কলেজ স্ট্রিট চত্বর ঘিরে অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিল মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতাদেরও। (মাত্রই কিছু দিন আগে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ’র (নির্বাচনী) রোড শো-এর নামে গেরুয়া বাহিনীর তাণ্ডব, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গার মত ঘটনা এখানে ঘটে গেছে। শুধু নিবিড় পঠন পাঠন মননের বা মুক্ত চিন্তার চর্চার পরিমণ্ডলই নয়, বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির একদা আঁতুড় ঘরও এই চত্বর। সেই চত্বরে হিন্দুত্ববাদীদের মদমত্ততার স্মৃতি আমাদের উদ্বিগ্ন করে, হয়ত তাঁকেও।)
মানুষটি যখন অমর্ত্য সেন তখন রাজনৈতিক প্রেক্ষিত তো আসবেই। প্রশ্নোত্তর পর্বে এমন একটি প্রসঙ্গ উঠে এল যা নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়। ‘জয় শ্রীরাম’ এই আপাত নিরীহ শব্দবন্ধটিই যে আজ গোটা দেশের সামাজিক তথা রাজনৈতিক জীবনে কতটা অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে তা তিনিও যে মর্মেমর্মে অনুভব করেছেন তা বোঝা গেল তাঁর বক্তব্যে। তিনি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জানালেন, ‘‘প্রথম কথা হচ্ছে, যেটা ‘জয় শ্রীরাম’ বলছেন, সেটা খুব প্রাচীন বাঙালি বক্তব্য বলে তো শুনিনি। ইদানিং কালের আমদানি। লোককে প্রহার করতে হলে তাকে দিয়ে বলানো হয়। এটা নয় যে বাঙালি সভ্যতার সঙ্গে কোনো যোগ আছে। যেমন রামনবমী : এখন শুনছি কলকাতায় খুব রামনবমী হচ্ছে।আগে হয়েছে বলে শুনিনি। এগুলো হচ্ছে ইদানীং ক্ষেত্রের যুদ্ধ করবার জন্য।”
তিনি আরও বলেন — ‘‘আজ যখন শুনি বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ ভীত শঙ্কিত হয়ে রাস্তায় বেরোন এই শহরে, তখন আমার গর্বের শহরকে চিনতে পারি না। এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার।”
তাঁর মতে নতুন এই ‘জয় শ্রীরাম’ সংস্কৃতি আমদানির পিছনে বিভেদের রাজনীতি সক্রিয়। এক সময় হিন্দু মহাসভাও বাংলায় এই বিভেদ-বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা করেছিল বলে জানান।
এদিন সকালের এক অনুষ্ঠানে হিন্দুত্ববাদের আস্ফালন প্রসঙ্গে বলেন — ‘‘যখন শুনি কাউকে রিকশা থেকে নামিয়ে কিছু একটা বুলি আওড়াতে বলা হচ্ছে এবং তিনি তা বলেননি বলে মাথায় লাঠি মারা হচ্ছে, তখন শঙ্কা হয়। বিভিন্ন জাত বিভিন্ন ধর্মবিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য আমরা রাখতে দিতে চাই না। ইদানিং এটা বেড়েছে।
সর্বজনমান্য মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাঙালি ব্যক্তিত্বের মধ্যে অগ্রগণ্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ দার্শনিক চিন্তাবিদ ড: অমর্ত্য সেন। সমাজের অভিভাবকত্ব করার যোগ্যতা রাখেন। আর সেই দায় ও দায়িত্ব নিয়ে বহুবারই সরব হয়েছেন মোদীরাজের বিরুদ্ধে। বিমুদ্রাকরণ থেকে শুরু করে সংবিধান তথা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানের উপর আক্রমণ—সব ব্যাপারেই তিনি মুখ খুলেছেন। সাম্প্রদায়িকতা জাতি বিদ্বেষ অর্থনৈতিক বৈষম্যের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন তাঁকে উদ্বিগ্ন করেছে। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে শিক্ষা স্বাস্থ্য পুষ্টির উপর শাসকশ্রেণি গুরুত্ব না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যেমন ক্ষুব্ধ হয়েছেন মুক্ত চিন্তার উপর আক্রমণে, জেএনইউ-এর ছত্রের হেনস্থায়,সমাজে বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতার শিকার দলিত সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের ঘটনায়। তাঁর মতে ভারতের সমাজ সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক জীবনে বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতাদর্শের কোনো বিকল্প নেই। তবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বামপন্থার লড়াইয়ে বামেদের (সিপিএম-এর) ক্ষয়িষ্ণুতায় তিনি চিন্তান্বিত।
যে কোনো মূল্যে ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনি বাম অ-বাম অসাম্প্রদায়িক সমস্ত বিরোধী দলগুলিকে এককাট্টা হওয়ার জন্য আহ্বান রেখেছিলেন।
নিজেকে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে ‘বামপন্থী’ বলেই মনে করেন। এ ব্যাপারে তাঁর দ্ব্যর্থহীন বলিষ্ঠ ঘোষণা — ‘‘বামপন্থা ছাড়ব না। আবার কে বামপন্থী শুধু সেটা দেখব না। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে হাত মেলাবো নানা মতের লোকেদের সঙ্গে।”
অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যেমন আরএসএস-বিজেপি তথা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যেই তাঁর ক্ষোভ ও অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন, বিজেপি’র শীর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নেতৃত্বও তাঁকে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ ভাষায় অশালীন আক্রমণ করেছেন। এমন কি মেঘালয়ের রাজ্যপাল তথাগত রায় তাঁকে অর্থনীতির গণ্ডির বাইরে না বেরোনোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
বিজেপি নেতৃত্বের প্রতি আমাদেরও হুঁশিয়ারি — বাংলার মণীষাকে বৈদগ্ধ্যকে বিবেককে অবমাননা করে বাঙালির হৃদয় জয় করা যায় না। ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’ — জেনে নাও দুর্বৃত্ত!