‘উন্নয়নের স্বর্গ’ থেকে মানবাধিকারের মৃত্যু উপত্যকা

বিপুল জয় হাসিল করার পর নরেন্দ্র মোদী- অমিত শাহরা জয়ধ্বনির প্রথম সভাটি করলেন তাদের উত্থানের আদিভূমিতে, গুজরাটে। প্রসঙ্গত মোদী উত্থাপন করলেন নির্বাচন পর্ব চলাকালীন এক টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেওয়া বাংলার এক বয়স্কা ‘বহেনজী’র কথা, যিনি জোরগলায় দাবি করেন সপরিবারে বামপন্থী (সিপিএম) হলেও মোহিত হয়েছেন মোদীতে, মোদীর গুজরাটের ‘বিকাশ’ দেখে। গুজরাটে নাকি ‘উন্নয়নের স্বর্গ’ রচনা হয়েছে! একথার মধ্যে এবার বাংলায় বাম ভোট রামমুখী হওয়ার এক রকমফের নিহিতার্থযে কাজ করেছে সেটা বেশ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। আর এতে হাওয়া দিয়ে চলবে বিজেপি। তাই বাংলার বহেনজীর কথা ভাইরাল করেছেন মোদী। অমিত শাহও গুজরাট সভা থেকে ‘ভারতমাতা কি জয়’ শ্লোগানের এমন বজ্রনাদ তুলতে বলেন যা কিনা বাংলায় গিয়ে আছড়ে পড়ে। কারণ, কেন্দ্রের ক্ষমতা দখলে এলেও বাংলার ক্ষমতা এখনও আসেনি, এখনও না এলেও আসার গন্ধ পাচ্ছে । তবে ‘উন্নয়নে গুজরাটে স্বর্গ’ রচনার দাবির প্রকৃত কোনো সারবত্তা নেই। তথাকথিত উন্নয়নের গুজরাট মডেল বারবার প্রশ্ন আর বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছে। জনমুখী-কর্মসংস্থান নিবিড় হওয়ার বিপরীতে কর্পোরেটমুখী, মূলত ব্যাপক হাতের কাজ খেয়ে নেওয়া ও প্রাকৃতিক ধনসম্পদ লুণ্ঠন অভিযান চালাতে দিয়ে। নীতিগত শয়তানি ঘটেছে সেখানেই। কৃষকের জমি গ্রাস করে করা হয়েছে কর্পোরেট হস্তান্তর। ওরাজ্যে যত দাপাদাপি সব আম্বানি- আদানিদের। ‘বিকাশের’ কর্পোরেটমুখী নীতি তীব্র জনরোষে পরিণত হওয়ার প্রকাশটি প্রতিফলিত হয়েছিল বিগত বিধানসভা নির্বাচনে। বিজেপি একটা ঝাঁকি খেয়েছিল। বিশেষ করে নতুন ধারার নেতৃত্বে দলিত জাগরণ ও ধূমায়িত মুসলিম বিস্ফোরণের সমন্বয়ে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে হয়ত উত্তরোত্তর ধাক্কা সেখানে খেল না। কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না যে বিধানসভা নির্বাচন আর লোকসভা নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে ‘বিকাশের স্বর্গ’ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। বরং লোকসভা নির্বাচনে গুজরাট উন্নয়নের প্রসঙ্গ বিজেপি বিশেষ প্রচারে আনার সাহস পায়নি। আসল চেহারাটা ক্রমাগত উৎপাদন, পরিষেবা ও কাজ উধাও হয়ে যাওয়ার সংকটদীর্ণ ও যথেষ্ট প্রতারণার শিকার। বিমুদ্রাকরণের প্রতিফলে স্বর্ণশিল্প ও হীরা শিল্পের কাজের বাজার প্রচুর মার খেয়েছে। তাছাড়া, গুজরাট কলঙ্কিত হয়ে রয়েছে একুশ শতকের গোড়ায় মোদী মুখ্যমন্ত্রীত্বের গোড়াপত্তনেই কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর দুই সহস্রাধিক সংখ্যালঘু নিধনের জেরে। কসুররা ‘বেকসুর’ খালাস পেয়ে গেছে। বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছে, চূড়ান্ত পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছে। বিলকিস বানোরা কেউ কেউ ব্যতিক্রম বিচারের মুখ দেখেছেন, তাও প্রতি পদে পদে বাধার হুমকির সম্মুখীন হয়ে, অপ্রতিরোধ্য অবিচল থেকে। তবু বদ্ধ সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমন্ডল পেছু ছাড়েনি। গুজরাট তাই এক আপাত চাকচিক্যের আবরণে অনেক চাপা কান্নার রাজ্য হয়েই রয়েছে।

তাই ‘গুজরাট স্বর্গ’ নিয়ে অবান্তর আলোচনায় ফেঁসে না গিয়ে পক্ষান্তরে নজর ফেরানো যাক দেশের একেবারে উত্তর-সীমান্তের রাজ্যটির দিকে। কাশ্মীরে। এককালে যাকে বলা হোত ভারতের “ভূস্বর্গ”। সেই একদা অপার সৌন্দর্যের রাজ্যটিতিন দশকাধিক সময়ে পরিণত হয়েছে মৃত্যু উপত্যকায়। কাশ্মীরকে অনুশাসনে রাখার ভারতের শাসকশ্রেণীর যাবতীয় সামরিক-রাজনৈতিক নীতি ব্যুমেরাং হয়ে চলেছে। আর, মোদী জমানায় সবদিক থেকে ক্ষয়ক্ষতির পরিণাম অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। কাশ্মীরকে মোদী সরকার যত প্রচারের বিষয় বানিয়েছে সবটাই কাশ্মীরি অস্মিতাকে অপমান করে। পাক মদতে কাশ্মীরি জঙ্গী সন্ত্রাসবাদ যত নষ্টের গোড়া দাবি করে। বিজেপির লোকসভা নির্বাচনী ইস্তাহারে নতুন করে সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিলোপ অন্তর্ভুক্ত করার মধ্যে কাশ্মীরি জনতার স্বাধিকার কেড়ে নেওয়ার হুমকি খুব স্পষ্ট। কাশ্মীরকে বাকি ভারতের বিষনজরে প্রতিপন্ন করার হিন্দুত্ববাদী অপচেষ্টার অন্ত নেই। অন্যদিকে সারা দেশ ও দুনিয়া জানে কাশ্মীর সমস্যা অত্যন্ত স্পর্শকাতর সমস্যা এবং গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক সংবেদনশীল সমাধানের দাবি রাখে। কিন্তু কাশ্মীরিদের বারেবারে দেশপ্রেমের প্রমাণ দেওয়ার অহেতুক চাপ সৃষ্টি করতে চালানো হয় অকথ্য অত্যাচার। রাষ্ট্রীয় সেনা সন্ত্রাসই যত সর্বনাশের মূল কারণ। সেনা অত্যাচার কাশ্মীরি জনতার মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে যেমন প্রতিবাদী পাথর ছোড়ার, তেমনি তার জবাবে নৃশংসতার পরিচয় দিতে চালায় পেলেট বুলেট বৃষ্টি সহ আরও বহু ধরণের অত্যাচার। যা রাষ্ট্রসংঘ গৃহীত এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন স্বীকৃত সনদের পরিপন্থী। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ঙ্কর প্রকাশ।

লোকসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার কদিন বাদে সংবাদ জগতে প্রকাশ হতে দেখা গেল কাশ্মীরের বুকে সেনা- আধা সেনার অত্যাচারের এক বিভীষিকাময় রিপোর্ট। এটি তৈরি করেছে দুটি মানবাধিকার সংগঠন মিলে। রিপোর্টটি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল লোকসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার অনেক আগে। কিন্তু মোদী ভজনের কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া ঐ রিপোর্টেনির্বাচন প্রক্রিয়া পর্বের মধ্যে প্রকাশ হতে দেয়নি। কারণটি পরে পরিষ্কার হয়ে গেল। কারণ মোদী তখন দেশজোড়া বিপক্ষ হাওয়ায় কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে ও পাল্টা প্রচারের হাওয়া তুলতে মরীয়া হচ্ছিলেন। প্রথমত পুলওয়ামা কান্ড সেই সুযোগ এনে দেয়, সেনা সহানুভূতি কুড়োনোর। তারপরে মোদীও একটা হাওয়া তোলার সুযোগ করে নেন পাক সীমান্তে ঢুকে বালাকোটে বদলা নেওয়ার বীরত্ব প্রদর্শনের কথা প্রচার করে। মিডিয়ায় তখন এ নিয়ে লেগে যায় প্রচারের ধূম। তাই তখন কাশ্মীরে সেনা অত্যাচারের গোপন কেন্দ্র চলার খবর কর্পোরেট মিডিয়া প্রকাশ করেনি। নির্বাচন চুকে যাওয়ার পর তা প্রকাশের মুখ দেখেছে। মিডিয়াকে আবার মোদী-সেবা করে বিভিন্ন রকমের পাঠকের বাজারও তৈরি করতে হয় সেই অর্থে মোদী — পার্টিকে নির্বাচনী বিপদে না ফেলে রিপোর্টটি বেরিয়েছে পরে। রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে কাশ্মীরে অত্যাচার চালানোর ২০৬টি গোপন শিবিরের তথ্য। ৫৬০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট। রিপোর্টের শিরোনাম — ‘‘টর্চারঃ ইন্ডিয়ান স্টেটস্ ইন্সট্রুমেন্ট অফ কন্ট্রোল ইন ইন্ডিয়ান এ্যাডমিনিস্টার্ড জম্মু এ্যান্ড কাশ্মীর।” ভারত শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ রাখতে নিগ্রহ। রিপোর্ট তৈরি করিয়েরা সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করতে কথা বলেছেন মানুষজনের সাথে। বিশেষত ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের মা-বাবাদের যে সমন্বয় সমিতি রয়েছে তাদের থেকে তথ্য জেনেছেন। এই অত্যাচারের শিকার হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ৮০ শতাংশই নিরীহ। এরকম নারী-পুরুষ সংক্রান্ত ৪৩২টি কেস অধ্যয়ন করে জানা গেছে অত্যাচারে অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু ঘটেছে। যত কেস জানা গেছে তার মধ্যে ২১ জন নাবালিকা সহ ২৪ নারী, যাদের অন্তত ১২ জনকে গণধর্ষণ করেছে সেনার দল।

গোপন শিবিরগুলোতে অত্যাচারের ধরণগুলো বিভৎস। যেমন হাত-পা বেঁধে জলে চুবিয়ে রাখা, আঁটোসাটো পোশাক পরিয়ে ভেতরে ইঁদুর ঢুকিয়ে দেওয়া, নগ্ন করে রাখা, চিত্ করে বা উপুর করে শুইয়ে দিয়ে পায়ের ওপর ভারী কাঠের গুঁড়ি চাপিয়ে ডলে দেওয়া, বিদ্যুতের শক, গরম লোহার রডের ছ্যাঁকা, ধর্ষণ সহ সমস্ত রকমের নৃশংস যৌন অত্যাচার করা, খেতে-ঘুমোতে না দেওয়া ইত্যাদি। এর ফলে হতাহত হওয়া ছাড়াও গুরুতর শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে চলেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এরকম সেনা-আধা সেনার গোপন শিবির রয়েছে ১৪৪টি, এছাড়া রয়েছে ১০টি থানা, পুলিশের আরও ১০টি বিশেষ ডেরা, ৯টি সন্ত্রাস-মোকাবিলার ছাউনি সহ ২টি আরও কুখ্যাত কেন্দ্র। এই টর্চার ক্যাম্পগুলি অনেকটা কিউবার গুয়ান্তানামো বা ইরাকে আবু ঘ্রাইবে মার্কিন বন্দী শিবিরের ধাঁচে তৈরি। যেখানে বর্বরতার কোন সীমা থাকে না।

রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে মানবাধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রসংঘের হাই কমিশনারের অফিসের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক স্তরের এক অনুসন্ধান চালানো প্রয়োজন। একইসাথে ভারত সরকারের কাছেও দাবি জানানো হয়েছে অত্যাচারের বিরোধিতা বিষয়ক রাষ্ট্রসংঘের গৃহীত কনভেনশনকে মান্যতা দেওয়া উচিত। ঘটনা হল, রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার বিভাগের এক প্রাক্তন অধিকর্তা ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক দীর্ঘরিপোর্টলিখেছিলেন। তার আগে রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে মোদী সরকারের কাছে বিশেষ তিনটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন পাঠানো হয়। তাতে ১৯৯০ থেকে ২০১৮-র মার্চ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরে নৃশংস অত্যাচার করা ও হত্যা করার ৭৬টি তথ্য উল্লেখ ছিল। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হওয়া নাগরিকরা ও তাদের পরিবারের লোকেরা যাতে ন্যায়বিচার পায়, অত্যাচারী অপরাধীরা যাতে শাস্তি পায়, উপরোক্ত প্রতিবেদনে উপসংহারে সেই দাবি ছিল। রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ২০১৮-র জুন মাসে তার প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্যগুলো সম্পর্কে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রমাণ দাখিল করতে বলেছিল। কিন্তু মোদী সরকার প্রত্যুত্তর দেওয়া তো দূরের কথা, রিপোর্টই মানতে চায়নি, খারিজ করে দিয়েছিল।

মোদী জমানা মানবাধিকারকে সামগ্রিক দিক থেকে দমন করে এসেছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে দমনের প্রচুর অভিযোগের পাহাড় তৈরি হয়েছে, কেন্দ্রে মোদী জমানার বিশেষ মদতে। আর জম্মু ও কাশ্মীরকে অত্যাচারের নরক বানানোর জন্য সরাসরি দায়ী মোদী সরকার। এই অপরাধ আড়াল করতে না পারলেও অস্বীকার করে এসেছে। কাশ্মীরকে মানবাধিকারের মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করে রাখতে চাইছে।

নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয় পুনরাভিষেকের প্রাক অভিভাষণে উল্লেখ করেছেন, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-এর পথে তিনি এবার ‘সবকা (বিশ্বাস)’ বিশ্ওয়াস পেতে চান। হয়ত সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু জনতার কাছ থেকে অবিশ্বাসী প্রতিক্রিয়া দূর করতে চেয়েই মোদীর এই বাহানা। কিন্তু সারা ভারতের হিসাবে যারা সংখ্যালঘু, তারা আবার কাশ্মীরে সংখ্যাগুরু। মানবাধিকারের কোন সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু হয়না, এটা নাগরিকের সাংবিধানিক ভিত্তিতে প্রশ্নাতীত মোলিক অধিকার। তাই এই অধিকার যারা কেড়ে নেয়, দমন করে, তার কৈফিয়ৎ দিতে অস্বীকার করে, ন্যায়বিচারের দাবি মানতে চায়না, মানবাধিকার নিকেশের অপরাধের শাস্তি দিতে রাজী নয়, তারা নির্বাচনে বিপুল জনাদেশ পেলেও মানবাধিকারের বিচারে মান্যতা পেতে পারেনা।

খণ্ড-26
সংখ্যা-14