সুশীল সমাজ, বিশিষ্ট নাগরিক সমাজ, শিল্পী-সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়—যে সম্বোধনেই অভিহিত করা হোক, অবশেষে তাঁরা উদ্যোগী হতে শুরু করেছেন; পথে নামা থেকে শুরু করে নাগরিক সভা সংগঠিত করছেন। ওঁরা চিন্তিত লোকসভা নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে ভাটপাড়ায় চলমান বিদ্বেষ-বিভাজনের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও সংঘর্ষফেটে পড়া নিয়ে, ঘরে বসে থাকতে পারেননি সদ্য সরকারি হাসপাতলে জুনিয়র ডাক্তারদের ক্ষোভে ফেটে পড়তে দেখে, খেদ প্রকাশ করেছেন গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সংঘটিত তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বা কিছুদিন আগে লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর ‘রোড শো’ করা লোকেদের হাতে বিদ্যাসাগরের মূর্তিভাঙ্গার বিরুদ্ধে কিছু করে উঠতে না পারা নিয়ে।
লাগাতার আরও অনেক অসহ্য ঘটনাবলীর প্রতিক্রিয়ায় সহ্যের বাঁধ ভাঙ্গতে শুরু করেছে। তাই যেভাবেই হোক ওঁরা আবার যূথবদ্ধ ক্ষোভে-অসন্তোষে-প্রতিবাদে সোচ্চার হতে শুরু করেছেন। একুশ শতকের পশ্চিমবাংলায় এহেন নবজাগরণের প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল বামফ্রন্ট আমলে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের প্রতিক্রিয়ায়। তারপর তৃণমূল শাসনাধীনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কখনও কামদুনি ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের প্রতিক্রিয়ায়, কখনও ছাত্রসমাজের “হোক কলরব” আন্দোলনের সংহতিতে-সমর্থনে, কখনও পেশী ফুলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার অভিপ্রায়ে সাম্প্রদায়িক চরিত্রবিশিষ্ট রাজনৈতিক দল ও তার শাখা সংগঠনগুলোর হামলার প্রতিরোধে ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের পাশে দাঁড়াতে। বাংলার সংগ্রামী সুশীল সমাজ বারেবারে সোচ্চার হয়েছেন। এটাও ঘটনা যে, এরকম উদ্যোগ ও উদ্যম দেখানোর সামনের সারির মুখগুলো সবাই বরাবর একইরকম থাকেননি। অনেকে নাম লিখিয়েছেন ‘পরিবর্তন’-স্বরূপ নয়া শাসক হিসেবে কোনো রাজনৈতিক দলকে রাজ্যের রাজক্ষমতায় দেখতে চান সেই তালিকায়। অনেকে নির্বাচনী টিকিটি পাওয়া, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া, সরকারি বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পদ পাওয়া, নিদেনপক্ষে নানা পুরস্কৃত হওয়ার বিনিময়ে কণ্ঠও বদলে ফেলেছেন, প্রতিষ্ঠান বিরোধী অবস্থান বদল করে রাজ্যের শাসকদলের পক্ষভুক্ত হয়ে পড়েছেন। এই হাওয়ায় হাওয়ায় কেউ কেউ আনুগত্য বদল করার নমুনা দেখিয়েছেন এমনকি বাম ঘরের বন্ধন ছেড়ে তৃণমূলে চলে যাওয়ার। কেউ কেউ আবার প্রথমে তৃণমূলে ঢুকে তেমন সুবিধা না পেয়ে আবার তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির ঘরে গিয়ে উঠেছেন। তবু অনেকেই রয়ে গেছেন যারা আপসের রাস্তায় রাজ্যের বা কেন্দ্রের শাসকদলের ছত্রছায়ায় চলে যাননি, নিজেদের হাত-মুখ বন্ধক দিয়ে দেননি। বাংলার প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রতিবাদী সুশীল সমাজের পরম্পরা আজকের অশান্ত-অসহিষ্ণু-অরাজক পরিস্থিতিতে আবার আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করছে। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষে সমাজ ও রাজনীতিকে বিষিয়ে দেওয়ার উন্মত্ততা। কিছুতেই সহ্য করা যায় না ধর্ম ও ভাষাগত মেরুকরণের ন্যক্কারজনক রাজনীতি। উপরোক্ত উদ্যোগমঞ্চ থেকে তাই আবারও ক্ষোভের উদগিরণ হচ্ছে—“এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না ...”; এই ধরনের উদ্যোগ তাই স্বাগত। বাংলার প্রকৃত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতির জন্য সংগ্রামশীল জনশক্তির কাছে এইসমস্ত উদ্যোগ হয়ে উঠুক আশা-ভরসার।
আজ যখন কেন্দ্রে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর গোটা দেশজুড়ে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্বের মাপকাঠিগুলোকে আর কোনোভাবেই ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যের জায়গায় রাখা হচ্ছে না, সড়ক থেকে সংসদ কক্ষে পর্যন্ত ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি-সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে, যখন নয়া কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারতের পাকিস্তানকে হারিয়ে দেওয়াকে বালাকোটে বদলা নেওয়ার সমতুল বলে সদর্পে মন্তব্য করেন, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে একটিই উদ্দেশ্য, তা হল, সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের বিষবাস্পে শ্বাসরুদ্ধ করে দেওয়ার পরিমন্ডল তৈরি করা। কদিন আগে বিজেপির প্রতি পদে পদে আস্তিন গুটিয়ে হুমকি প্রদর্শন করে চলা বঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কোনো এক প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী অমর্ত্য সেন সম্পর্কে দলের ভাষায় ব্যঙ্গোক্তি করলেন, ‘কে অমর্ত্য সেন, ওকে তো কেনা যায়’! প্রত্যুত্তরে শান্তিপ্রিয় কেউ কেউ ক্ষান্ত থাকলেন এই মন্তব্য করে যে এই ধরণের মুর্খামীকে আমল দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু এ নিছক মুর্খামীকে এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয়। অমর্ত্য সেনের প্রতি সংঘ পরিবারপন্থীদের রাগ প্রবল। কারণ তিনি বরাবর একরোখার মতো বলে এসেছেন মোদীকে কোনোমতেই ক্ষমতায় দেখতে চান না, মোদী মানে একটা মুখ, বলাবাহুল্য ফ্যাসিস্ট বিজেপির মুখ। সেইসঙ্গে তিনি আরও বলেছিলেন, আমরা বড় বেশি সহিষ্ণু হয়ে পড়ছি সাম্প্রদায়িক শক্তির এতো অসহিষ্ণুতা দেখেও, এখন সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলা করতে হলে আমাদের একটু অসহিষ্ণু হওয়া দরকার। যথার্থই বলেছেন তিনি। আজ এই রাজ্য এই দেশের পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের এক সংবেদনশীল অংশ প্রতিষ্ঠান বিরোধী অবস্থান থেকে ইস্যুভিত্তিক প্রতিবাদ সংগঠিত করার কথা বলছেন। ঠিকই আছে, উদ্যোগ স্বাগত। তবে মাথায় রাখা দরকার, ফ্যাসিবাদীরা নামাচ্ছে আস্ত একটি প্রকল্প — কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক।