সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বিপন্ন ৪ লক্ষ কর্মচারীদের ভবিষ্যত

এক মারাত্মক আদেশে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো বিহারের প্রায় ৪ লক্ষ কন্ট্রাকচ্যুয়াল সরকারী শিক্ষকের ভবিষ্যত। ৩১ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে পাটনা হাইকোর্ট এক রায় দিয়ে রাজ্য সরকারকে আদেশ দেয় প্রায় ৪ লক্ষ কন্ট্রাকচ্যুয়াল শিক্ষক কে স্থায়ী করে নিয়মিত শিক্ষকদের সমহারে বেতন দিতে হবে। এরপর, সুপ্রিম কোর্টে এ এম সাপ্রে এবং ইউ ইউ ললিতের বেঞ্চ হাই কোর্টের ওই রায় কে খারিজ করে জানায় যে ওই কর্মীরা কেবলমাত্র সমকাজে সমবেতন পেতে পারেন। তাদের স্থায়ী কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্বেকার রায় অবৈধ।

বিহার সরকারের তরফ থেকে নির্দিষ্ট বেতনের ভিত্তিতে, ২০০৬ সালে “নিয়োজিত শিক্ষক”-এর শব্দবন্ধনী দিয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষকদের নিয়োগ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়, কন্ট্রাকচ্যুয়াল পদ্ধতিতে। স্থায়ী পদে এই সমস্ত শিক্ষকেরা কম বেতনে বছরের পর বছর ধরে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে আসছিলেন। তারাই স্থায়ীকরণের দাবির পাশাপাশি সমহারে বেতনের দাবি জানায়। রাজ্য সরকারের এই আচরণকে পাটনা হাইকোর্ট বৈষম্যমূলক এবং “নিয়োজিত” শিক্ষকদের প্রতি অবিচার হচ্ছে বলে মন্তব্য করে। সুপ্রিম কোর্ট এই সমস্ত কিছুকে খারিজ করে জানায় যে তাদের প্রতি কোনো বৈষম্য বা অন্যায় আচরণ রাজ্য সরকার করেনি। বরং, বিগত এক দশক ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে বিহার সরকার যে বিরাট বিরাট পদক্ষেপ নিয়েছে, যে কর্মচাঞ্চল্যের উপর ভর করে প্রায় সমস্ত জনপদে গড়ে উঠেছে এক একটা বিদ্যালয়, বেড়েছে সাক্ষরতার হার তার ভূয়সী প্রশংসা করেছে শীর্ষ আদালত। দূর্ভাগ্যের বিষয়, এই শিক্ষাপ্রসারের পেছনে কন্ট্রাকচ্যুয়াল শিক্ষককেরা নীরবে নেপথ্যে থেকে নিরলসভাবে যে ভূমিকা রেখে চলেছেন, তার স্বীকৃতি কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট দিল না। দিল না শিক্ষাঙ্গনে আরও বেশি বেশি করে ছাত্রীদের সামিল করানোর পেছনে তাদের সাফল্য। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, “এর ফলে গোটা সমাজ উপকৃত হচ্ছে, তাই এই কাজটা রাজ্য সরকার যাতে ভালভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তার জন্য বরং তাকে অনেক ছাড় দিতে হবে।’’

তবে, নিয়োগের প্রথম দু’ বছরে তাদের স্বল্প পরিমাণ বেতন নিয়ে শীর্ষ আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। প্রথম দুবছরে এমনকি ওই স্কুলের পিয়ন বা কেরানীদের থেকেও কন্ট্রাকচ্যুয়াল শিক্ষকদের কম বেতন যে যথাযথ নয় তা আদালত মন্তব্য করেছে। শীর্ষ আদালত রাজ্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে তাদের জন্য এক “ভদ্রস্থ বেতনক্রম’’ প্রবর্তন করা। তবে, এটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এ ব্যাপারে আদালত একেবারেই নাক গলাবে না। আর, বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের জন্য যে বেতনক্রমের সুপারিশ করেছে, তা বিবেচনার জন্য আদালত উল্লেখ করেছে।

সুপ্রিম কোর্ট একটা মারাত্মক মন্তব্য করেছে। সে বলেছে, “নিয়মিত সরকারী শিক্ষক এবং ‘নিয়োজিত’ শিক্ষক—এই দুটি বর্গ আগামীদিনে রাজ্য সরকার টিকিয়ে রাখবে কিনা তা এখন একটা খোলা প্রশ্ন। কারণ, স্থায়ী শিক্ষকেরা ক্রমে ক্রমেই এক বিপন্ন, অবলুপ্ত বর্গে পরিণত হচ্ছে। “অর্থাৎ, কন্ট্রাকচ্যুয়াল কর্মীদের স্থায়ীকরণের যে অধিকার শ্রমিক কর্মচারী আন্দোলন এতদিন ছিনিয়ে নিয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে বরং তাদেরই নিয়োগের বৈধতা দিল, আর একই সঙ্গে, স্থায়ী শিক্ষক পদগুলোকে বিলুপ্ত করার সবুজ সংকেত আগাম দিয়ে বসল রাজ্য সরকারকে। শুধুমাত্র, স্থায়ী কাজে স্থায়ী কর্মীদের সমহারে বেতন পাওয়াটা সুনিশ্চিত হলো, স্থায়ীকরণের নীতিগত দাবীটাকে পুরোপুরি বাতিল করে।’’

সারা দুনিয়া জুড়েই কর্পোরেট ঘরানা এটাই চাইছে। স্থায়ীকরণের মাধ্যমে কাজের যে নিশ্চয়তা থাকে, তা হরণ করার দাবিই দীর্ঘদিন ধরে তারা চালিয়ে আসছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেই আকাঙ্খা পূরণ করল মাত্র।

খণ্ড-26