পারস্পরিক বহু যোজন দূরত্ব, আত্মকলহ ও মতের অজস্র বিভিন্নতা সত্ত্বেও, ‘মোদি হটাও’-এই শ্লোগানটিই এবারের লোকসভা নির্বাচনের সমগ্র পর্বজুড়ে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মূল রণধ্বনি হয়ে উঠেছিল। আম জনতার মধ্যেও, যেখানে যে দল বিজেপিকে হারানোর ক্ষেত্রে বেশি মজবুত ও কার্যকরী সেখানে তার পক্ষ সমর্থনের জোরদার ইঙ্গিত ফুটে উঠছিল। এ হেন পরিস্থিতিতে বিজেপি নিশ্চিতভাবেই প্রবল চাপের মধ্যে পড়েছিল। বিহার ও ঝাড়খন্ডে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরিস্থিতিতে ‘কে জিতবে, কে হারবে’— বিষয়টি যখন অনিশ্চিত তখন গো বলয়ের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে (বিশেষত উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থানে) বড় রকমের ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা বিজেপির কাছে অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বিপদ আঁচ করে মোদি-অমিত শাহ্ উত্তর ভারতে তাদের সম্ভাব্য ঘাটতিকে অন্য অঞ্চল থেকে পূরণ করার উদ্দেশ্যে উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গকে ‘নরম জায়গা’ বলে বাছাই করে নেন। বিরাট ভাবে না হলেও, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আসন সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা সকলেই আন্দাজ করছিলেন। কিন্তুু সার্বিকভাবে বা সারা দেশের ক্ষেত্রে একক ক্ষমতায় বিজেপি সরকার গড়তে পারছে না – এটাই সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়। ছোট-বড় সব সংবাদ মাধ্যমই এ প্রশ্নে প্রায় সহমত ছিল। হঠাৎই শেষ দফা ভোট গ্রহণের ২৪ ঘন্টা আগে মোদি অমিত শাহ্ জয়ের গন্ধ পেয়ে যান এবং গভীর তৃপ্তিতে মন্দিরে দেব দর্শন করতে মেতে ওঠেন। আর কী আশ্চর্য! শেষ দফা ভোট মিটতে না মিটতেই বৃহৎ সংবাদ মাধ্যমগুলি তাদের পুরানো যাবতীয় হিসেব নিকেশ খারিজ করে দিয়ে এক বাক্যে সমস্বরে তথাকথিত জনমত সমীক্ষায় বিজেপিকে ‘একাই তিনশ’ বলে তুলে ধরতে থাকে। ভোটের বাস্তব ফলাফলও জনমত সমীক্ষার সঙ্গে অবিকল মিলে গেছে।গো-বলয়ে তাদের দুই ডেঞ্জার জোনে (উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থান) তো বটেই, এমন কি বিহারেও বিজেপির জয় জয়কার দেখা যায়। বিরোধীরা ধরাশায়ী। বিরোধী শিবির এভাবে কেন পর্যুদস্ত হল সে সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, সমাজ বিজ্ঞানী, বিদ্বজ্জনেরা নিশ্চিতভাবেই গবেষণা করবেন এবং গবেষণাপত্র হয়তো বহু বছর আমাদের চিন্তার খোরাক জোগাবে।
বলা বাহুল্য, দেশজুড়ে বিরোধীদের এমন বিপর্যয় ঘটল কেন তা বিশ্লেষণ করার মতো মগজ আমার নেই এবং সে কাজের দায়ভারও মুখ্যত আমার ওপর বর্তায় না। কিন্তু ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলার জন্য বামপন্থীদের ভরকেন্দ্রে রেখে সমস্ত সংগ্রামী, গণতান্ত্রিক ও বিজেপি বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার যে মহৎ প্রকল্প, এই বিপর্যয়ের সময়েও, তার সঠিকতা ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গৈরিকীকরণের যে ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী বিপদ তাকে শুধুমাত্র ভোটের ময়দানে প্রতিহত করা যায় না। কিন্তু ভোটের লড়াইতেও ফ্যাসিবাদের সামনে জবরদস্ত চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষেত্রে বামপন্থীরা প্রত্যাশিত সফলতা পাবে না কেন? যে কোনো সচেতন বামপন্থী কর্মীর মতো এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায় আমারও আছে।
এ দেশে ৬৭ বছরের সংসদীয় আনুশীলনের ইতিহাসে বামপন্থীদের এত খারাপ ফল এবারের মতো আর কখনো হয়নি। কী আসন সংখ্যার নিরিখে, কী প্রাপ্ত ভোট সংখ্যার বিচারে বামপন্থীদের এমন দৈন্যদশা (বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে) প্রতিটি বামপন্থী কর্মীর কাছেই অত্যন্ত উদ্বেগের। এই উদ্বেগ থেকেই, অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন : আবার ঘুরে দাঁড়াতে হলে তার রোড ম্যাপ বা রূপরেখা কেমন হবে?
পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ভোটের সিংহভাগই চলে গেছে বিজেপির অনুকূলে। অন্তত আমি যে কেন্দ্রের ভোটার (হুগলী লোকসভা কেন্দ্র) সেই কেন্দ্রের প্রেক্ষিতে এ কথা সর্বাংশে সত্য। এখানে ২০১৪ সালে সিপিআই(এম) প্রার্থী পেয়েছিলেন ৪ লক্ষ ২৫ হাজার ভোট। এবার তা ৩ লাখ ৪ হাজার কমে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ২১ হাজার ভোটে। ফলে আসনটি বিজেপি জিতে নিয়েছে।
সিপিআই(এম) কর্মী সমর্থকরা বলছেন, তৃণমূল যেভাবে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস চালাচ্ছিল তাতে বীতশ্রদ্ধ মানুষ টিএমসি-কে হঠাতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। “তাহলে তৃণমূলের প্রতি ঘৃণার থেকে মানুষ সিপিআই(এম)-কে ভোট দিল না কেন?’’ সিপিআই(এম) কর্মীরা উত্তরে বলছেন, আমরা ক্ষমতায় নেই। টিএমসির হামলার মুখে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি। বিজেপি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আছে। তারা ইডি, সিবিআই-কে দিয়ে যেভাবে লাগাতার টিএমসিকে চাপে রেখেছে এবং নির্বাচনের সময় ইলেকশন কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে যেভাবে টিএমসি-কে ঘিরে ফেলেছিল তা থেকে মানুষের বিশ্বাস হয়েছে, বিজেপিই টিএমসিকে জব্দ করতে পারবে। তাই ক্ষুব্ধ মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। আসলে জনগণের নামে সিপিএম কর্মীরা নিজেদের মনের কথাকে এভাবেই ব্যক্ত করছেন।
সিপিএমের এই সমস্ত বন্ধুরা ভাবছেন, বিজেপি জুজুর সামনে টিএমসি অচিরেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। তখন বিজেপি ফাঁকা ময়দানে ‘যা ইচ্ছে তাই’ করতে গেলে জনগণ মেনে নেবে না। তখন জনগণ বাঁচার জন্য আবার সিপিএম-কেই বরণ করে নেবে।
এ ধরনের কল্পনা বিলাসের যে বাস্তবের মাটিতে কোন মূল্যই নেই তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সিপিএমের বন্ধুরা হয়ত জানেন না যে বিজেপি কোনো ভুঁইফোড়দের পার্টি নয়। ভুঁইফোড়দের তারা দলে নেয় ঠিকই কিন্তু তাদের পেছনে আছে আরএসএস – যারা অত্যন্ত রেজিমেন্টেড (সুসম্বদ্ধ)। তাদের পরিকল্পনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ‘ভাঙাচোরা’ সিপিএম বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে কীভাবে প্রবল হয়ে উঠবে? একটা উদাহরণই যথেষ্ট। বিজেপি বলছে, তারা টাটাকে ফিরিয়ে আনবে। টাটাকে সিঙ্গুরে ফেরত আনা সিপিএমেরও স্বপ্ন। এ প্রশ্নে, সিপিএমের হারিয়ে যাওয়া গণভিত্তির কাছে কে বেশি বিশ্বাসযোগ্য? সিপিএম না বিজেপি? উত্তর দেওয়া নিষ্প্রয়োজন।
সিপিএমের বন্ধুরা অবশ্য তাঁদের ঘুরে দাঁড়াবার পক্ষে আর একটি যুক্তিকে আশ্রয় করে থাকেন। যাঁরা মনে করেন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারলে তাদের সাফল্য আসবে। যে কংগ্রেস এত জীর্ণ ও অতীতের ছায়া মাত্র তার ওপর এমন আস্থা! আসলে দীর্ঘদিন রাজ্যে ক্ষমতার গদিতে থেকে আর এখন গণসংগ্রামের ময়দানে নামার ইচ্ছা ও সামর্থ্য দুটোই তাঁদের নিঃশেষিত। তাই ভোট কাটাকাটির অঙ্কে যদি শিকে ছেঁড়ে-ঝাপসা চোখের বাইরে কিছুই তাঁদের চোখে পড়েনা। এরাজ্যে বিজেপির সর্বময় কর্তৃত্ব কায়েম হলে আক্রান্ত জনগণ শেষ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। কিন্তুু সেই প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মেরুদন্ড শক্ত এমন কোনো বামপন্থী শক্তিকেই এগিয়ে আসতে হবে। কোথায় সেই যোগ্য বামপন্থী শক্তি? এ রাজ্যে প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলা, দিকভ্রান্ত, নিদারুণভাবে হতাশ সিপিআই(এম) নেতৃত্বের পক্ষে সংগ্রামী জনগণকে ভরসা জোগানো যে অসম্ভব তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাহলে বামপন্থীদের মধ্যে কার্যত আর বাকি থাকে কেবল আমাদের পার্টি সিপিআই(এমএল) লিবারেশন। কিন্তু আমাদের সামর্থ্য ও শক্তি কতটুকু? প্রাপ্ত ভোটের বিচারে আমরা এতই নগণ্য যে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে না। আমাদের অতি ‘আশাবাদী’ কোন নেতা হয়ত বলবেন, ‘আর যাই হোক, আমাদের প্রাপ্ত ভোটের খুব বেশি তো ক্ষয় হয়নি। ছোটখাটো কিছু পাওয়ার আশা না করেও কয়েক হাজার মানুষ বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে আমাদের ভোট দিয়েছেন। আবেগসর্বস্ব এ কথার পিছনে যুক্তির কোনো বালাই নেই। যারা আমাদের ভোট দেন তাঁদের অনেকেই ভাল মন্দ কিছু যাচাই করে ভোট দেন নিশ্চয় কিন্তু বিপ্লব ইত্যাদির কথা ভাবেন না বড় একটা। আর একজন পরিচিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিও নির্দল হিসেবে অনায়াসে কয়েক হাজার ভোট পেতে পারেন। সুতরাং ভোট যুদ্ধে এ রাজ্যে আমাদের যে রেখচিত্র তা দিয়ে জনগণের ভরসা অর্জন দূরে থাক, কর্মীবাহিনীকেও চাঙ্গা করা বেশ দুষ্কর। যে মহান আদর্শ ও রাজনৈতিক লাইনের সঠিকতার কথা আমরা বলি তা এ রাজ্যের ব্যাপক মানুষকে স্পর্শ করেনা-এই নির্মম সত্যকে আমাদের মেনে নিতেই হবে। এ কথা ঠিক, জনগণ কোনো দলকে ভোট বাক্সে দরাজ হাতে ভোট দিলেই সেই দলটির কর্মকান্ড সঠিক বলে প্রমাণ হয় না। আর আমরা কম ভোট পেয়েছি বলেই আমাদের রাজনৈতিক লাইন ভুল-এমন সরল ব্যাখ্যাও ধোপে টেকে না। কিন্তু যা নিয়ে কোনো সংশয় নেই, তা হল, গত ২৬-২৭ বছর আগেও (করন্দা ঘটনার আগে পরে) আমাদের ডাকে হাজার হাজার মানুষ যে ভাবে গভীর আশা নিয়ে মাঠ ভরিয়ে দিতেন তা এখন দৈবাৎ চোখে পড়ে। বড় বড় জমায়েতের সবটাই ভোট বাক্সে পৌঁছায় না তবে বামপন্থী কোনো দলের জমায়েত ক্ষমতা দেখে শাসক শ্রেণীর মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি হয়। শাসকশ্রেণীর বুকে ত্রাস সৃষ্টি, জনতার মুখে হাসি ফোটানো – দীর্ঘদিন কোনটাই সেভাবে আমাদের দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। কেন? এর পিছনে কারণ কী? হদিশ পেতে গভীর আত্মানুসন্ধানের প্রয়োজন। ‘সব ঠিক হ্যায়’-বলে আবার ‘দশটা-পাঁচটার’ নিতান্ত একঘেয়ে ডিউটিতে ‘ক্ষয়রোগের’ কোনো মীমাংসা হবে না।
আসলে গত ৫০ বছরে দেশ দুনিয়ার পরিস্থিতিটা বিশালভাবে বদলে গেছে। টাটা-বিড়লার সম্পদ আগলানো আর জোতদারদের পাহারা দেওয়ার সরকারের যে কুৎসিৎ চেহারা আমরা দেখতাম তার বিপরীতে আমরা শুনতাম মাও সে তুঙের লাল চীনে শ্রমিক-কৃষকের মাথা তুলে দাঁড়ানোর গল্প। ভিয়েৎনামের মুক্তিযুদ্ধে যুবসমাজের রক্ত তোলপাড় হত। আজকের প্রজন্মের কাছে কোনো লাল চীন নেই, নেই কোনো হোচিমিন। ৬০-এর দশকে উত্তাল গণ আন্দোলন দেখেছি। খাদ্যের দাবিতে হরতাল, চাকা বনধ। খাস বেনামী জমি দখল। কংগ্রেস সরকারের পতন-বুর্জোয়াদের আত্মকলহ। যুবসমাজের সামনে দাঁড়িয়ে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখানো আইকন চারু মজুমদার, হরেকৃষ্ণ কোঙার (হ্যাঁ, হরেকৃষ্ণ কোঙার, চুলচেরা বিশ্লেষণে তাঁর রাজনৈতিক বিচ্যুতি ধরা পড়লেও ৫০-এর দশকে যুবসমাজের চোখে তিনি ছিলেন ‘হিরো’)। এল নকশালবাড়ি। অত্যাচারী জোতদার মহাজনের প্রভুত্ব ধ্বংস করে কৃষিবিপ্লব সফল হবে — মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি। বিপ্লব — তাকে যেন হাতে ছোঁয়া যায়, চোখের সামনে তার মূর্তছবি ভেসে উঠত। উত্তাল কৃষক সংগ্রাম, দুর্বার গণ আন্দোলন-এরাজ্যে এখন স্মৃতি। শাসকশ্রেণীর রণকৌশলে বিপ্লবী শক্তি কোণঠাসা। পুঁজিবাদ নিজেকে পুনর্গঠিত করে যে সংস্কার কর্মসূচি নামিয়েছে সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে গরিবও নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারবে বলে ভাবতে শুরু করে। সংস্কারের হাত ধরে গুছিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায়, সে দেখে সংঘর্ষে না গিয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললে লাভ বৈ লোকসান তো নেই। আধুনিক দুনিয়ার বহু সুযোগ-সুবিধে চেখে দেখার সুযোগ তার হয়েছে। পুঁজিবাদের ঘাতক চেহারা তার স্পষ্ট মালুম হয় না। সমাজ বা দুনিয়াকে পালটানোর বদলে সে নিজের মাপ বুঝে একটা প্ল্যানিং বা প্রকল্প নির্মাণ করে। সুখ বা উন্নতির অগণিত ধাপের মধ্যে যে কটা সিঁড়ি টপকানো যায় তার চেষ্টাই সে চালিয়ে যায়। ‘এ ভাবে হয় না’ — বললে তার সাফ উত্তর, ‘কিছুতেই কিছু হবে না, লঙ্কায় যে যায় সেই হয় রাবণ।’ যে যখন সরকারে আসবে তার কাছে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে নাও। এই সরকারের দিন ফুরলে নতুন যে আসছে তার দিকেই ঢলে পড়ো। “বিপ্লবের তত্ত্ব রূপ পাবে কীভাবে? যেন বিবর্তনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে সমাজ সংসার।’’
সাধারণ জনগণের মনের গতি প্রকৃতি বোঝাতে গিয়ে কি নিতান্ত একমাত্রিক কোনো ছবি এঁকে ফেললাম? কোনো আন্দোলন নেই, কোনো প্রতিবাদ নেই এ রাজ্যে – এতটাই কি নিস্তরঙ্গ জনজীবন? অবশ্যি আন্দোলন আছে, প্রতিবাদ আছে। কিন্তু সমাজে রাজনৈতিক শক্তির যা ভারসাম্য তাকে বুনিয়াদী জনগণের অনুকুলে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চই তা যথেষ্ট নয়। ছোট ছোট, বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা প্রতিবাদগুলোকে সংগঠিত রূপদান ও বৃহত্তর আন্দোলন সৃষ্টির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তো প্রয়োজন নেতার, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের। যুবসমাজ, সমাজের বৌদ্ধিক অংশ যদি নির্লিপ্ত থাকে তাহলে এই কাজ সম্ভব হবে কাদের হাত ধরে? যুবসমাজকে আকৃষ্ট করার, তাদের নতুন স্বপ্ন দেখানোর সেই আইকন নেই বলে যখন আক্ষেপ হয় তখন দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের কথাগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি। দীপঙ্কর বলেছেন, ‘আজ যারা প্রৌঢ় বা প্রবীণ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন নিয়ে তাঁরা ব্যথিত হন। কিন্তু আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে সেই ব্যথা অনুভব করার কোনো দায় নেই। সমাজতন্ত্র বা বিপ্লবের কোনো একটা মডেলে দেখে তারা বড় হয়নি বলে আজকের তরুণদের কোনো আক্ষেপ নেই। তাদের মনের মধ্যে কোনো ভার বা বোঝা নেই। তারা অনেক মুক্ত, খোলা মনে পরিস্থিতিকে বিচার করে। ফ্রেমে বাঁধানো কোনো একক আইডিয়ার থেকে নয়, চলমান আন্দোলনগুলির থেকে তারা প্রেরণা পায়। তাদের আছে নতুন স্বপ্ন দেখার হিম্মত।’ তাঁর কথায় আজকের প্রজন্ম নিশ্চিত ভাবেই উদ্দীপিত হয়ে থাকে। অলস বসে না থেকে তারা পথে নেমে পথকে চেনার চেষ্টা করে। কিন্তু তবু কোথাও একটা সংশয় থেকে যায়! চলতে চলতে একটা পথ হয়ত পাওয়া যাবে— কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্য দিয়েই কি ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়? কর্মীদের পথে নামতে আহ্বান জানানোর পাশাপাশি অগ্রণী পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালনও বিপ্লবী নেতার কাছে প্রত্যাশিত। আর প্রতিবিপ্লবের সাময়িক আধিপত্যকে খর্ব করে বিপ্লবের চূড়ান্ত জয়ের এক চিত্রকল্প বিপ্লবী নেতাই নির্মাণ করেন। যে চিত্রকল্প দেখে প্রথমে শত শত, তারপর হাজার হাজার এবং অবশেষে জ্যামিতিক গতিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের সামিল হওয়ার সম্ভাবনা জেগে ওঠে। দ্রুত পরিবর্তনের এই শর্তগুলি এক সময় ইচ্ছানিরপেক্ষভাবেই পেকে উঠবে ঠিকই — কিন্তু তার এক আগাম যুক্তিগ্রাহ্য কারণগুলি ‘বড় হরফে’ লিখতে পারার মধ্যেই নেতৃত্বের সার্থকতা। আশার কথা, আমাদের কর্মীবাহিনী অনেক বেশি সুশৃঙ্খল। সংকটের সময়ও তারা ভেঙ্গে পড়েন না। বিশেষত এই দুঃসময়েও যে এক সারি যুবশক্তি মুষ্ঠিবদ্ধ হাতকে কখনো শিথিল হতে দেন না — তারা তো এ রাজ্যে বাম আন্দোলনের মহার্ঘ সম্পদ। কিন্তু যথাস্থিতিকে ভেঙ্গে সগর্বে এগিয়ে যাওয়ার জন্য গতিময় নেতৃত্বের নির্মিতি যেন অধরাই থেকে যাচ্ছে।
বুর্জোয়া শিবির নরেন্দ্র মোদির মধ্যে তাদের অবিসম্বাদিত নেতাকে খুঁজে পেয়েছে। বুর্জোয়াদের এই আইডল শ্রেণীভেদকে ঘুচিয়ে দিয়ে এক সর্বজনীন নেতা রূপে পূজিত হচ্ছে। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ – এই মিথ্যা কুহকে আমজনতাও মজেছে বিলক্ষণ। আসলে কার পৌষমাস আর কার সর্বনাশ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই জনগণ বুঝতে সক্ষম হবে। কিন্তু তাদের দ্রুত মোহমুক্তির জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য ও ক্ষুরধার যুক্তি সাজানোর কাজটি এ মুহূর্তে বিপ্লবী বামপন্থীদের আশু কর্তব্য।
শ্রেণী বৈষম্যকে আড়াল করে শ্রেণীচেতনাকে নিস্তেজ করে দেওয়ার জন্য সঙ্ঘ পরিবার হিন্দুত্বের আধারে যে উগ্র জাতীয়তাবাদকে ফেরি করছে তার স্বরূপ উদ্ঘাটনের কাজটিও বর্তমান মুহূর্তে খুব জরুরি। প্রায় বিরোধীশূন্য অবস্থায় অঢেল ক্ষমতা মুঠোর মধ্যে চলে আসায় সমস্ত মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে নরেন্দ্র মোদি কর্পোরেটদের বেপরোয়া লুটপাটের জন্য সব বাধাকে নির্মমভাবে গুঁড়িয়ে দেবেন। তিনি নিজ মুখেই বলেছেন, ‘কোন স্পীড ব্রেকার থাকবে না।’ সারা দেশের সেই নিদারুণ দুঃসময়ে জনগণের সর্বস্তরে ‘মোদি ম্যাজিকের’ মোহ দ্রুত কেটে যাবে। কে জানে, গত ৩০ বছরে অগ্রগতির শিখর থেকে বাম আন্দোলনের ক্রমাগত পিছু হটাকে কিছুতেই যখন রোধ করা যায়নি তখন মোদি রাজের সর্বগ্রাসী হামলার মুখে দ্রুত ও বিস্ময়করভাবে হয়ত ছবিটা বদলে যাবে! এখানে ওখানে কান পাতলে – কানাঘুষোয় এ কথাটা শোনাও যাচ্ছে।
কিন্তু মোদি ও সঙ্ঘ পরিবারও জানে, তাদের সোনার সংসার বাঁচিয়ে রাখতে হলে আসল শত্রুদের সর্বাগ্রে বিনাশ করতে হবে। সাধারণভাবে বামপন্থীদের, বিশেষ করে তাদের মূল মেরুদন্ড বিপ্লবী বাম শক্তিকে (বিজেপি-আরএসএস-এর ভাষায় ‘নকশালপন্থা’) শেষ করে দেওয়াটা, সে জন্য তাদের প্রধান লক্ষ্য। নেতা ও কর্মীদের হত্যা, পাইকারি গ্রেপ্তারি, পত্র পত্রিকা প্রচার ও প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া — দমনের কোনো দিকটি তারা বাদ রাখবে না। সুতরাং, আমাদেরও কাজের পদ্ধতি দ্রুত বদলে ফেলতে হবে। কিন্তু গণ বিচ্ছিন্ন, বেহাল সাংগঠনিক কাঠামোকে মেরামত তথা নবীকরণ কীভাবে সম্ভব? সকলে নিশ্চয় ভাবছেন। উপায় খুঁজে বের করতেই হবে।
তবে এ মুহূর্তে পশ্চিবাংলায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে গণ উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি যে তান্ডব চালাতে চাইছে তার পরিণামে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও দাঙ্গা ভয়ঙ্কর চেহারা নিতে পারে। আমাদের সর্বস্তরের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের নিয়ে তা প্রতিরোধের কাজটিতে বিনা দ্বিধায় সর্বাগ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সুবিধাবাদ ও দোদুল্যমানতার কারণে যাদের ক্ষতি হয়েছে সব থেকে বেশি সেই সিপিআই(এম)-এর কর্মী বাহিনীকে দূরে সরিয়ে না রেখে, এই আপৎকালে সঙ্গী করে নেওয়ার কাজটিতে আমরা যেন কার্পণ্য না করি।