বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন এই বইটি দেখিয়েছে, মোদী সরকার ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে কিভাবে ভারতীয় রাষ্ট্র এবং ভারতীয় সমাজকে হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদীর রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে।
তিন সম্পাদক এই বিষয়টার উপরই গুরুত্ব দিয়েছেন যে ‘‘সংখ্যাগুরুবাদ এবং সংখ্যালঘু-বিরোধী বিদ্বষের স্বাভাবিক হয়ে ওঠার’’ পরিমণ্ডল রাতারাতি গড়ে ওঠেনি, দীর্ঘদিন ধরেই তার নির্মাণ চলেছে। মুখবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘‘ভারতবর্ষেস্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রতি প্রভূত সমর্থন জরুরি অবস্থার অধ্যায় সহ সবসময়েই দেখা গেছে এবং ভারতীয় জনতার মধ্যে গণতন্ত্র-বিরোধী বৈরিতা অন্ততপক্ষে ২০ বছর ধরে বেড়ে চলেছে।’’
উন্নয়নশীল সমাজগুলোর অধ্যয়ন কেন্দ্র (সিএসডিএস) ২০১৭ সালে ‘‘দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের অবস্থা’’ সম্পর্কেযে রিপোর্ট বার করে মুখবন্ধে তার উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ রিপোর্ট জানিয়েছে, যাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে গণতন্ত্রকে সমর্থন করা ব্যক্তিদের হার ২০০৫ সাল থেকে ২০১৭-র মধ্যে ৭০ শতাংশ থেকে কমে ৬৩ শতাংশ হয়েছে। গবেষণা কেন্দ্র পিউর প্রকাশ করা ২০১৭ সালের একটি রিপোর্টে এই প্রবণতারই সমর্থন মেলে : ৫৫ শতাংশ উত্তরদাতা সমর্থন জানান ‘‘সরকারের এমন একটা ব্যবস্থার প্রতি যাতে এক শক্তিশালী নেতা সংসদ বা আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন’’, আর ৫৩ শতাংশ সামরিক শাসনের প্রতি সমর্থন জানান। পিউ সদস্যদের রিপোর্ট আরো জানায়, ‘‘সমীক্ষা করা দেশগুলোর মধ্যে ভারতবর্ষেস্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রতি সমর্থন সবচেয়ে বেশি’’ এবং ভারত হল ‘‘চারটি দেশের মধ্যে একমাত্র দেশ যেখানে অর্ধেক বা তারও বেশি জনগণ সামরিক বাহিনীর দ্বারা শাসনকে সমর্থন করে।’’ যাদের মতামত সমীক্ষা করা হয় তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই মনে করেন, নির্বাচিত কর্তাব্যক্তিদের পরিবর্তেবিশেষজ্ঞদেরই সেই সমস্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যা দেশের পক্ষে সবচেয়ে ভালো। এটা একেবারেই বিস্ময়কর নয় যে, তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে — স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, সামরিক শাসন এবং প্রযুক্তিতন্ত্রের শাসনের সমর্থক — বিজেপির সমর্থকমণ্ডলী এবং শহরে বসবাসকারীদের প্রতিনিধিত্বই সবথেকে বেশি। শ্রমিক শ্রেণীসমূহ এবং গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে এই ব্যবস্থাগুলোর প্রতি সমর্থন এর চেয়ে অনেক কম। সিএসডিএস ২০০৮ সালে ‘‘দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের অবস্থা’’ সম্পর্কে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় ‘‘অভিজাত’’ উত্তরদাতাদের ৫১ শতাংশ রাজনীতিবিদদের বদলে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা শাসনকে ‘‘জোরালোভাবে সমর্থন করে’’ আর ২৯ শতাংশ শাসনে শুধু ‘‘সম্মত’’ হয়, আর ‘‘গণ’’ উত্তরদাতাদের ২৯ শতাংশ ‘‘জোরালো সমর্থন’’ এবং ২২ শতাংশ ‘‘সমর্থন’’ জানায়।
মোদী ২০১৪ সালে যে সমর্থন লাভ করেন, তার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ছিল কিছু কল্যাণকামী পদক্ষেপ (যথা, উচ্চ শিক্ষায় ওবিসি- দের জন্য সংরক্ষণ) এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প এমজিএনআরইজিএ-র বিরুদ্ধে উচ্চ ও মধ্য জাতগুলোর ‘‘অভিজাতবাদী প্রতিশোধ’’ নেওয়ার একটা তাগিদ। এর সাথেই মোদী এক ‘‘নয়া’’ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমর্থনও সমাবেশিত করতে পারেন — যেটা হল মূলত ওবিসি-দের নিয়ে গড়ে ওঠা একটা বর্গ, দু-দশকের নয়া-উদারবাদী বৃদ্ধি যাদের সৃষ্টি করেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের কাজে সংরক্ষণ চরম সীমায় পৌঁছে যাওয়ায় যারা শিল্প ক্ষেত্রে কাজ পাওয়ার আকাঙ্খা করছিল।
উন্নয়নের যে মডেলের প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে মোদী ২০১৪ সালে দাবি করেছিলেন, তার প্রতি এবং তার মধ্যে অন্তর্নিহিত হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং স্বৈরতান্ত্রিকতার প্রতি সমর্থন অতএব তুলনামূলকভাবে এক অভিজাত অংশের মধ্যেই বেশি শক্তিশালী ছিল।
টমাস ব্লম হ্যানসেন তাঁর প্রবন্ধে একদিকে ভারতের উদারবাদী গণতান্ত্রিক সংবিধান এবং অন্যদিকে নাগরিক অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতাগুলিকে অভিযানের রূপে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ভারতীয় রাজনীতির (যার মধ্যে কংগ্রেস এবং মূল ধারার বাম দলগুলো রয়েছে) ব্যর্থতা — এই দুয়ের মধ্যে সৃষ্ট মস্ত ফারাকটিকে ধরার চেষ্টা করেছেন। এর বিপরীতে এই দলগুলোও একদিকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কল্যাণমূলক কাজগুলোর ওপর জোর দিয়েছে, অন্যদিকে ‘‘জাতীয় ঐক্য এবং দেশের মধ্যে ‘দোশদ্রোহী’ শক্তিগুলোকে প্রতিহত করার নামে ব্যাপক আকারের নিরবচ্ছিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কর্মনীতিতে অনুমোদন দিয়েছে।’’ সংবিধানে বিধৃত অধিকার এবং স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিগুলোর সঙ্গে ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের, ব্লম হ্যানসেন যেটাকে বলছেন ‘‘আইনের শক্তি’’, চালানো নিয়মিত প্রণালীবদ্ধ পৈশাচিকতা ও হিংসার ব্যবধান অত্যন্ত প্রকট। এই পৈশাচিক এবং অসাংবিধানিক ‘‘আইনের শক্তি’’র হাতে অবশ্য দরিদ্র নিপীড়িত জাতের জনগণ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অপরদিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীগুলো এর থেকে প্রধানত অব্যাহতি পায়।
অতএব, ‘‘যারা প্রান্তিক এবং অসহায়’’, পুলিশ এবং আইনি প্রক্রিয়ার কাছে তাদের ‘‘যথেচ্ছ এবং ব্যাপক হিংসার অভিজ্ঞতা ভোগ করতে হয়।’’ আর পুলিশের এবং স্বৈরাচারী ‘‘আইনের শক্তির’’ কাছ থেকে ‘‘একমাত্র সম্ভাব্য প্রতিষেধক ও সুরক্ষা’’ হতে পারে ‘‘শক্তির আইনকে’’ জাহির করার সামর্থ্য — যা হল, সামাজিক শৃঙ্খলাকে বিপর্যস্ত করে তোলার লক্ষ্যে যথেষ্ট রাজনৈতিক এবং গোষ্ঠীগত শক্তিকে সমাবেশিত ও প্রদর্শিত করা। এরই সাথে অবশ্য মনে রাখতে হবে যে সব মানুষকেই সমান চোখে দেখা হয় না—আর তাই মুসলিমদের একটা শান্তিপূর্ণ কিন্তু বড় সমাবেশের ক্ষেত্রে পুলিশের যেমন কঠোরতা ও ভীতিপ্রদর্শন দেখা যায়, সশস্ত্র হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদী সমাবেশের ক্ষেত্রে এর সম্পূর্ণ বিপরীতে দেখা যায় পুলিশি নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি।
ব্লম হ্যানসেন যথেষ্ট উদ্যমের সঙ্গে এটাও প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন যে, সংখ্যাধিক ‘‘জনতাকে’’ সমাবেশিত করার সামর্থ্য কিভাবে দশকের পর দশক ধরে ভারতীয় রাজনীতির রূপ দিয়েছে : ‘‘সমাবেশিত জনতা যত বড়, উপস্থাপিত বক্তব্য তত বেশি শক্তিশালী।’’ জাত-ভিত্তিক এবং ভাষা-ভিত্তিক জনতাকে সমাবেশিত করে শক্তির বিপুল প্রদর্শন এবং আত্মঘোষণার মধ্যে দিয়ে নতুন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান ঘটেছে।
ব্লম হ্যানসেন এই ব্যাপারটাকেও ব্যাখ্যা করেছেন যে, ভারতে কিভাবে ‘‘ক্রোধ’’ অথবা ‘‘আহত ভাবাবেগের’’ সঙ্গে নিয়মিতভাবে গণ হিংসা এবং ঐ হিংসাকে (যার মধ্যে রয়েছে সরকারি সম্পত্তি, পরিবহনের বিরুদ্ধে চালানো হিংসা এবং কখনও কখনও আবার জনগণের কিছু অংশের বিরুদ্ধে চালিত হিংসা) যুক্তিযুক্ত করে তুলতেও সেগুলিকে ব্যবহার করা হয়। এই প্রসঙ্গে মনে এই প্রশ্নটা জাগছে যে : ক্রোধোন্মত্ত জনতার দ্বারা দেশে বাস পোড়ানো, পাথর ছোড়া বা রাস্তা অবরোধ যেখানে সাধারণ ব্যাপার, সেখানে টিভি মিডিয়া কিভাবে কাশ্মীরের যুবকদের দ্বারা পাথর ছোড়ার ঘটনাকে ‘‘দেশদ্রোহী’’ কাজ রূপে আলাদা করে তুলে ধরতে এবং তার দানবীয়করণ ঘটাতে পারল এবং ঐ কাজের জন্য ছররা বন্দুক এবং বুলেটের ব্যবহারকেও সমর্থন করল? এছাড়া, গত পাঁচ বছরে মুসলিমদের দেওয়া গণ পিটুনিকে নিয়মিতভাবেই ‘‘স্বতস্ফূর্ত’’ ক্রোধের প্রকাশ রূপে ন্যায্য করে তোলা হয়েছে এবং ঐ ক্রোধ প্রকাশের একচেটিয়া অধিকার থাকে সংগঠিত মুসলিম-বিরোধী হিন্দু ‘জনতার’।
ব্লম হ্যানসেন এই স্ববিরোধিতার অনুসন্ধানেও ব্রতী হয়েছেন যে, ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে গণতন্ত্র গভীরতা লাভ করলেও (নিম্ন বর্ণের জাত পরিচিতির আত্মঘোষণা ও অধিকতর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব) তা কিন্তু এই সম্প্রদায়গুলোর ভিতরে ও মধ্যে জাতপাতগত-পিতৃতান্ত্রিক রেওয়াজগুলি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সক্ষম হয় নি। অতএব, জাত-বিভক্ত সমাজে গণতন্ত্র ‘‘সমষ্টিগত গতিময়তা হিসাবে’’ এবং ‘‘রাজনৈতিক ক্রীড়াক্ষেত্রকে সমতল বিশিষ্ট করে তোলার লড়াই হিসাবে সংগঠিত’’ হলেও এরই সাথে সহাবস্থান করে শক্তিশালী হয়ে উঠছে ‘‘এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অনুদার এবং পিতৃতান্ত্রিক রীতি, যেগুলোকে এখন সম্মান, সমষ্টিগত শক্তি এবং মর্যাদা বলে যুক্তিযুক্ত করে তোলা হচ্ছে।’’ ব্লম হ্যানসেন যা বলছেন তা আমাদের মনে জাগিয়ে তোলে আম্বেদকরের দেখিয়ে দেওয়া আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্রের বাহ্যিকরূপ এবং গভীরে শিকড় চাড়ানো গণতন্ত্র-বিরোধী মূল্যবোধের মধ্যে দ্বন্দ্বর কথা। সবাইকে গণতন্ত্রের আওতায় নিয়ে আসাটা গভীরতর হলেও এর সাথে উদারবাদী-গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ (অথবা আম্বেদকর যেটাকে বলেছেন সংখ্যাগুরুবাদী সামাজিক মূল্যবোধের বিপরীতে ‘‘সাংবিধানিক নৈতিকতা’’) চুঁইয়ে পড়েনি। ব্লম হ্যানসেন বলছেন, এটাই সম্ভবত সেই কারণ যার জন্য ‘‘সরকারের রূপ হিসাবে গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী সমর্থন—জনগণের ইচ্ছা বলে যেটাকে বোঝা হয় — এবং জনগণের নামে স্বৈরাচারী ধরনের শাসনের প্রতি সমর্থনের মধ্যে কোনো সংঘাত নেই।’’
এই সংকলনে ক্রিস্টোফি জাফরেলটের প্রবন্ধ ভারতের ‘‘জনজাতি গণতন্ত্রর’’ দিকে এগিয়ে যাওয়াটাকে ইজরায়েলের পথে হতে দেখেছেন যেখানে সংখ্যাগুরুবাদী শাসন এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারের দমনের সাথে সহাবস্থান করে সংসদীয় গণতন্ত্র। অবশ্য, ইজরায়েলে ঐ ধরনের সংখ্যাগুরুবাদ একই সাথে বিধিসম্মত (আইনের সমর্থনপুষ্ট) এবং বাস্তবত (বাস্তব অনুশীলনে যার অস্তিত্ব রয়েছে)। পক্ষান্তরে ভারত গত কয়েক বছরে প্রকৃতই একটা হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে কাজ করেছে আর ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংশোধন করে ভারত এক বিধিবদ্ধ হিন্দু রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে কিনা তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
জাফরেলট রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদী দল বিজেপি উৎস সংগঠন যা হল একটা ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী) সঙ্গে তাদের অনুমোদিত গোরক্ষক গোষ্ঠীগুলো এবং রাষ্ট্রযন্ত্র বিশেষভাবে পুলিশের সম্পর্কের অধ্যয়ন করেছেন যা সংঘাতময় হওয়ার বদলে সহযোগিতামূলক রূপেই প্রতিপন্ন হয়েছে। অতএব, সংখ্যালঘুদের, বিশেষভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘‘গো রক্ষক দলগুলোর’’ চালানো হিংসায় বিজেপি সরকারগুলো এবং তার সাথে পুলিশের মদত এবং অনুমোদন থাকে। ‘‘গো রক্ষা’’ অথবা ‘‘লাভ জেহাদ’’-এর (হিন্দু নারী এবং মুসলিম পুরুষের মধ্যে প্রেমকে আরএসএস এইভাবেই বর্ণনা করে) নামে মুসলিমদের এবং ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসভুক্ত যুগলদের উপর নজরদারির কাজকে পুলিশ ও রাজনীতিবিদরা বৃহত্তর সমাজের কাছে হস্তান্তরিত করে এবং পুলিশ ও রাজনীতিবিদরা এই গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা এবং শাস্তিহীনতা জোগায়।
জাফরেলট সঠিকভাবেই আরএসএসকে ‘‘ভারতের গুপ্ত নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্র’’ রূপে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর এই অন্তর্দৃষ্টি এই বিষয়টার ব্যাখ্যায় যথেষ্ট সাহায্য করেছে যে, কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সময়েও কিভাবে ভারতের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো সংঘ সমর্থকদের দখলে ছিল, যাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে বিজেপি প্রার্থীও হয়েছে।
ইয়ান এম কুকু তাঁর প্রবন্ধে দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোরে নজরদারি চালানোর হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদী গোষ্ঠীগুলোর ‘‘নৈতিক খবরদারির’’ পরিঘটনাটি বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, ১৯৯১ সাল থেকে ‘‘ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং বাজারপন্থী/রাষ্ট্র বিরোধী নীতিমালার যৌথ উত্থান’’ পারস্পরিকভাবে পরিপূরক ও স্ববিরোধী হয়েছে। যে হিন্দু জাতীয়তাবাদ তথাকথিত এই ধারণা পোষণ করে যে নিম্নবর্গীয়রা রাষ্ট্র দখল করে নেওয়ায় বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা আনার প্রস্তাব দেয়, তারা ফুলেফেঁপে ওঠে ‘‘সিইও ধরনের প্রশাসনের’’ জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীগুলোর সমর্থনের ভিত্তিতে। কুকু মনে করেন, নৈতিক খবরদারি আসলে সংখ্যাগুরুবাদী হিন্দু রাষ্ট্রের প্রকল্প এবং উন্নয়নের নয়া-উদারবাদী মডেলের মধ্যে (তিনি ধরে নিচ্ছেন, এই মডেল ‘‘নৈতিকতায়’’ উদারবাদ নিয়ে আসে) ‘‘নৈতিক টানাপোড়েনের’’ সংকেত জ্ঞাপক। এই খবরদারি প্রকাশ পায় পার্টিতে একসঙ্গে আমোদপ্রমোদ করা যুবক-যুবতীদর বিরুদ্ধে, ভিন্ন ধর্মের বা ভিন্ন জাতের যুগলদের প্রেমের অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদী গোষ্ঠীগুলোর চালানো হিংসার নানান দৃষ্টান্তের মধ্যে। কুক যেমন বলছেন, নয়া উদারবাদ কি প্রকৃতই পিতৃতান্ত্রিক নৈতিক বিধিকে শিথিল করার লক্ষ্যে চালিত এবং কঠোর পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও নৈতিক খবরদারির সঙ্গে তার কি যথার্থই দ্বন্দ্ব রয়েছে? আমি আমার লেখা ‘‘বিশ্বায়নমুখী ভারতবর্ষেলিঙ্গগত নিয়ন্ত্রণ’’ নামক প্রবন্ধে (ফেমিনিস্ট রিভিউ, জুলাই ২০১৮) দেখিয়েছিলাম যে, নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়ন এবং নারীদের স্বায়ত্ততার ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণকে যে দুটি ভিন্ন চরিত্রের বর্গে ভাগ করা হয় তা আসলে ভিত্তিহীন, যে দুটিরই পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদী সরকার। আমি বলেছিলাম যে, নারীদের স্বায়ত্ততার ওপর সংগঠিত আক্রমণের (স্বায়ত্ততার মধ্যে নিহিত ঝুঁকির থেকে ‘‘নারীদের রক্ষা করা’’র নামে যা চালানো হয়) সঙ্গে কর্পোরেট চালিত নয়া-উদারবাদী ‘উন্নয়ন’-এর কোন বিরোধ নেই। আমার প্রবন্ধ দেখিয়েছিল, বহুজাতিক এবং ভারতীয় কর্পোরেশনগুলোও কেমনভাবে নারীদের স্বায়ত্ততার প্রতি বিরূপ এবং এক সহজবশ্য শ্রমশক্তি তৈরি করার লক্ষ্যে ঐ স্বায়ত্ততাকে দমনই তাদের বৈশিষ্ট — আর এখানেই কর্পোরেশনগুলোর স্বার্থর সঙ্গে হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদী গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থ মিলে যায়। ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে নারীদের নিরাপত্তাহীনতা তাদের বিপন্নতা এবং কর্মস্থলে শোষিত হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। নারীদের স্বায়ত্ততার আত্মঘোষণা পরিবার, গৃহস্থালি, জাত এবং সম্প্রদায়ের বৃত্তে লব্ধ পরিসরেই গণ্ডিবদ্ধ থাকবে না : ঐ স্বায়ত্ততা কর্মস্থলেও ছড়িয়ে পড়তে চাইবে, তা ইউনিয়নে সংগঠিত হওয়া এবং সংঘবদ্ধ সামাজিক ও রাজনৈতিক সক্রিয়তায় প্রণোদিত করবে। নারীদের স্বায়ত্ততার উপর ‘‘নৈতিক খবরদারির’’ বাহিনীগুলোর মতাদর্শগত ও দৈহিক আক্রমণ সেই সমস্ত পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক শক্তিগুলোর উদ্বেগেরই অনুগামী হয় যারা নারীদের ক্রমবর্ধমান দৃষ্টিগ্রাহ্যতা ও আত্মঘোষণায় উৎকন্ঠিত হয়; ঐ সমস্ত আক্রমণ আবার বিশ্বায়িত নয়া-উদারবাদী ‘‘উন্নয়ন’’-এর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক উদ্বেগের শরিক হয় যা সহজে বশীভূত হওয়ার।
সুহাস পালিশকর এবং জেমস ম্যানর-এর লেখা দুটি প্রবন্ধে আধিপত্য (হেজিমনি) অর্জনের মোদীর প্রকল্প এবং ঐ প্রকল্পের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পালশিকার দেখিয়েছেন, মোদীর ‘‘উন্নয়ন’’ আখ্যান কেমনভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীগুলোর ও কর্পোরেট স্বার্থকে একীভূত করে তোলে এবং ‘‘সাধারণ নাগরিকদের’’ মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি করে যে অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্যও ‘‘শক্তিশালী জাতি’’ দরকার, জাতির শক্তির জন্য যার আবার কিছু প্রতিবন্ধকতার প্রয়োজন : ‘‘সংখ্যালঘু তোষণ’’, ‘‘দেশদ্রোহিতা’’, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদির মত প্রতিবন্ধকতাগুলোকে জয় করা দরকার। মোদী সরকার ‘‘এমন একটা আলোচনার পরিসর সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে যেখানে হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদের যুক্তিটাকে ‘নতুন ভারত’-এর চিত্তাকর্ষক কিন্তু শূন্যগর্ভ যুক্তি দিয়ে সুকৌশলে আড়াল করা হয়। প্রকাশমান এই (হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদী) আধিপত্য এতদিন ধরে অনুশীলিত হওয়া ভারতের গণতন্ত্রের প্রকৃতিটাকেই পাল্টে দিতে চায়। পলিশকার এই কথাগুলো দিয়ে প্রবন্ধ শেষ করেছেন যে, ‘‘নির্বাচনী ধাক্কা আলোচনার নতুন ক্ষেত্রটাকে সহজে প্রতিহত করতে না পারলেও নির্বাচনী পরাজয়ই কিন্তু নয়া আধিপত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে বিজেপির অনমনীয় যাত্রাকে ভেস্তে দিতে পারে।’’
আধিপত্য অর্জন করে তাকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে মোদী যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়ে চলেছেন, জেমস ম্যানরের প্রবন্ধ সে সম্পর্কে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি জোগায়। তিনি জানাচ্ছেন, মোদীর শক্তি, যা হল তাঁর নাটকীয় অঙ্গভঙ্গি, তার আধিপত্যবাদী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে যদি তিনি তামাসার পাত্র হয়ে ওঠেন। প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকারের ব্যর্থতার পর মোদী যে সমস্ত ‘‘লম্বাচওড়া নতুন প্রতিশ্রুতি’’ দিচ্ছেন তার জন্য তিনি কিছু সময় পাবেন, তবে, তা কিন্তু মোহভঙ্গকে বাড়িয়ে তোলার ঝুঁকিকে তীব্রতর করে তুলতে পারে। মোদীর ‘‘কৌশলের ভাণ্ডার সীমিত হওয়ায় কাজে লাগানোর জন্য তাঁর কাছে একটি বিষাক্ত বিকল্পই’’ পড়ে থাকে — আকাঙ্খার বদলে ক্রোধকে (প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো এবং মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে) উস্কিয়ে তোলা। ম্যানর কিন্তু প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘নাগরিকরা যদি বছরের পর বছর বিজেপি শাসনাধীনে থেকে কর্মহীনতা, কৃষকদের সমস্যা এবং অন্যান্য ব্যর্থ হয়ে যাওয়া আকাঙ্খা নিয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, সে ক্ষেত্রে মুসলিমদের তাঁরা অপরাধী ভাববেন, এটা কি প্রত্যাশা করা যায়?’’ ম্যানর বলছেন যে, এই কৌশল স্বল্প পর্যায়েই ফলদায়ী হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘকালীন পর্যায়ে ইসলামোফোবিয়া কেন্দ্রিক বিদ্বেষ উস্কিয়ে তোলা এবং ‘‘প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে বিদ্বষমূলকভাবে ধিক্কৃত করাটা’’ শূন্যগর্ভহয়ে উঠে আধিপত্যকেই বিপর্যস্ত করে তুলবে, বিশেষভাবে বিজেপি যদি একতরফা এবং প্রায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করে, সেই ক্ষেত্রে। প্রলয় কানুনগো তাঁর প্রবন্ধে মোদী ও তাঁর শাসনকার্যের সঙ্গে আর এস এস-এর সম্পর্ককে চিত্রিত করেছেন। আর তনিকা সরকার তাঁর প্রবন্ধে বাম-ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মুখোমুখি হওয়া সমস্যাকে তুলে ধরেছেন, যে সমস্যার মুখে তাঁরা পড়েন তৃণমূল স্তরে সংঘের (বিষাক্ত) ইতিহাস সৃষ্টি করা ও তা শেখানোর বিপুল কাজের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে। তনিকা সরকারের কথায় এই কাজ হল ‘‘এমন একটা ইতিহাস তৈরি করা যায় প্রাণনাশ করে।’’
প্রণব বর্ধন মোদী সরকারের অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে বিভিন্ন বর্গে ভাগ করেছেন : ‘‘ধাপ্পা; ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্তরে মোক্ষম চাল; ইউ পি এ সরকারের নীতিগুলোকে চালিয়ে যাওয়া; দক্ষিণ অভিমুখে নতুন নীতি এবং পুরোদস্তুর পশ্চাদমুখী নীতি।’’ এ কে ভট্টাচার্য এবং পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা স্যাঙাতি পুঁজিবাদের সঙ্গে মোদী সরকারের সম্পর্ক এবং স্যাঙাতি পুঁজিবাদের অভিযোগকে তার প্রয়াসগুলোকে খতিয়ে দেখেছেন
এই সংকলনে একটা অত্যন্ত মনোগ্রাহী প্রবন্ধ এসেছে নন্দিনী সুন্দরের কাছ থেকে। এই প্রবন্ধে তিনি একটা স্ববিরোধিতার নির্দেশ দিয়েছেন, আর সেটা হল — একদিকে আদিবাসী (আঞ্চলিক) সম্প্রদায়গুলোকে হিন্দুত্বর দলে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে, অন্যদিকে আবার বিজেপি সেই সমস্ত কর্পোরেট শক্তিগুলোর ঘনিষ্ঠ যারা আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা ঘটায় এবং তাদের ওপর হিংসা চালায়। তিনি আমাদের ফ্যাসিবাদের গণ মনস্তত্ত্ব রচনায় উইলিয়াম রিচের তুলে ধরা প্রশ্নকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘জনগণের মধ্যে কি এমন ছিল যার জন্য তারা একটা পার্টির পিছনে চলল যাদের লক্ষ্য, বস্তুগত এবং আত্মগত, তাদের নিজেদের স্বার্থের প্রতিকূল ছিল?’’
মৃদু রাই মোদী শাসনে কাশ্মীরিরা যেভাবে ‘‘সন্ত্রাসবাদী হিংসা, অবৈধ ধর্মীয় আবেগ, দেশদ্রোহের প্রতীক’’ হওয়ার প্রয়োজন মিটিয়েছে তার বিশ্লেষণ করেছেন। এক ‘‘অতিকথার হিন্দু রাষ্ট্র’’ গঠনের অভিপ্রায়ে এই প্রতীকগুলোর আশ্রয় নেওয়া হয়। তিনি দেখিয়েছেন, আগের জমানাগুলোতেও কাশ্মীরের সাপেক্ষে ভারতীয় রাষ্ট্রের রণনীতি বিশেষভাবে ১৯৯০- এর দশক থেকে ‘‘প্রতিদিন সন্ত্রাস ও হিংসা চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে’’ শাস্তিহীনতাকে গভীরতর করে তোলে। কিন্তু হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রয়োজনে গত পাঁচ বছরে কাশ্মীরিদের ‘‘শত্রুর’’ প্রতিমূর্তিতে তুলে ধরাটা মোদী জমানার এবং মিডিয়ার দেখানো প্রতিক্রিয়ার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হয়ে রয়েছে। রাই এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, ‘‘শত্রু রূপে মূর্তহওয়ার যে উদ্দেশ্য কাশ্মীরিরা সাধন করে তা হিন্দুত্বর উচ্চরোলের রাজনীতির কাছে এতটাই অবশ্যকীয় যে কাশ্মীর ‘সমস্যার’ কোন ‘সমাধান’ একরকম অসম্ভব হয়ে ওঠে।’’
এই সংকলনের অন্যান্য প্রবন্ধগুলি যে সমস্ত বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করেছে তা হল, তার নিজ উদ্দেশ্য সাধনে হিন্দুত্ব প্রকল্পর যোগার একটা নির্দিষ্ট রূপকে আত্মসাৎ ও হাতিয়ার করা এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ও তাৎক্ষণিক তিন তালাককে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে তোলার এজেণ্ডাকে কাজে লাগিয়ে ‘‘নারীবাদী’’ আলোচনা ধারাটাকে আত্মসাৎ করার বিজেপির প্রচেষ্টা এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে উদ্ভট বিষয়ের উপস্থিতি।
আমরা যখন দ্বিতীয় দফার মোদী জমানার শিখরে দাঁড়িয়ে আছি, যে সমস্ত কৌশল মোদীকে তার ক্ষমতাসীন অবস্থা এবং মোহমুক্তির মোকাবিলা করে দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য রায় পেতে সাহায্য করল সেগুলো বোঝার চেষ্টা করছি, প্রবন্ধের এই সংকলন তখন অবশ্য পাঠ্য। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছেও এটা অবশ্য পাঠ্য, কারণ তাঁদের জানা প্রয়োজন যে, আজকের দুনিয়ায় মোদী ও বিজেপির শাসনাধীন ভারতবর্ষহল ট্রাম্প ও বলসোনারোর মতোই একনায়কতান্ত্রিক/ফ্যাসিবাদী এবং সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতির এক প্রকট দৃষ্টান্ত।