পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতি যাচ্ছে এক ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে। লোকসভা নির্বাচন ও তার পরিণাম বর্তমানে ভাঙচুরের ঘটনা ও প্রবণতা কেমনতর চলছে তা বুঝিয়ে দেয়। রাজনৈতিক গতিবিধিতে বিপুল জনসমর্থন পকেটে পুরে এক ফ্যাসিস্ত শক্তির যে নয়া উত্থানের শুরুয়াৎ ধরা পড়ছে তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়ে চলেছে ততোধিক গুরুতর। প্রধান ধারায় উল্লম্ফন ঘটছে প্রবহমান তৃণমূলী দক্ষিণপন্থা থেকে বিজেপির ঘোর দক্ষিণপন্থার দিকে।
রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছে আট বছর আগে। ‘বাম’ হাবভাব দেখিয়ে। তারপর পরিবর্তন নিয়ে আসার নামে যে ‘পরিবর্তন’-এর পন্থা নেয় তা তার শাসনক্ষমতার দ্বিতীয় পর্ব পূর্ণ করার অনেক আগেই তাকে সংকটে ফেলে দিতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় তৃণমূল স্পষ্টতই দিশাহীন।
পক্ষান্তরে, উল্কার মতো উত্থান ঘটিয়েছে যে বিজেপি সে কিন্তুু বসে নেই। সর্বত্র রঙ বদলে দেওয়ার উন্মত্ততার হোলি শুরু করে দিয়েছে। গণতন্ত্র ফেরানোর বাজী ধরার নামে সামাজিক-রাজনৈতিক বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষবাস্প ছড়ানো, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করা, সমস্ত কার্যকলাপকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রসায়ন বানানো আর ‘জনতার ইচ্ছা’ বা ‘জনরোষ’ বলে চালানো ইত্যাদি যা যা তার অস্ত্রশস্ত্র সবই প্রয়োগ করে চলেছে। এসব নিয়ে কোনো নিন্দাবর্ষণকে কোনও গ্রাহ্যের মধ্যে আনছে না। বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফল করেছে বলে উৎসব-বিনোদনে মাতোয়ারা নয়, কোথাও ‘শান্তির জল’ ছেটাতে যাচ্ছে না, অভিযানে বিরতি দেওয়া তো নয়ই, তার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি কায়েমের বাহুবলী দৌরাত্মের প্রকাশ ঘটছে প্রতিদিনকার আক্রমণাত্মক ভাব-ভঙ্গী-ভাষায় ও হামলায়। মিডিয়ায় তাদের প্রতিনিধিত্বের ভাষা ন্যূনতম সহিষ্ণুতার শিষ্টাচার রাখছে না। দলের জাতীয় স্তরের নেতাদের লেগে আছে আসাযাওয়া, মুখ ছোটানোয় তারা বেপরোয়া । ঔদ্ধত্য, দাপট যেরকম ছিল লোকসভা নির্বাচনের পরিস্থতিতে, তারপরেও তা একইরকম চলছে। বিজেপি বুঝিয়ে দিচ্ছে ২০২১ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকার পক্ষপাতী নয়। ২০২০-র মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ঘোড়েল পরিস্থিতি কিভাবে তৈরি করা যায় সেদিকেই রয়েছে চোখ। সদ্য এসে দলের রাজ্য নেতৃত্ব ও নব নির্বাচিত সাংসদদের তাতিয়ে দিয়ে গেলেন বাংলার ভারপ্রাপ্ত সর্বভারতীয় স্তরের সাংগঠনিক নেতারা। নিজ নিজ কেন্দ্রে লেগে থাকার ও ঝড় তুলে চলার নিদান দিয়ে গেলেন গোটা সংগঠনের উদ্দেশ্যে। এরই অঙ্গস্বরূপ তারা ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগানের নতুন করে মহড়া শুরু করে দিয়েছে। যত্রতত্র হিন্দুসমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেতে আর বিশেষত তৃণমূল নেত্রী ও নেতা-মন্ত্রীদের প্ররোচিত করতে। এ নিছক হিন্দু ভক্তিভাবের স্বতস্ফূর্ত আবেগ প্রকাশের বিষয় নয়। সেরকম একটা ভন্ডামীর আবরণে আসলে উদ্দেশ্য হল রাম-রাজনীতির স্বার্থচরিতার্থ করা। তবু যাতে ‘অ-বাঙালিদের পার্টি’ বলে তৃণমূল তকমা সেঁটে দিতে না পারে তার জন্য বিজেপি নেতৃত্ব আরও শ্লোগান জুড়ে দিচ্ছে যেমন, ‘জয় মা কালী’! বাংলার ও বাঙালিদেরও পার্টি হয়ে ওঠার বাসনায়। এইভাবে চেষ্টা রয়েছে চাঙ্গা রাখার। তাই তারা ফেউ লাগিয়েছে শ্লোগানের, আর তা দেখে যত প্ররোচিত হচ্ছেন তৃণমূলী মহোদয়রা ততই বিজেপি সফল হচ্ছে স্বীয় স্বার্থে।
তৃণমূলের অবস্থা এখন ত্রাহি ত্রাহি, ক্ষমতা আগলে রাখার চিন্তায়। অন্যদিকে, বিজেপি মরীয়া ক্ষমতার দখল পেতে। এই সংঘাতের জেরেই বেড়েছে বিজেপি-তৃণমূলের খুনোখুনির রাজনীতি।
তৃণমূলের সংকটে পর্যবসিত হওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুতর কারণটি হল স্বৈরাচার কায়েম করা। এটা গণতন্ত্রপ্রিয় ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকামী এক উল্লেখযোগ্য অংশকে ভীষণ বিরূপ করে তুলেছে। এ ক্ষয়ক্ষতি সামলে ওঠা মোটেই সহজ নয়।
তার ওপর বিজেপির হিন্দুত্বের মেরুকরণের মোকাবিলায় তৃণমূলের গৃহীত অবস্থানও যথেষ্টগোলমেলে, আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ নয়, তৃণমূল ভোট চেয়েছে সব ধর্মের নামে, বিশেষ কাতরতা দেখিয়েছে সংখ্যালঘু ভোট টানতে, সেটা করতে গিয়ে এক ধরণের মেরুকরণের রাজনীতিই করেছে। আর এর ফলে তার প্রভাবিত নরম হিন্দুত্বের ভোট থেকে এক উল্লেখযোগ্য অংশের ভোট বিজেপির দিকে ঘুরে গেছে।
অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয়েছে সিপিএম ঘরানার বামপন্থীদের। ভোটও গেছে, ভাবমূর্তিও গেছে। নেতৃত্ব ব্যগ্র হয়ে পড়েছিল কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করতে, আর তলায় তলায় প্রভাবিত ভোটার মানসিকতা সংক্রামিত হয়েছে বিজেপির বিষবাস্পে। ‘এবার রামে, পরের বার বামে’ ভোট দেওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতা পল্লবিত হওয়াটা মোটেই নেতৃত্বের অগোচরে হয়নি। নেতৃত্বও ততটাই উদাসীনতা দেখিয়েছে, কোনো কোনো স্তরে যে মদত যোগায়নি তা নয়। তার প্রতিফলে বাম প্রভাবিত মুসলিম ভোটও মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে তৃণমূলের ঘরে। এখন উপরোক্ত বাম ধারার নেতারা স্বীকার করছেন কিছু কিছু ভুল হয়েছে, কিন্তুু সামগ্রিকতায় নয়। সিপিএমের মধ্যে বিতর্কও রয়েছে বাংলায় কে প্রধান বিপদ — বিজেপি না, তৃণমূল তা নির্ণয় করা নিয়ে।
সংগ্রামী বামপন্থীদের বাংলায় প্রকৃত অবস্থা হল, আদর্শবাদের দিক থেকে অবশ্যই সবল, কিন্তুু গণভিত্তির প্রশ্নে আজও প্রচুর প্রকট দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে, কি আন্দোলন গড়ে তোলা, কি নির্বাচনী ফসল তোলা, উভয় ক্ষেত্রেই। পশ্চিমবাংলায় নতুন যে ভাঙাগড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে উল্লেখযোগ্য হস্তক্ষেপ করে শক্তি বাড়িয়ে নিতে পারেনি। তবে নতুন পরিস্থিতির নতুন বিশ্লেষণ করে নতুন উদ্যমে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কঠোর-কঠিন প্রয়াসকে ব্রত করতে হবে। এই কাজ অর্জন করার ওপরই নির্ভর করবে সাফল্য পাওয়া এবং ক্রমে ক্রমে বাম শক্তিসমূহের কাছে কদর বাড়াতে পেরে ওঠা।