বামপন্থার কি হবে!

বামপন্থার চোখে কি লজ্জার খবর!

সিপিএম-কে ‘ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা’ জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস! মালদহ ও বহরমপুর দুটি আসনে প্রার্থী না দিয়ে কংগ্রেসের জেতার রাস্তা সুগম করে দেওয়ার জন্য। তার আগে কতই না ঘটেছে রঙ্গক্রম! সিপিএম আগ বাড়িয়ে একতরফা পূর্ণাঙ্গ আসন সমঝোতার প্রস্তাবের বার্তা দেয়। কিন্তু ধাক্কা খায়। কারণ আসন-স্বার্থের কারণে প্রদেশ কংগ্রেসের মধ্যেও আপসপন্থী ও আপসবিরোধী গোষ্ঠী সংঘাত ছিল এবং শেষোক্ত গোষ্ঠীর আধিপত্যেই সিপিএমের সমঝোতা প্রস্তাব ধাক্কায় পড়ে। এ প্রশ্নে সংঘাত বামফ্রট শরিকদের মধ্যেও ছিল, এমনকি সিপিএমের মধ্যেও ছিল। কংগ্রেসের সাথে আসন সমঝোতার ইচ্ছাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতার বিরোধিতা সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দিক থেকেও ছিল। আরও কিছু বাম-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল মহল এই প্রশ্নে প্রকারান্তরে বিরোধী অবস্থান পোষণ করেছিল। কিন্তু আলিমুদ্দিন স্ট্রীট অফিসের নেতৃত্ব এই সমস্ত আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে, কংগ্রেসের সাথে সমঝোতা প্রক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হয়। তাহলেও শেষমেশ কংগ্রেস আসন ভাগাভাগির মোট সংখ্যা ও ক্ষেত্রগত প্রশ্ন তুলে একতরফা সমঝোতার দরজা বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, যাচ্ছেতাই অপমান করে। সিপিএম নেতৃত্ব সেটা দূর্ভাগ্যজনক মনে করে হজম করে নেয়। এই প্রক্রিয়ায় উল্টে একদিকে বামফ্রন্টের শরিকদের, অন্যদিকে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনকে দু’একটি আসন ছাড়ার প্রশ্নে বেঁকে বসে। ফলে সিপিএম নেতৃত্ব সবদিক থেকে আরও একবার মুখ পোড়ায়। তারপরেও আবার তাদের ফ্রন্ট শরিক সংগঠনের আপত্তি গ্রাহ্য না করে কংগ্রেসকে আসন ছেড়ে দেওয়ার একতরফা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। সিপিএম এতো কিছু করলেও কংগ্রেস কিন্তু সিপিএমের কথা ভেবে কোন কেন্দ্র থেকে সরে থাকেনি বা সিপিএম প্রার্থীর সমর্থনে ভোট করানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে সিপিএমের সমর্থনের দৌলতে দুটি আসন পাওয়া গেছে দেখে কংগ্রেস উল্লসিত এবং এই লোভের চোখ সে খোলা রাখতে পারে পরবর্তী বিভিন্ন পৌরসভা নির্বাচনের কথা ভেবে। এমনকি ফের ভাবলেও ভাবতে পারে পরের বিধানসভা নির্বাচনের ভাবনায়। তাই ‘ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা’ জানিয়ে রাখল। সিপিএমের অভ্যন্তরে উসকে দেওয়ার একটা বার্তা দিয়ে রাখল।

এতো কান্ডের পরে প্রত্যুত্তরে সিপিএম নেতৃত্ব কি ভাবছে? খবরের কাগজের খবর যদি সত্যি হয় তাহলে তো কংগ্রেসের প্রতি দুর্বলতা দেখানো আর আন্তক্রিয়ার শরিক বাম দলগুলোর প্রতি অবজ্ঞার আচরণ করা নিয়ে সিপিএমের কোন অনুতাপ নেই। গুরুতর ত্রুটির পুনরাবৃত্তি হয়েছে বলে মনে করছে না। পরিণামে বিশ শতাংশের বেশি তাদের বাম ভোট যে রামমুখী হল, তা নিয়ে কোন বিশেষ মাথাধরার কথা শোনা যাচ্ছে না। বরং কংগ্রেসের সাথে কোন পূর্ণাঙ্গ সমঝোতা হয়নি বলে আক্ষেপ থাকছে। বিকল্পের প্রশ্নে স্বাধীন সংগ্রামী বাম ঐক্য গড়ে তোলার গুরুত্বকে তার স্বাভাবিক অগ্রাধিকার প্রাপ্যের স্থান থেকে চ্যূত করে দেওয়া হল। যে সিপিএম কর্মী মেরে ফেললেও লাল ঝাণ্ডার বুথ ছেড়ে যাব না বলে পণ করেছিলেন, অথবা বিগত পাঁচ বছর যাবত ফ্যাসিস্ত বিজেপি-স্বৈরাচারী তৃণমূলের বিরুদ্ধে লাগাতার যারা বৃহত্তর যুক্ত বাম উদ্যোগকে মজবুত করতে তাকত লাগিয়েছিলেন, বামফ্রন্ট প্রার্থীদের সমর্থনে পথে নেমেছিলেন,তারা লোকসভা নির্বাচনোত্তর অবস্থায় কি সিপিএমের আচরণে উপযুক্ত প্রতিদান পেলেন? প্রশ্নটা রইল।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম শুধু কংগ্রেসের উপকার করে ক্ষান্ত হয়নি। সবচেয়ে উপকার করেছে বিজেপির। বিজেপির আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে শক্তি যোগান দিয়েছে। রাম পার্টিকে বাম ভোট দিয়েছে ঢেলে। কোনো পূর্বনজীর নেই এই হারাকিরির। সিপিএম এহেন ন্যক্কারজনক কম্মের জন্য দায়ি থাকার হাত ধুয়ে ফেলতে পারে এই অজুহাত দেখিয়ে যে, এটা তাদের ঘোষিত অবস্থান ছিল না, কিন্তু তাদের কর্মী-সমর্থক বাহিনীর তৃণমূল বিরোধী রাগ এত তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারণ করে যে তার বিজেপিমুখী হওয়াটা নেতৃত্ব ঠেকাতে পারেনি। এর দায় অস্বীকার করার কোনো যুক্তি নেই। নেতৃত্বের এই সাফাই গাওয়ার অন্যায়কে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। অন্যদিকে সিপিএমের ভোটব্যাঙ্ক থেকে মুফতে প্রায় বিশ শতাংশের বেশি পেয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিজেপি হয়ত আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কৃতজ্ঞতা’ জানায়নি, তবে এই চোরাস্রোত যাতে থাকে সে ব্যাপারে বিজেপি মনে হচ্ছে হুঁশ রাখছে, তৃণমূলের হাতে বেদখল হয়ে যাওয়া সিপিএমের পার্টি অফিসগুলো শক্তি প্রদর্শন করে উদ্ধার করে দিয়ে সাহায্য করা কি উপরোক্ত কৌশলের অঙ্গ নয়! যদি এই আশঙ্কা বোধে উদয় হয়ে থাকে তবে তার ভিত্তিতে নির্মম আত্মসমালোচনা কোথায়? সিপিএম নেতৃত্ব দাবি করেছে বাম ভোটারদের তৃণমূলের ওপর এতোই রাগ যে তা মেটাতে ফ্যাসিস্ত বিজেপিকে ভোট দিয়ে ফেলেছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, বাম ভোটাররা দিগভ্রান্ত হয়েছে। তাহলেও তা সময়ে নেতৃত্ব বুঝে উঠতে পারল না কেন? তার প্রতিষেধনে কি ব্যবস্থা নিয়েছে? নাকি নির্লিপ্ত থেকেছে!

সিপিএম তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাদের ভোটারদের রাগের কথা শুনিয়েছে। কিন্তু বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল তো নিজেই স্বীকার করেছে উল্টো কথা। সিপিএমের ভোটারদের দাক্ষিণ্যে বিজেপি নয়, তৃণমূল প্রার্থী উপকৃত হয়েছে, জিতেছে। সিপিএম প্রভাবিত মুসলিম ভোট গেছে তৃণমূলের মুসলিম মহিলা প্রার্থীর ঘরে। একই সত্যতা দাবি করেছে ঐ কেন্দ্রের খোদ বিজেপি প্রার্থী। এই ঝোঁক আরও কোথাও কাজ করেছে কিনা সেটাও বুঝতে হবে।

উপসংহারে প্রশ্ন সেই বামপন্থাকে কেন্দ্র করে ওঠানো দরকার। আজকের ভারতের রাজনীতি, লড়াই, নির্বাচন, সবকিছুই আক্ষরিক অর্থেনিছক শ্রেণী ভিত্তিতে চলে না। আরও বহুমাত্রিক দিকগুলো সামনে এসে গেছে, যেমন জাতি, জাতিসত্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীবাদ ইত্যাদি। রয়েছে তৃণমূলের স্বৈরাচারী সন্ত্রাস, ফ্যাসিস্ত বিজেপির হামলা। সর্বোপরি বাড়ছে মেরুকরণের রাজনীতির বিপদ। এর সম্মুখীন হয়ে বামপন্থার ক্রমশ দুর্বল ও প্রান্তিক হয়ে পড়া কি করে রোধ করা যায়, বাম শক্তির নিজস্ব শক্তিকে কিভাবে পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন, সেই প্রশ্নে বামপন্থীদের আত্মানুসন্ধানে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। এখন এই বিকল্পের ব্যাপারেই ধ্যান-জ্ঞান দরকার।

খণ্ড-26
সংখ্যা-14