সবচাইতে বড় বামপন্থী দলের ভালসংখ্যক নেতা, সদস্য ও সমর্থক ভাবছেন, বিজেপির ভরা পালে আর একটু হাওয়া যুগিয়ে একবার যদি মমতাকে হঠানো যায়, তবে ক্ষমতায় ফেরার পথে সবচেয়ে বড় বাধাটা ধসে যাবে। তারপর বিজেপির কুশাসনের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করে আবার নির্বাচনে জিতবে বামফ্রন্ট।
ধন্য আশা কুহকিনী! আপনারা পার্টি কংগ্রেসে বিজেপিকে ফ্যাসিস্ট বলে চিহ্নিত করলেন, এখন বলছেন তৃণমূলের চাইতে সহজে তাদের সরানো যাবে? তাও আবার নির্বাচনের মাধ্যমে! পৃথিবীর ইতিহাস গুলিয়ে ফেললেন নাকি কমরেড? তাছাড়া আপনারা তো মেনেই নিয়েছেন যে, কংগ্রেসের সাহায্য না পেলে ক্ষমতাসীন তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার শক্তি বামফ্রন্টের নেই। সেই শক্তি বা প্রতাপ দেখিয়ে যে বিজেপি দ্রুত উঠে আসছে, গদীতে বসে গেলে সে কি আরও ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে না? বিশেষত যখন সে কেন্দ্র সরকারেরও পূর্ণ মদত পাবে, যে সুবিধাটা তৃণমূল সরকার পায়নি? নিছক ব্যবহারিক রাজনীতির এই সহজ হিসাবটাও আপনারা একবার ভেবে দেখলেন না?
কৌশলের নামে আত্মসমর্পণের এই কার্যক্রম স্বাধীন ভারতে বামপন্থার ইতিহাসে সম্ভবত সবচাইতে বড় রাজনৈতিক ভুল তথা আদর্শগত বিচ্যুতি। এর ফলে কেবল পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা দেশে বামপন্থীরা বিশ্বাসঘাতক বলে ধিক্কৃত হচ্ছেন। আশু প্রয়োজনের তাগিদে বামপন্থী আন্দোলনের ভবিষ্যত জলাঞ্জলি দেওয়া এবং জনগণকে রাজ্যস্তরেও ফ্যাসিস্ট শাসনের মুখে ঠেল দেওয়ার এই অদূরদর্শী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মনীতি এখনই পরিত্যাজ্য। তৃণমূলের অপশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বামপন্থীদের অবশ্যই সংগ্রামের বর্শামুখ বিজেপির বিরুদ্ধে রাখতে হবে এবং রাজ্যরাজনীতির দ্বি-দলীয় মেরুকরণের বিপরীতে এক স্বাধীন বাম-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিসরের বিস্তার ঘটাতে হবে। আজকের জটিল পরিস্থিতিতে এটাই হল একমাত্র নীতিসম্মত ও বাস্তবসম্মত কৌশল।
প্রথমত, আরএসএস-বিজেপি একটি আদ্যন্ত ফ্যাসিস্ট শক্তি যা অন্য সব প্রতিক্রিয়াশীল অত্যাচারী দল বা সরকারের থেকে চরিত্রগতভাবেই পৃথক। ফ্যাসিবাদ মানে নিছক নির্যাতন বা সন্ত্রাস নয়। তার বিশেষত্ব হল জনমনমোহিনী ভাষা-ভঙ্গিমায় প্রচারের প্লাবনে মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিপন্ন করা, একজনমাত্র নেতাকে জাতির পরিত্রাতা বা পুনরুত্থানের নায়ক রূপে প্রতিষ্ঠিত করা, সংখ্যাগুরুকে সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে অর্থাৎ মেরুকরণের মাধ্যমে ভোটব্যাঙ্ক ও গদী সুরক্ষিত করা — এরকম আরও অসংখ্য অপকৌশল ও চক্রান্তমূলক কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে রাজনীতির এমন একটা ডিসর্কোস বা ধারা চালু করা, যেখানে মানুষের খাদ্য-গণতন্ত্র-স্বাধীনতার দাবিগুলো পিছনে ঠেলে দেওয়া যায়, দেশটাকে ভাসিয়ে দেওয়া যায় উগ্র জাতীয়তাবাদের অন্ধ আবেগে, অবাধে চালানো যায় কর্পোরেট লুন্ঠন ও বিরোধীদের খতম অভিযান। একটি ফ্যাসিস্ট দলকে যখন শাসকশ্রেণী বরণ করে নেয়, তখন সংসদীয় গণতন্ত্র, সংবিধান, আইনের শাসন সবকিছু ধাপে ধাপে ধ্বংস হয়ে যায়। গোটা দেশ পরিণত হয় জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সমস্ত শ্রমজীবী ও বুদ্ধিজীবী মানুষের কারাগারে। ভারতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, আরও শক্তি নিয়ে মোদীর প্রত্যাবর্তনে তা অনেকটা এগিয়েও গেল। এর চাইতে বড় শত্রু বা বড় বিপদ আর কিছু হতে পারে না। এখনই যদি সর্বত্র সর্বশক্তি দিয়ে এর গতিরোধ না করা যায় তবে হয়ত অনেক দেরী হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, গোটা দেশের মতো আমাদের রাজ্যেও বিজেপির গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ ও সাংসদ সংখ্যার দিক থেকে বিজেপি বিরাট লাফে অনেকটা এগিয়েছে এবং তারপর থেকে হানাহানি ও এলাকা দখল, প্রশাসনের অন্দরে প্রভাব বিস্তার, শাসক দলের ভেতর থেকে কর্মী ও জনপ্রতিনিধি খরিদ করে আনার ব্যাপারেও এগিয়ে চলেছে। ত্রিপুরা-আসাম কব্জা করার পর মহা উদ্যমে সে লড়ছে বাংলা দখলের আগ্রাসী লড়াই, তৃণমূল লড়ছে অবরুদ্ধ দূর্গ কোনো রকমে টিকিয়ে রাখার আত্মরক্ষাত্মক সংগ্রাম। তাই আমাদের রাজ্যে দক্ষিণপন্থার ক্রমিক উত্থানে এক নিকৃষ্টতর নব পর্যায়ের বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিরোধ গড়াটাই আজ বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির মুখ্য কর্তব্য। এই ব্যারিকেড গড়তে হবে ভারতীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী মতাদর্শগত-রাজনৈতিক প্রচার অভিযানের মধ্যে দিয়ে, গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, যা সম্প্রসারিত হবে আমাদের নির্বাচনী পলিসিতেও।
কিন্তু বাংলার মাটিতে বিজেপি তো কোনোদিনই তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি। সুতরাং সাময়িকভাবে এগোলেও, এমন কি সরকার গঠন করলেও তাকে পরাস্ত করা কঠিন হবে না — এমনটাই মনে করেন আমাদের কিছু বন্ধু। এই ইচ্ছাপূরণের গল্পটিকেও একটু বিচার করে দেখা দরকার।
আমরা রামমোহন, বিদ্যাসাগরের কথা খুব বলি। মনে রাখি না তাঁদেরই মোটামুটি সমসাময়িক ‘রাজা’ রাধাকান্ত দেব, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ অনেকের কথা। এঁরা ছিলেন তৎকালীন হিন্দু সমাজে যথেষ্ট প্রভাবশালী রক্ষণশীল ধারার (সে যুগে যাকে ‘হিঁদুয়ানি’ বলা হত) প্রতিনিধি। এঁরা সতীদাহ প্রথা বিলোপ ও বিধবা-বিবাহ প্রচলনের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জনমত সংগ্রহের কাজ করেছিলেন। (আবার ইংরাজী শিক্ষা, নারী শিক্ষা বিস্তারেও ভূমিকা নিয়েছিলেন)। নাগপুরে আরএসএস প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০০ বছর আগে ১৮৩০ সালে কলকাতায় রাধাকান্তরা স্থাপন করেছিলেন রক্ষণশীল ‘‘ধর্মসভা’’।
পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কথা এবং সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে দেশভাগের পক্ষে আওয়াজ তোলার প্রবণতাটির কথাও আমাদের অজানা নয়। পশ্চিমবাংলায় প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে মোট ২৩৮টি আসনের প্রায় অর্ধেক আসনে হিন্দুত্বওয়ালারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে — জনসঙ্ঘ ৮৫ এবং হিন্দু মহাসভা ৩৩ আসনে। প্রথম দল ৯টি আর দ্বিতীয় দল ৪টি আসন জিতে নেয়। বলতেই হবে, শুরুটা ওরা ভালই করেছিল। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর (১৯৫৩) পর এবং শ্রেণী সংগ্রামের বিস্তার ও বামপন্থীদের অগ্রগতির আবহে দ্রুতই তারা রাজনীতির মঞ্চ থেকে প্রায় হারিয়ে যায়। তবে তলায় তলায় আরএসএসের কাজ চলতে থাকে। ২০১৪ সালে মোদী সরকার আসার পর অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের ওপর জোর দেওয়া হয়। কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, অরবিন্দ মেনন, শিবপ্রকাশের মতো অভিজ্ঞ প্রচারক-সংগঠকদের দায়িত্ব দেওয়া হয় সংগঠন গড়ে তোলার, সভাপতি পদে আনা হয় ডাকাবুকো দিলীপ ঘোষকে। পরে এঁদের সাথে যুক্ত হন দলত্যাগী নেটওয়ার্কিং মাস্টার মুকুল রায়ও। বিজেপির ভোট ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে চার শতাংশ থেকে বেড়ে এগারো শতাংশে পৌঁছায়। পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস শাখা ২০১৬ সালে ১,১০০ থেকে বেড়ে পরের বছর ১,৩৫০ ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। সেখানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের একজন কার্যকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, যে সব জায়গায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো বুনিয়াদী সুবিধাগুলোর অভাব আছে, সেখানেই তাঁরা ভাল সাড়া পাচ্ছেন। কথাটা মিথ্যা নয়। প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ডের মতোই এ রাজ্যেও বিশেষত আদিবাসী অঞ্চলে আরএসএস-এর প্রায় নীরব, ধৈর্যশীল কাজের ফসল পরিস্কার চোখে পড়ছে। সামান্য সুযোগ পেলেই যে কোনো ইস্যুতে সাম্প্রদায়িক রং লাগিয়ে দেওয়া এবং বিদ্বেষ ও বিভাজনের কর্মসূচীও চলছে। এইভাবে নীচুতলায় ধারাবাহিক রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কাজ আর ওপর থেকে প্রায় প্রতিদিন কিছু না কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক তৎপরতা (যেখানে মোদী-শাহও সদা সক্রিয়) — দু-দিক থেকে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে বাংলার অতি-পুরাতন রক্ষণশীল-সাম্প্রদায়িক পরম্পরাকে যুগোপোযোগী করে পুনরুদ্ধার করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে আরএসএস-বিজেপি। এটা ছাড়া, নিছক মোদী ‘হাওয়া’-র জোরে লোকসভা নির্বাচনে তাদের স্কোর ৪০ শতাংশে পৌঁছাতে পারত না বা শুধুই গুণ্ডামি করে তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর দিতে পারত না তারা। সুতরাং বাঙালি আধুনিক প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, সুতরাং বিজেপির রাজনীতি এখানে বেশিদিন চলবে না — এরকম নিশ্চিন্ত আত্মশ্লাঘায় ঘুমিয়ে থাকার দিন আর নেই।
ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না, সক্রিয়ভাবে সৃজনশীলভাবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের মহান ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ করতে হবে। চন্ডীদাস-চৈতন্য থেকে লালন-মুকুন্দ দাস হয়ে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত এবং গদ্যে ও পদ্যে তাঁদের অসংখ্য উত্তরসাধকের কথাগুলো আমরা ছড়িয়ে দেব, নিজেরাও যুক্ত হব সেই সৃজনে। তুলে ধরব তেভাগা- নকশালবাড়ির ঐতিহ্য, বামপন্থার—বিশেষত: মরণজয়ী বিপ্লবী বামপন্থার উত্তরাধিকার; সেই স্পিরিটকে মূর্ত করে তুলব আজকের শ্রেণীসংগ্রামে, আজকের রাজনৈতিক আন্দোলনে, এভাবেই আমরা দুই শাসকের কামড়া কামড়ির বিরোধিতায় এক স্বাধীন বাম ও গণতান্ত্রিক পরিসর গড়ে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখব। আমাদের সমস্ত পত্র-পত্রিকা নিজ নিজ ক্ষেত্রে এই কাজ করে চলবে। সম্প্রতি শঙ্খ ঘোষ, অর্পণা সেন, সুকান্ত চৌধুরী প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা পশ্চিমবঙ্গে শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সৌর্হদ্য ফিরিয়ে আনার জন্য যে বার্তা দিয়েছেন ও নাগরিক সভার উদ্যোগ নিয়েছেন তাকেও আমরা স্বাগত জানাই। এই রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকেই আগামী ৩০ জুলাই কলকাতার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সংহতি ও প্রতিরোধ কনভেনশন। প্রতিরোধ ফ্যাসিবাদের, সংহতি সমস্ত মানুষের। সাম্প্রদায়িক বা প্রাদেশিক বিভাজন নয়, বিদ্বেষ ও হিংসা নয়, শান্তি-সম্প্রীতি-গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক নৈতিকতার পথে এগিয়ে চলার কর্মসূচী নেবে, মাইলফলক হয়ে উঠবে প্রকৃতই গণচরিত্রের এই কনভেনশন।