ফ্যাসিবাদ প্রেরণা সংগ্রহ করেছে এক উন্মাদ জার্মান দার্শনিক ফ্রেডারিক উইলহেলম নীৎশে (১৮৪৪-১৯০০) থেকে। এর দর্শন হল আধিবিদ্যক ভাববাদ। নান্দনিক দিক থেকে এতে রয়েছে অত্যুচ্চ মাত্রার রোমান্তিকতাবাদ। রাজনৈতিক দিক থেকে, অভিজাততন্ত্রের প্রতিবিপ্লবী মৌলবাদ, “অতিমানব’’ তৈরি করার জন্য মানবিকতা ও গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত। এর “মাহাত্ম্য’’ বুঝতে হয় প্রচলিত মূল্যমানকে জলাঞ্জলি দিয়ে নতুন এক মূল্যমানের ভিত্তিতে। ‘‘অন্তর্দৃষ্টি’’ লাগে তার জন্য।
উদারনীতি সৃষ্ট আধুনিক গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুত সমতা-সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিদিনই সৃষ্টি করে চলেছে লজ্জাকর এক গগনচুম্বী বৈষম্যের। তাই এটা একটা “ভেক” মাত্র। নীৎশেবাদ মনে করে ধর্ম ও সমাজতন্ত্র উভয়েরই যে লক্ষ্য “হতদরিদ্র ও বঞ্চিত-লাঞ্ছিতদের মুক্তি’’ তা হল এক “আদর্শবাদী কাপুরুষতা”। ধর্মেমুক্তি পরলোকে। সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে তা ইহলোকেই, কিন্তু “সমতার” দিকে লক্ষ্য রাখতে গিয়ে “অতিমানব’’ সৃষ্টি বিঘ্নিত হয়। সেটা হল “ভীরুতা, নারীবাদ, পশ্চাদপদতা’’। তাই সাহসী, বীর্যবান, পুরুষ, পরম সুন্দর, যোদ্ধা, অত্যুৎকৃষ্ট মানুষ যেখানে দুর্বলকে ছেঁটে ফেলে স্বরকে শ্রেষ্ঠতার উচ্চতম শিখরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব, এই পৃথিবীতেই, ইহলোকেই। ‘‘মহামানব হচ্ছে মানুষের ঘনীভূত কালো মেঘ থেকে নির্গত বিদ্যুত।”
ধর্মে পরলোকে মুক্তির মুক্তিদাতা অতিজাগতিক পরমেশ্বর। কমিউনিজমে মুক্তি ইহলোকেই। অতিমানব বা অতিজাগতিক কোনো পরমেশ্বর নয়, শোষিত মানুষ নিজেই মুক্তি আনে নিজের, সমাজের ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতায়, সাম্যবাদী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে। কিন্তু নীৎশেবাদ বর্তমান অবস্থার থেকে মানুষের মুক্তি আনার প্রতিশ্রুতি দেয় মানুষের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে। মার্কসবাদ বস্তুগত পরিবর্তন মারফত মানসিক বা মূল্যবোধ পরিবর্তনে বিশ্বাস করে। উল্টোভাবে নয়। নীৎশেবাদ একটা মননজাগতিক অবস্থা ও পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে চায় যাতে বাস্তব জগতের পরিবর্তনকে এড়িয়ে যাওয়া যায় ঘনীভূত এক ভাববাদের প্রয়োগে। ধর্মের সাথে এখানে তার মিল রয়েছে। এর নেশা আফিমের চেয়েও প্রবল। নীৎশের নিজের চোখে আদর্শ পুরুষ হলেন একজন ধর্মগুরু, প্রাচীনকালের পার্শী মহাপুরুষ জরথুষ্ট্র। তাঁরই মুখে সম্পূর্ণনিজের কথা বসিয়ে সবাইকে হতভম্ব করে প্রকাশ করলেন কাল্পনিক এক রচনা যা জরথুষ্ট্র কোনো দিনও বলেননি।
“তোমরা কি মনে কর একটি আদর্শই কেবল যুদ্ধকে মহিমান্বিত করতে পারে? আমি কিন্তু তোমাদের বলছি যে কোনো আদর্শকেই যুদ্ধ করে মহিমান্বিত।”
“দাসদের গৌরবের বস্তু হচ্ছে বিদ্রোহ। তোমার গৌরবের বস্তু বশ্যতা।
“সাহসী হওয়াই একমাত্র কল্যাণ।”
অভিজাততন্ত্রের কাছে “যুদ্ধ” হল শিকার জাতীয় একটি ক্রীড়া। সৈন্যদেরকে সেখানে শিকারী কুকুর হিসাবে দেখা হয়। প্রভুভক্ত শিকারী পশু শিকারের জন্য নিজের জীবনকেও তুচ্ছ করে প্রভুর সাথে ক্রীড়ামোদ উপভোগ করে। যুক্তিহীনতা ও অন্ধত্ব ব্যাপক মানুষকে যে এইভাবে একটা দিবাস্বপ্নে বিভোর উন্মাদনার মনোজগতে পৌছে দেওয়া সম্ভব, নীৎশে তা সর্বাগ্রে ভাবতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে জার্মানির নাৎসীরা তাঁর আদর্শকেই আত্মীকরণ করে ফেলে। আমাদের দেশের ফ্যাসিবাদের প্রবক্তারা নীৎশেবাদের সঙ্গে দেশের মধ্যেই শ্রেষ্ঠতাবাদী (এলিটিস্ট) মতবাদ হিসাবে পেয়ে যায় একেবারে হাতেগরম “ব্রাহ্মণ্যবাদ’’কে। এখানে “জয় শ্রীরাম’’ ধ্বনি মানে আসলে জয় অতিমানব। আজকের দিনে তা মোটাদাগে তা হল “মোদির জয়’’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর “শীতল যুদ্ধের’’ শেষাংশে আরও একটি প্রভাবশালী মতবাদ “উত্তর আধুনিকতাবাদ’’ আহরণ করেছে নীৎশেবাদ থেকে, নৈরাজ্যবাদী কায়দায়। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের শেকড় যে সমাজে যত গভীরে প্রোথিত ফ্যাসিবাদের কাছে তা ততই প্রতিকুল। ওই ধরনের সমাজগুলোতে এককেন্দ্রীক বিশ্ব গড়ার প্রয়োজনে উত্তর-আধুনিকতাবাদী মতাদর্শগেলানোর বহু প্রচেষ্টা চলেছে। তেমন সাফল্য না আসায় নীৎশেবাদ এবার আসছে সরাসরি ফ্যাসিবাদের রূপ নিয়েই গোটা বিশ্বজুড়ে। ভারতে ফ্যাসিবাদের আগমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
বিষয়টি যখন মতাদর্শের, তখন মেহনতি মানুষের মুক্তির মতাদর্শ হিসেবে কমিউনিজম তথা মার্কসবাদকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরাই হল সফল প্রতিরোধের প্রথম শর্ত। তবেই রোখা যাবে মানববিধ্বংসী এই ঝুঁকিকে।