নজীরবিহীন ওলোট-পালোট

সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ঝড় বাংলায় এমনভাবে আছড়ে পড়ল যার ফলে নজীরবিহীন ওলোট-পালোট ঘটে গেল এরাজ্যের এতদিনকার সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফলের ইতিহাসে। আবহাওয়ায় অশনিসংকেত ছিল বিজেপি এবার উত্তর-পশ্চিম ভারতের সম্ভাব্য বিপর্যয় সামাল দিতে বাংলায় ড্যামেজ কন্ট্রোলের সুযোগ খুঁজছে এবং ফায়দা পেতে চলেছে। কিন্তু এতটা পূর্বানুমান বোধহয় প্রতিপক্ষ দলগুলো থেকে শুরু করে আমজনতার কোন অংশের কল্পনায় ছিল না যে, এমন ঘোর দক্ষিণপন্থার ঝড় আসছে, ফ্যাসিস্ত বিজেপির ঝড়। বিজেপি অবশ্য বুঝতে ভুল করেনি। ফলাফলে বোঝা গেল বাকি ভারতে, বিশেষত তার গড়গুলোতে, কোনো ড্যামেজের মুখে পড়তে হল না, বরং জয় জয়কার রায়। আর বাংলায় ফল মিলল মোটা বোনাস পাওয়ার মতোই। এখন এখানে হাটে-মাঠে-ঘাটে কেন্দ্রীয় চর্চার বিষয় হল বিজেপির বাড়বৃদ্ধির রহস্য। এক দীর্ঘ সময় যাবত প্রথাগত বামফ্রন্ট, বিশেষত সিপিআই(এম) ছিল চর্চার যে শীর্ষাসনে, পরবর্তীতে যা আত্মসাৎ করে তৃণমূল, সেই জায়গার দখল নিচ্ছে এখন বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গ যেন বিরোধী রাজনীতিতে প্রধানত এক উদারতাবাদী বাম প্রভাব থেকে একেবারে সম্পূর্ণ বিপরীতে চরম দক্ষিণপন্থার বৃত্তমুখী। সংগ্রামী বামপন্থার ধারার একটা প্রতিরোধের প্রয়াস জারী আছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এখনও যথেষ্ট সবল নয়।

বিজেপির আসন সংখ্যা ও ভোট শতাংশ দুটোই বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। গত লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া ২টি মাত্র আসন থেকে এবার ঝুলিতে এসেছে ১৮টি আসন। ভোট গত বিধানসভা নির্বাচনে ১০ শতাংশে নেমে যাওয়ার তুলনায় এবার পৌঁছেছে ৪০ শতাংশে। বৃদ্ধি ঘটেছে ৩০ শতাংশ। লোকসভায় বাংলা থেকে পাওয়া আসন সংখ্যার বিচারে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের থেকে মাত্র ৪টি কম। ভোট শতাংশে পিছিয়ে মাত্র ৩ শতাংশ।

অন্যদিকে তৃণমূলের গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এবার ভোট কমেছে ২ শতাংশ। বিধানসভার ৮টি উপনির্বাচনে বিজেপি পেল ৪টি আসন ও ৪০ শতাংশের ওপর ভোট। তৃণমূল পেল ৩টি আসন ও ৩৭ শতাংশ ভোট। বাকি ১টি পেল কংগ্রেস।

সবেতেই এগিয়ে বিজেপি। গ্রামীণ ক্ষেত্রে ২৭টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে বিজেপি এগিয়ে গেছে ১৫টিতে, অর্থাৎ মোট ৯০ থেকে ১০০-র মতন বিধানসভা এলাকায় এগিয়ে। এরাজ্যে তার এই বিপুল সাফল্য পেয়ে যাওয়ার পেছনে সাম্প্রদায়িক লাইনে প্রচার থেকে শুরু করে, টাকার খেলা, মোদীর ‘সবকা বিকাশের’ মাহাত্ম প্রচারের মায়ার খেলা, পুলওয়ামার সহানুভূতি কুড়ানো এবং তার বালাকোটের মতো বদলা নিতে পারে এমন শক্তিকেই কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসানোর আবেগ তোলা, এরকম অনেককিছুই কাজ দিয়েছে। তবে মনে হয় এক বড় মওকা পেয়ে গেছে মানুষের গণতন্ত্র দমন ও সরকারি প্রকল্প রূপায়ণে যথেচ্ছ দুর্নীতিতে অধঃপতিত হয়ে তৃণমূল শাসন জনতার নজরে স্বৈরাচার গণ্য হয়ে যাওয়ায়। ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে প্রত্যাঘাত হানার প্রধান লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় করা ছিল অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। বিজেপির দেশজোড়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রচারও হয়েছে তীব্র ও ব্যাপক। কিন্তু এখানে ওরা সারা ভারতে ধিক্কৃত হওয়ার প্রতিক্রিয়া সুপরিকল্পিতভাবে এড়িয়ে গেছে। তার বদলে ভেক ধরে এখানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের। সাধারণ মানুষের গড় চেতনার পক্ষে ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের মধ্যেকার ফারাক করে ওঠা খুব কঠিন। বিজেপির গণতন্ত্র ফেরানোর ‘জুমলাবাজী’র স্বরূপ গড় পশ্চাদপদ চেতনায় থাকা জনতার কাছে তেমন ধরা পড়েনি। বরং বাস্তবে স্বৈরাচারী তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্রোধ মেটাতে প্রভাবিত হয়েছে ফ্যাসিবাদী বিজেপির হাতছানিতে। তৃণমূলও ময়দানি এক জমকালো সারা ভারত বিরোধী সমন্বয়ের মঞ্চ প্রদর্শন করা ছাড়া জনমনের মধ্যে বিজেপিকে ঠেকানোর কার্যকরি পৃথকত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। টক্কর দিতে গিয়ে বিজেপির কট্টর হিন্দুত্বের প্রচারের চাপের মুখে তৃণমূল সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের তাস খেলতে গেছে, ফলত বরাবর প্রধানত নরম হিন্দুত্বকেই তুরূপের তাস হিসেবে খেলেছে। শেষমেশ এই ফাটকা খেলায় হেরেছে। তৃণমূলী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনরোষের ইস্যুগুলোতে বিজেপি মানুষের মাঝে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে বিদ্যুৎগতিতে। তৃণমূল মুখ্যমন্ত্রী তার আঁচ পেলেও জনতার কাছে প্রকাশ্যে তার সরকারের দমনতন্ত্র ও দলের দলতন্ত্র নিয়ে ত্রুটি স্বীকার করেননি। ক্ষমতা ও দুর্নীতিজনিত অগুণতি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও খুনোখুনির পরিণাম এক উল্লেখযোগ্য অংশকে বহিরঙ্গে জোড়াফুল অন্তরঙ্গে পদ্মে পরিণত করে দেয়। ফলাফলে তারও মালুম পেল তৃণমূল, আর হাসল বিজেপি। জঙ্গলমহলে হাসছে এখন ওরা। গ্রামীণ যে ১৫টি লোকসভা আসনের দখল পেল গেরুয়া পার্টি, সেসব পেয়েছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে থাকা রাশি রাশি ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে। প্রকল্প-দুর্নীতি, বিরোধীদলের হাতে থাকা ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ক্ষমতাকে পেশীশক্তির জোরে দখল করা এবং গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে মনোনয়ন লুঠ, ভোট লুঠ, গণনা লুঠ চালানোর মাশুল গুণতে হল এবার।

প্রথাগত বামফ্রন্ট পর্যবসিত হল অভূতপূর্ব কল্পনাতীত করুণ অবস্থায়। বাংলা থেকে কোনো সাংসদ যাওয়ার রইল না। বোধহয় অধিকাংশেরই জামানত গেল। ভোট শতাংশে উপর্যুপরি ধস। নেমে গেছে ৭/৮ শতাংশে। একথা আর গোপন করার উপায় নেই, লজ্জা লুকোনোর উপায় নেই, আরেকবার ভাবের ঘরে চুরি করারও উপায় নেই। বাম ভোট গেছে দলে দলে রামপন্থীদের ঘরে। বাম চেতনায় দূষণ ছড়িয়েছে বহুকাল যাবত। ক্ষমতা থেকে বামফ্রন্টের পতনের পরেও প্রায় এক দশক হতে চলল, নেতৃত্বের চিন্তা-চেতনায় প্রকৃত শুদ্ধির কোন সদিচ্ছাই প্রতিভাত নয়। নেতৃত্ব যদি সংগ্রামী বামপন্থার ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য অবস্থান নিয়ে সেই পথে অবিচল হওয়ার বদলে ‘বাস্তববাদী’ হওয়ার নামে কখনও বাম-কংগ্রেস সুবিধাবাদী জোট পলিসিতে বা কখনও ভোটসর্বস্ব সংকীর্ণতায় দুলতে-ঢলতে থাকে তাহলে বাম ভোটারদের মধ্যে নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ-প্রভাব আর থাকে না। এভাবেই অগুণতি বাম ভোট এবার রামমুখী হল। একে আবার বামমুখী করা মোটেই সহজ নয়। সেটা করতে হলে নেতৃত্বকে অনেক অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

বিজেপি বাংলায় বিস্তারের গন্ধ-বর্ণ-স্বাদ পেয়ে আরও আক্রমণাত্মক হবে সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই তার সংকেতগুলো দিতে শুরু করেছে। তাই সংসদীয় নির্বাচনের লড়াই শেষ হলেও হয়ত অনতিবিলম্বেই নামতে হবে সড়কের লড়াইয়ে। দেখা যাক পুনরায় ক্ষমতায় আসা মোদী সরকার কেমন যাত্রা শুরু করে, আর বিজেপি কেমন রূপ ধারণ করে। তৃণমূলের দমনতন্ত্র, ডোল অর্থনীতি-রাজনীতি ও দলতন্ত্রের প্রতিও জারী রাখতে হবে অতন্দ্র নজরদারী, থাকতে হবে প্রতিরোধের প্রস্তুতি।

খণ্ড-26