দ্বিতীয় দফার মোদি সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে বেচে খাওয়ার ষড়যন্ত্র

সরকারি তথ্য নিয়ে গন্ডগোল অনেকদিন ধরেই চলছে। নির্বাচনের সময়ে দেশের নামকরা অর্থনীতিবিদেরা, দেশে বিদেশে কর্মরত, সরকারি তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরিসংখ্যান কমিশনের সদস্যরা পদত্যাগ করেছিলেন। সেই সব প্রোথিতযশা অর্থনীতিবিদদের বিরুদ্ধে চার্টার্ড একাউন্টান্টদের খাড়া করেছিল সঙ্ঘ পরিবার। যদিও ন্যাশনাল একাউন্টস ব্যবস্থা, যা জাতীয় আয় পরিমাপে ব্যবহৃত হয় সে সম্পর্কে তেমন কোনো প্রশিক্ষণ চার্টার্ড একাউন্টান্টরা পান না। একজন অর্থনীতিবিদ রসিকতা করে বলেছিলেন, ন্যাশনাল একাউন্টসে একাউন্টস শব্দটা দেখেই বোধহয় চার্টার্ড একাউন্টান্টরা মনে করেছেন ওটি তাদের বিষয়। যাই হোক, এপর্যন্ত ঠিকই ছিল। সরকার অপছন্দের তথ্য সামনে আসতে দিচ্ছিলেন না, জাতীয় নমুনা সমীক্ষার কর্মসংস্থান সংক্রান্ত তথ্যকে নির্বাচনের আগে গায়েব করে দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনের আগে জানা গিয়েছিল যে, ভারতীয় অর্থনীতিতে গত ৪৫ বছরের মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ বেকারি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু তাকে সরকার মানেননি। এমনকি বেসরকারি সিএমআইই পরিসংখ্যানও অনুরূপ কর্মহীনতার চিত্র সামনে আনছিল। কিন্তু তাকে পাত্তা দেওয়া হয়নি। আমরা এর আগেও লিখেছি যে, জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন যে তথ্য ২০১৮ সালে উপস্থাপন করেছিল তাতে আগের ইউপিএ জমানার গড় বৃদ্ধি বর্তমান এনডিএ জমানার গড় বৃদ্ধির থেকে বেশি ছিল। সেই পরিসংখ্যানকে উড়িয়ে দিয়ে নীতি আয়োগ পরিসংখ্যান তৈরি করে বর্তমান জমানার গড় বৃদ্ধি আগের থেকে বেশি এটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সরকারি স্তরে। ফলে পরিসংখ্যান নিয়ে তর্কবিতর্ক মোটামুটি প্রথাসিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নির্বাচনে বিপুল জয়ের পরে পরেই নীতি আয়োগের কার্যকরী প্রধান জানিয়ে দিলেন যে, সরকারের প্রথম ১০০ দিনের কর্মসূচীতে আছে বিপুল মাত্রার অর্থনৈতিক সংস্কার, যার মধ্যে প্রধান হল ৪২টি রাষ্ট্রায়ত্ব উদ্যোগকে হয় বন্ধ করে দেওয়া হবে নয়তো বিক্রি করে দেওয়া হবে। ফলে ক্রমাগত রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র ধারণাটিকেই ভারত থেকে লুপ্ত করে দেওয়ার দিকে এগোচ্ছে মোদি সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণের এই পর্যায়ে এয়ার ইন্ডিয়াকে বেসরকারিকরণের দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন নীতি আয়োগের উপাধ্যক্ষ রাজিব কুমার। কেবল তাই নয়, তিনি জানিয়েছেন যে, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য খুশির খবর আছে, কেননা তাদের জন্য সহজে জমি দেওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে, এমনকি এয়ার ইন্ডিয়া ক্রয়ে যাতে তারা অংশগ্রহণ করতে পারে তার জন্য বিদেশী বিনিয়োগের শর্তকেও সরল করা হবে। খালি এটুকুই নয় বিনিয়োগের সুবিধার্থে শ্রম আইনকেও সরল করা হবে (পড়ুন, শ্রমিকদের ছাঁটাই করা সহজ করা হবে)। মনে রাখা দরকার, সারা পৃথিবীর আইন সমূহকে এ্যাংলো-স্যাক্সন আইনের অনুরূপ করার জন্য একটি চাপ আমেরিকার তরফ থেকে বহুদিন ধরেই বর্তমান। সব মিলিয়ে বিদেশীদের জন্য দেশকে উন্মুক্ত করার কর্মসূচী মনে হচ্ছে সরকারের প্রথম ১০০ দিনের বিশাল অর্থনৈতিক ধাক্কার মুখ্য দিক।

এদিকে রাজিববাবু যখন ১০০ দিনের উন্মুক্তায়নের ভাবনায় আমোদিত, তখনই দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধির হারের মন্থরতা সামনে এসে পড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থনীতির চতুর্থ ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধির হার মোদি সরকারের আমলে সর্বনিম্ন স্তরে দাঁড়িয়েছে। কেবল তাই নয়, কয়েকদিনের মধ্যেই স্বয়ং মোদি সরকারের কয়েকদিন আগে প্রাক্তন হওয়া মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, অরবিন্দ সুব্রমনিয়াম, যিনি নাকি নাতির দেখভাল করার জন্য দায়িত্বত্যাগ করেছিলেন, একটি গবেষণাপত্র হার্ভার্ডে প্রকাশ করেছেন যেখানে তিনি জানিয়েছেন যে, ২০১১-১২সাল থেকে যে মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে ভুল আছে। মূলত, তা অনেকটাই বাড়তি দেখানো হয়েছে। সঠিক হিসেব হলে ওই সময় থেকে গড় বৃদ্ধির হার বার্ষিক ৭ শতাংশের পরিবর্তে, ২.৫% কমে, বার্ষিক ৪.৫%-এ দাঁড়াত। ইতিপূর্বে গতমাসে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা জানিয়েছিল কোম্পানি সংক্রান্ত মন্ত্রকের পরিষেবা ক্ষেত্রের সংস্থা সংক্রান্ত যে তথ্য জিডিপি পরিমাপে ব্যবহৃত হয়েছিল তার বিপুল অংশ, প্রায় ৩৯ শতাংশ, সমীক্ষা বহির্ভুত, যাদের অস্তিত্ব নেই। ফলে জিডিপি তথ্য যথাযথ নয়। আগেকার বিবিধ তথ্যকে সরকার ও বিজেপি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে খারিজ করলেও, প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার গবেষণাকে অনুরূপ ভাবে বাতিল করে দেওয়া মুস্কিল। তাই ওনার পরিমাপ যে ভুল ধারণার উপরে ভিত্তি করে করা হয়েছে সেটি প্রতিষ্ঠিত করতে সরকারি দফতর সচেষ্ট হয়েছে।

সব মিলিয়ে ভারতীয় অর্থনীতির হাল সুবিধের নয়। তাকে সামলানোর জন্য রাজিববাবুরা পুলটিশ দিতে চাইছেন। তবে তার ভার শ্রমিক কৃষককেই বইতে হবে। রাজিব কুমারের পূর্ববর্তী নীতি আয়োগের উপাধ্যক্ষ অরবিন্দ পানাগাড়িয়া তো বলেছেন, এনএসএসও তথ্য যেমন ৬৫% বেকার বলছে তেমনি তাতো ৯৪% কাজ করছেও বলছে। এনএসএসও তথ্য যে সাপ্তাহিক স্তরে বেকার বলতে দিনে এক ঘণ্টাও কাজ না করা লোককেই ধরে সে কথা তিনি বলছেন না। সেই পানাগাড়িয়াই বলেছেন, অর্তনীতিতে গতি আনতে প্রতি সপ্তাহে একটি করে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের সংস্থাকে বেসরকারিকরণ করা হোক। ওই বেসরকারিকরণই এই সরকারের মূল লক্ষ্য। মনে রাখা দরকার, গত ৫ বছরে এই সরকার কেবল রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাকে বা তার শেয়ার বিক্রি করে বছরে গড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করেছে, মনমোহন সিং-এর ইউপিএ সরকারের তা ছিল বছরে গড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। ফলে সরকারের রাজস্ব ঘাটতিকে কম দেখানোর অন্যতম অস্ত্র হচ্ছে, নেহরু -ইন্দিরা জমানায় তৈরি হওয়া বা রাষ্ট্রায়ত্ব হওয়া সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ। তাতে আরো গতি সঞ্চার করে আরো টাকা আদায়ই এই সরকারের উদ্দেশ্য। ধনীকে আরো ধনী, গরিবকে গরিবতর ও সরকারি ক্ষেত্রকে গোল্লায় পাঠানোই এই সরকারের অভীপ্সা।

খণ্ড-26
সংখ্যা-18