প্রশ্ন : ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধির ওপর নাথুরাম বিনায়ক গডসের শেষ এবং সফল আক্রমণের আগে তাঁর ওপর চালানো হত্যার অন্য অসফল প্রচেষ্টাগুলো সম্পর্কে বলুন।
উত্তর : ভারতে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণনেতা হয়ে ওঠার পর, বিশেষভাবে ১৯৩০-এর দশক থেকে, তাঁকে হত্যার সুপরিকল্পিত ও সংগঠিত প্রয়াস চলে এবং এই প্রচেষ্টাগুলি চালায় হিন্দুমহাসভা এবং আরএসএস-এর মতো অন্ধ উন্মত্ত হিন্দুগোষ্ঠীগুলোর সক্রিয় সদস্যরা। অতএব দেখা যাচ্ছে, ঐ সময় থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণার এক সুপরিকল্পিত প্রচার চলতে থাকে।
প্রশ্ন : ১৯৩০-এর দশকেই কেন ঐ প্রচেষ্টাগুলো সামনে এল?
উত্তর : এটাই হল মূল প্রশ্ন। ওদের ধারণা অনুযায়ী তাঁর মুসলিম প্রীতির জন্য — যা হিন্দু ভারত হওয়ার আশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে — বিদ্বেষ জনিত উন্মাদনার বশে এই হত্যাকাণ্ড (গান্ধির) যদি সংঘটিত হয়ে থাকে, তাহলে এর অনেক আগে ১৯৩৪ সালেই তাঁকে হত্যার চেষ্টা হল কেন, যখন এমনকি মহম্মদ আলি জিন্নাও পাকিস্তানের দাবি তোলেননি? তখন ভারত ভাগের কথা একমাত্র বলেছিলেন সাভারকার। খেয়াল করুন, এই সময়ে গান্ধি অস্পৃশ্যদের উন্নয়নের জন্য এবং তাদের বিরুদ্ধে চলা নিপীড়নগুলোকে কমিয়ে আনার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছিলেন। লবন সত্যাগ্রহের পর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকেই তিনি সর্বত্র গিয়ে হরিজনদের মন্দিরে প্রবেশের এবং গ্রামের কুয়োগুলি থেকে জল নেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় ছিলেন।
প্রশ্ন : তাহলে, গান্ধির এই সমস্ত কাজের জন্যই কি হিন্দু ধর্মীয় উন্মাদরা তাঁর ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছিল?
উত্তর : তাঁকে হত্যার ব্যর্থচেষ্টাগুলির সংযোগ সূত্রের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, এই চেষ্টাগুলো পুনেতেই হয়েছিল, আর সেগুলোর মধ্যে এই অঞ্চলের ব্রাহ্মণরা যুক্ত ছিল। গান্ধিকে হত্যার যে সাতটা চেষ্টা হয়েছিল তার মধ্যে পাঁচটাতেই জড়িত ছিল হিন্দুমহাসভার পুনে শাখা। এই পাঁচটার মধ্যে আবার তিনটেতেই জড়িত ছিল নারায়ণ আপ্তে এবং নাথুরাম গডসে (মহাত্মার হত্যায় তাদের ভূমিকার জন্য ১৯৪৯ সালে উভয়েরই আম্বালায় ফাঁসি হয়)। ১৯৩৪ সালে ওরা কাউকে মারতে পারেনি, কেননা, হ্যাণ্ড গ্রেনেডগুলো পুনেতে ছোঁড়া হয় একটা গাড়ির ওপর, একটা নাগরিক সম্মান নেওয়ার জন্য যে গাড়িটার তাঁকে কর্পোরেশন অডিটোরিয়ামে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এই ঘটনা ঘটে ১৯৩৪ সালের ২৫ জুন।
গান্ধি হত্যা মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত বিষ্ণু কারকারে এই অঞ্চলে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল, যে প্রায়ই মুসলিমদের ওপর আক্রমণ চালাতো। কাপুর কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, কারকারের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে যে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয় তাতে ১৯৩৪ সালে পুনেতে হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রের মিল ছিল। কারকারে ছিল নারায়ণ আপ্তের ঘনিষ্ঠ যার সঙ্গে আবার নাথুরাম গডসের ঘনিষ্ঠতা ছিল। আপ্তে এবং গডসে ছিল সাভারকারের বিশ্বস্ত সহকারী। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, গান্ধির ওপর প্রথম নথিবদ্ধ আক্রমণে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে (আপ্তে ও গডসে) সংযোগ ছিল। এটা কোন গোপন ব্যাপার নয় যে, গান্ধি হরিজনদের আত্তিকরণের প্রচার শুরু করা এবং তাদের অধিকারের জন্য কাজ করার পর থেকেই তিনি সনাতনি হিন্দুদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে ওঠেন।
প্রশ্ন : এর পরের আক্রমণটা কখন ঘটল?
উত্তর : নথিবদ্ধ থাকা এর পরের আক্রমণটা ঘটেছিল ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি আগা খান প্যালেস বন্দী শিবির থেকে মুক্তি পেয়ে ম্যালেরিয়ার আক্রমণ থেকে আরোগ্যলাভের সময়, বন্দী শিবিরে থাকার সময়ই তাঁর শরীরে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। ডাক্তারের পরামর্শেসে সময় তিনি পার্বত্য ভ্রমণকেন্দ্র পাঁচগণির দিলখুস বাংলোয় ছিলেন। ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে হিন্দু মহাসভা-আরএসএস-এর একদল স্বেচ্ছাসেবক পাঁচগণিতে গিয়ে বাপুর বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকেন। পরে তারা একটা স্কুলের প্রার্থনা সভার বাইরে জড়ো হয়, যেটাতে গান্ধি যোগ দিয়েছিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে এক যুবক হাতে ছোরা নিয়ে প্রার্থনা কক্ষে লাফিয়ে পড়ে বাপুর দিকে তেড়ে যায়। সেখানে একজন স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন সাতারার কুস্তিগির ভিলারে গুরুজি। তিনি এবং মনিশঙ্কর পুরোহিত — পুনেতে যাঁর একটা লজ ছিল — আক্রমণকারীকে ধরে ফেলেন, যে আক্রমণকারী ছিল নাথুরাম বিনায়ক গডসে।
ঐ বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে হয় আর একটা আক্রমণ, যখন গান্ধি জিন্নার সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভারত ভাগকে এড়াতে একটা সূত্রে পৌঁছানোর জন্য গান্ধির সঙ্গে জিন্নার সাক্ষাৎকে আটকানোর জন্য হিন্দু ধর্মীয় উন্মাদ দক্ষিণপন্থীরা অঙ্গীকার করে। নির্দিষ্ট দিনে জিন্নার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য গান্ধি যখন ট্রেনে চাপতে যাচ্ছিলেন, তাঁর গাড়ি গেটের কাছে পৌঁছালে হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের এক সদস্য গান্ধির দিকে ধেয়ে যায়। এবারও তাকে নিরস্ত্র করা হয় এবং তার কাছে একটা ছোরা পাওয়া যায়। অবিলম্বে পুলিশ পৌঁছায় এবং এই যুবকদের আটক করে। এই দলের মধ্যে ছিলেন নাথুরাম, আপ্তে ও দাত্তে। এই আক্রমণের পিছনে থাকা সংগঠনগুলো জানত যে, গান্ধি হত্যার সময় উপস্থিত হলে নাথুরাম শহীদ হবে। লক্ষ্য করার বিষয়, তখনও এক হত্যাকারীকে অত্যন্ত সংগঠিতভাবে তালিম দেওয়া হচ্ছিল।
প্রশ্ন : এর কয়েক বছর পর একটা ট্রেনকে লাইনচ্যুত করে গান্ধি হত্যার চেষ্টা কি হয়নি?
উত্তর : হ্যাঁ, আমার লেখা ‘আসুন আমরা গান্ধিকে হত্যা করি’ নামে বইয়ে এসব কিছু বিশদে বলা আছে। ১৯৪৬ সালের ২৯ জুন গান্ধিজি ট্রেনে করে পুনে যাচ্ছিলেন। ঐ ট্রেনটাতে একটা তৃতীয় শ্রেণীর কামরা, গার্ডের কক্ষ ও ইঞ্জিন ছিল। ট্রেনটাকে সবাই ‘গান্ধি স্পেশাল’ নামে জানত। ট্রেনটাকে লাইনচ্যুত করার উদ্দেশে নেরুল ও কারজাট-এর মাঝে লাইনের ওপর বোল্ডার ফেলে রাখায় ট্রেনটা দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। ড্রাইভার তৎপরতার সঙ্গে ব্রেক কষে ইঞ্জিনটাকে যাত্রী কামরা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং গান্ধি সে যাত্রায় রক্ষা পান।
এরপর ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি ঘটে বোমা আক্রমণের সুপরিচিত ঘটনাটা যাতে ঘটনাস্থল থেকে মদনলাল পাহাওয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনার বিশেষত্ব ছিল যে, হিন্দুমহাসভা এবং আর এস এসএর মধ্যে থাকা সাভারকারপন্থীরা গান্ধিকে হত্যা করার জন্য এক আততায়ীকে দীর্ঘদিন ধরেই তালিম দিচ্ছিল।
প্রশ্ন : স্বাধীন ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী গডসে হিন্দুছিল বলে কামাল হাসান যে মন্তব্য করেছিল সে সম্পর্কে আপনার মত কি?
উত্তর : উপরে আমি যা বলেছি সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঐ মন্তব্য অত্যন্ত যথাযথ। বাপুকে হত্যা করার আগেই পুলিশ নাথুরামকে ‘‘রগচটা উগ্রপন্থী’’ বলে চিহ্নিত করেছিল। কমল হাসানের মন্তব্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
প্রশ্ন : গান্ধি হত্যা তদন্তে লক্ষণীয় ত্রুটিগুলো কি ছিল?
উত্তর : অনেক ত্রুটিই ছিল। ৯ মি:মি: বেরেট্টা পিস্তলটা, যেটা এম ১৯৩৪ নামে পরিচিত (ক্রমিক নং ৬০৬৮২৪), ইতালি থেকে আসে এবং সেটাই গান্ধি হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছিল। সে সময়ে এটাই ছিল আধুনিকতম পিস্তল। ১৯৩৪ সালে তৈরি হওয়া ঐ পিস্তলটা ইথিওপিয়া থেকে ভারতে নিয়ে আসে ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর গোয়ালিয়র রেজিমেন্টে কর্মরত এক কর্ণেল। ইতালির সেনাধ্যক্ষর দেওয়া স্মারক স্বরূপ পিস্তলটা তিনি গোয়ালিয়রে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে এই অফিসার গোয়ালিয়রের মহারাজার এডিসি হন। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, নাথুরাম গডসে যখন ঐ রিভলবারটা কেনার জন্য দত্তাত্রেয় এস পারচুরের (গান্ধি হত্যায় আর এক অভিযুক্ত) সঙ্গে ২৮ জানুয়ারি গোয়ালিয়র যান, এডিসি-র ঐ পিস্তলটা তখন ছিল জগদীশ প্রসাদ গোয়েল নামে গোয়ালিয়রের এক বন্দুক বিক্রেতার কাছে। গোয়ালিয়রের এডিসি-র হেফাজতে থাকা পিস্তলটা কিভাবে বন্দুক বিক্রেতার কাছে এবং তার কাছ থেকে আবার গডসের কাছে গেল, এ নিয়ে এখনও কোন তদন্ত হয়নি। সেটা নিয়ে তদন্ত হলে সাভারকারের ভূমিকা ফাঁস হয়ে যেত। যে নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে তিনি বন্দুক বিক্রেতার কাছে পৌঁছান, যিনি তাকে কাছ থেকে গুলি করার সে সময়ের সবচেয়ে কার্যকরী পিস্তলটা তাকে বিক্রি করেন, সেই নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়ার মত প্রভাবশালী গডসে ছিল না।