২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে চেন্নাই-এর তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) শিল্পের কর্মীরা গণ ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তাঁরা একটি বিক্ষোভ সমাবেশ করে ও কর্তৃপক্ষ ও কর্মীদের মধ্যে বোঝাপড়ার জন্য শ্রম কমিশনারের কাছে একটি আবেদন পেশ করেন। এই প্রতিবাদ আইটি কর্মীরা উচু হারে বেতন পায় বলে শ্রমিক সংগঠন করবে না বা সংগঠিত হবে না বলে যে ধারণা ছিল তাকে ভেঙে দেয়। এই উদ্যোগ পুনে, ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই, কলকাতা, হায়দ্রাবাদ, এবং ভুবনেশ্বরের মত অন্য শহর গুলিতেও বিস্তৃত হয়। উইপ্রো, সিটিএস, জেপি মর্গান, আইবিএম এবং অন্যান্য বৃহৎ ও মাঝারি মাপের সংস্থাগুলির আইটি ও আইটিইএস কর্মীদের ছাঁটাই সম্পর্কিত দাবিও পেশ করা হয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে কর্মীদের পুনর্নিযুক্তিও হয়। সব থেকে উল্লেখযোগ্য ও স্থায়ী সাফল্য অবশ্যই চেন্নাই ও ব্যাঙ্গালোরে বিভিন্ন আইটি কর্মী সংগঠনের সৃষ্টি হওয়া, যার ফলে পরবর্তীতে সরকারকে ওই সমস্ত শহরে আইটি ইউনিয়নের নিবন্ধিকরণ মেনে নিতে হয়।
ভারতে আইটি ও আইটিইএস ক্ষেত্রে সরাসরি নিযুক্ত কর্মী সংখ্যা ৪০ লক্ষ, পরোক্ষভাবে নিযুক্ত রয়েছে ১ কোটি কর্মী। এই হিসেবের মধ্যে হিসেব রক্ষক, নিরাপত্তা কর্মী, নির্মাণ কর্মী, এবং আইটি শিল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা অন্যন্য শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ধরা হয় নি। তাদের অধিকাংশই অস্থায়ী বা চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োজিত।
দেশের সামগ্রিক কর্মীবাহিনীর সাপেক্ষে ৪০ লক্ষ কর্মী খুব বেশী না হলেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই ৪০ লক্ষের একটি অংশ শুরু থেকেই চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োজিত। ২০০১ সালের তুলনায় কর্মীবাহিনী আইটি ও আইটিইএস ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে। নাসডাক কর্তৃক মে, ২০১৭ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০১ সালের ৪.৩ লক্ষ কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে ৩৮.৬ লক্ষ হয়েছে। ওই পরিসংখ্যান বলছে ২০১৭ সালে ৫৬ হাজার কর্মী ভারতে ছাঁটাই হয়েছে। বাস্তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পে ছাঁটাই মুনাফা বজায় রাখতে ও বাড়াতে একটি সাধারণ অস্ত্র এবং তা বিশ্বব্যাপী।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কর্মচ্যুতিতে মেইনফ্রেম ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার কারণে, আইবিএম ১৯৯৩ সালে ৬০ হাজার কর্মী, মূলত আমেরিকায় ছাঁটাই করেছিল। একই ধারায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ধ্বংসের পরে অর্থনৈতিক মন্দায় লক্ষ লক্ষ কর্মীকে বেআইনী ভাবে ছাঁটাই করা হয়, যার মধ্যে একটি বড় সংখ্যক ভারতে। ভারতীয় আইটি ও আইটিইএস ক্ষেত্র আমেরিকান ও ইউরোপীয় সংস্থার আউটসোর্সিং-এর উপর নির্ভর করে। এই ক্ষেত্রটি আমেরিকার তুলনায ৫-৬ ভাগ কম দামের সুবিধে প্রদান করে। এটিই ক্ষেত্রটির প্রাথমিক বৃদ্ধি ও নিয়োগের কারণ। ট্রাম্প পরিঘটনা এইচ-১বি ভিসা ছাঁটাই করে ভারতীয় আইটির সঙ্কটে ধুয়ো দিয়েছে। কিন্তুু সেটাই মূল কারণ নয়। ট্রাম্পের নীতির পরেও ভারতীয় আইটি ২০১৮-১৯ সালে ১৮,১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বিক্রি করেছে ও ৩৭০০ কোটি মার্কিণ ডলারের পরিষেবা রফতানি করেছে। তবুও গণ ছাঁটাই বা লে-অফ করা চলেছে।
১৫ মে-র ইকোনোমিক টাইমস অনুসারে, আইবিএম ভারতে ৩০০ সফটওয়্যার পরিষেবা কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। কর্তৃপক্ষ প্রদত্তকারণ নিম্নরূপ: আইবিএম ভারতের দফতরগুলিতে দক্ষতার পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে, এবং সংস্থা ক্লাউড, কৃত্রিম বোধ ও অন্যান্য ঘটনাবহুল ক্ষেত্রগুলিতে নতুন মেধা যুক্ত করতে চাইছে। ইকোনোমিক টাইমসের খবর অনুযায়ী ও কোগনিজ্যান্টের অভ্যন্তরীণ সূত্র অনুসারে, কোগনিজ্যান্টও আইবিএম-এর অনুরূপ কারণে কিছু কর্মীকে ছাঁটাই করার পরিকল্পনা করছে।
প্রতি বছর দক্ষতা মূল্যায়নের নামে বেশ কিছু অদক্ষ কর্মী ছাঁটাই করা হয়। কিন্তুু যখন গণ ছাঁটাই করা হয়, তখন কারণ থাকে সংস্থার আশানুরূপ স্তরের মুনাফা করতে ব্যর্থহওয়া বা লে অফের মাধ্যমে মুনাফা বাড়ানো। কর্মী বাহিনীর সঙ্কোচন সব থেকে সহজ পদ্ধতি কারণ মালিক ও কর্তৃপক্ষ জানে যে সরকার হস্তক্ষেপ করবে না বা সংস্থার পক্ষে দাঁড়াবে।
ভারতে বেশ কয়েকটা আইটি পার্ক আছে, এবং সরকার বৃহৎ আইটি পার্কগুলিকে এসইজেড হিসেবে ঘোষণা করেছে। বৃহৎ আইটি পার্কে প্রচুর খাবার, জিম (শরীরচর্চার বন্দোবস্ত) ইত্যাদির বন্দোবস্ত করা থাকে। যদি ম্যানুফাকচারিং বা পরিধেয় বস্ত্র শিল্পের শ্রমিকদের করুণ অবস্থার সঙ্গে তুলনা করি আইটি ক্ষেত্রের কর্মীরা অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে আছে। কিন্তুু এই সুন্দর ছবি কিছুতেই দু:খগুলিকে আড়াল করতে পারবে না—উঁচু বেতন সত্বেও আইটি কর্মীরা ভয়ানক কর্ম অনিশ্চয়তায় ভোগে। মুষ্টিমেয় কিছু কর্মী উচ্চতর কর্তৃপক্ষে পরিণত হয়, অধিকাংশই ১৫ বছর কাজের পরে এক স্থিতাবস্থায় পৌঁছে যায়। গত ২-৩ বছরের ছাঁটাই-এর অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৮-১৫ বছরের অভিজ্ঞ কর্মীরা ছাঁটাই-এর লক্ষ্যবস্তু হিসেবে থেকেছে। কাজ চলে যাওযার পরে ওইসব কর্মীরা তেমন কোনো কাজ খুঁজে পাবে তা প্রত্যাশার বাইরেই থাকে।
আইটিইএস-এ অবস্থা আরো নিদারুণ। বিপিও ক্ষেত্রের কর্মীরা আইটির তুলনায় অনেক কম বেতনে কাজে যোগদান করে এবং তাদের বেতন বৃদ্ধি খুবই ধীরে ঘটে (বিষয়টি আইটি ক্ষেত্রেও তেমনটাই)। একটি প্রখ্যাত বিপিও কনসেন্ট্রিক্স নবাগতদের ১১০০০ টাকা মাসিক বেতন দেয় আরেকটি স্বনামধন্য বিপিও এইচএসবিএ শুরুতে ১৫০০০ টাকা মাসিক বেতন প্রদান করে। ১৫-১৬ বছরের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা ও সাফল্যের ভিত্তিতে বেতন মাসিক ৫০০০০ টাকায় পৌঁছতে পারে ও তার পরে তেমন বাড়ে না। বিপিও-র কর্মীদের সাধারণত এজেন্ট বলা হয়। বিপিও কর্মীদের ৮০%-এর বেশী হল ২০-২৫ বছরের মধ্যে। কর্মীবাহিনীর ৪০-৫০% হল মহিলা (মূলত অবিবাহিত)। কর্মীরা সাধারণত ১০-১২ মাসের অবেক্ষাধীনে নিয়োজিত হয়। এর মধ্যে খুব কম সংখ্যককে নিয়মিত বা স্থায়ী করা হয়। সমীক্ষা করে দেখা গেছে বিপিও কর্মীদের ৩৮৫ অবেক্ষাধীন কর্মী বা প্রকল্প ভিত্তিক কর্মী। কেবল ৬২% স্থায়ী কর্মী। এছাড়াও, বিপিও কর্মীরা জাতীয় ছুটির দিনে বা উৎসবের দিনে কোন ছুটি পায় না। ছুটির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই কারণে অনেক সময়ই কর্মীরা পদত্যাগ করে। কর্মীরা সব সময়েই মানসিক চাপে থাকে। জানা দরকার যে, শিল্প শ্রমিক আইন আইটি ও আইটিইএস শিল্পে প্রযোজ্য নয়, এবং সমস্ত ধরণের সরকারগুলিই শিল্পপতিদের পক্ষ গ্রহণ করে থাকে।
পূর্বে উল্লেখিত নাসডাক নিবন্ধটি অনুমান করেছে যে, ডিজিটালাইজেশন, কৃত্রিম বোধ, ক্লাউড ইত্যাদি কারণে ২০২৫ সাল নাগাদ আইটি শিল্পে মোট নিয়োগের পরিমাণ ৭০ লক্ষে পৌঁছবে। সেই নিবন্ধই বলছে যে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। নাসডাকের হিসেব সম্ভবত বর্তমান কর্মীদের (৪০ লক্ষের মত) যাদের মধ্যে এক বৃহৎ অংশ আগামী ২ বছরে কর্মচ্যুত হবে, যা হিসেবে নেওয়া হয়নি। ডিজিটালাইজেশন, এআই, ক্লাউড ইত্যাদিতে বেশ কিছু চাকরি তৈরী হবে, তার মধ্যে মুষ্টিমেয় উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন হবে। আইটিইএস (বিপিও) ক্ষেত্রে কাজের অবস্থা একই রকম থাকবে এবং আইটি ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা আরো বাড়বে।
আমাদের বর্তমান সময়ের অর্থনীতি এরকমই। কর্মসংস্থানহীন বৃদ্ধি বাস্তবতা, কর্ম অনিশ্চয়তা প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। কিন্তুু কীভাবে সংগঠিত হব এবং সংগঠিত হওয়ার পথে বাধা কী কী?
কাজের অবস্থা ও কর্তৃপক্ষের আচরণ বিপিওতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদকে প্রশ্রয় দেয় এবং কর্মীদের ভিতরে যৌথ পারস্পরিকতা সৃষ্টিতে বাধা দেয়। কলের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ডস্ক্রিপ্টের পাশাপাশি এসিডি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কর্তৃপক্ষ কর্মীদের মধ্যে আলাপ আলোচনার কোনো সময়ই রাখে না। যে কোনো শিফটের প্রতি সেকেন্ড সময়ে প্রত্যেক ব্যক্তি কর্মী তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যস্ত থাকে কারণ বেতন ও অন্যান্য সুবিধে এবং কাজের নিরাপত্তা লক্ষ্য পূরণের উপর নির্ভর করে। পাঁচ পয়েন্ট রেটিং ব্যবস্থায় প্রত্যেক কর্মী একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতার বদলে একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বাধ্য হয়। তা ছাড়াও, ম্যানুফাকচারিং বা পরিধেয় সামগ্রীর শ্রমিকদের তুলনায় এই ক্ষেত্রের কর্মীরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসার, যাতায়াতের সুবন্দোবস্তের, সহকারি প্রবন্ধক বা প্রবন্ধকের গালভরা পদ পেয়ে নিজেদের কর্তৃপক্ষ হিসেবে ভাবার মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে (যদিও বেতন তেমন পায় না)। অন্যদিকে আইটি শিল্পের কর্মীরা তুলনামূলকভাবে মোটা বেতন পায়, এবং কিছুদিন আগেও আইটি কর্মীরা মনে করত তারাই প্রকৃত কর্তা যারা বিশ্বকে শাসন করছে। কিন্তুু গণ ছাঁটাই সেই চিত্রকে পাল্টে দিয়েছে, এবং অনেকেই সংগঠিত হওয়া ও লড়াই-এর তাগিদ অনুভব করছে। চেন্নাই ও ব্যাঙ্গালোরে লড়াইয়ের মাধ্যমে ইউনিয়নের নিবন্ধীকরণ সে কথার প্রমাণ।
ভারতীয় আইটি শিল্প ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট স্ট্যান্ডিং অর্ডার আইন, ১৯৪৬ এর থেকে ছাড় প্রাপ্ত, যার মানে কারখানা শ্রমিকদের মতো মালিক শ্রমিক বিরোধ শ্রম আইনের আওতায় নিষ্পত্তি হত না। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার শ্রম আইনকে অধিকতর মালিকের পক্ষে সংশোধন করছে। আইটি ও আইটিইএস ক্ষেত্রে তাই গণ ছাঁটাই ও বেতন হ্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী লড়াইএর জন্য আইটি এবং আইটিইএস ক্ষেত্রে শক্তিশালী ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা আছে। এই ক্ষেত্রের ইউনিয়নগুলি নিম্নলিখিত দাবী উত্থাপন করছে:
১. ন্যুনতম মজুরি বৃদ্ধি করার দাবি যা আইটিতে চুক্তি কর্মী ও আইটিইএস-এর কর্মীদের পক্ষে লাভজনক
২. চুক্তিভিত্তিক কাজের বদলে সব কাজকে স্থায়ীকরণ
৩. আইন বহির্ভূতভাবে কোনো ছাঁটাই বা বাধ্যতামূলক চাকুরি ছেদ ঘটানো যাবে না
৪. আইটি ও আইটিইএস ক্ষেত্রে ইউনিয়নের নিবন্ধীকরণকে মানতে হবে
৫. আইটি সেক্টরকে শিল্প ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট স্ট্যান্ডিং অর্ডার আইন, ১৯৪৬-এর থেকে ছাড় বন্ধ করতে হবে এবং সেই আইনকে মেনে চলতে হবে
৬. আইটি এবং আইটিইএস ক্ষেত্রে শ্রম আইন বলবৎ করতে হবে
(লিবারেশন জুন ‘১৯ সংখ্যা থেকে)