প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির মোচ্ছব চলছে, ঠগ বাছতে গেলে উজার হবে দল। প্রসঙ্গত উঠে এসেছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের ব্যবচ্ছেদের প্রশ্ন। নির্দেশের বার্তা দিলেন দলনেত্রী। কাটমানি নেওয়া বা তোলাবাজি চলবে না, উৎকোচ নেওয়া বা ঘুষ খাওয়া চলবে না, যা কিছু নেওয়া- খাওয়া হয়েছে সব টাকা ফেরত দিতে হবে! বিস্ময়ে ঘোর লাগা স্বাভাবিক। একি শুনি দলনেত্রীর মুখে! এর আগে যখনই সরকারি-আধা সরকারি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রকল্পজনিত দুর্নীতির আঁতাতের অভিযোগ উঠেছে, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে অভিযোগকে নস্যাৎ করা হয়েছে। অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার নাটক করতে সবার আগে মুখ খুলেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী। কখনও ত্রিস্তর পঞ্চায়েত সদস্য প্রতিনিধি, কখনও পৌর মাতা-পিতা, কখনও বিধায়ক-সাংসদ এবং আমলা অফিসারদের নিয়ে খোলা মাঠে-মঞ্চে জেলায় জেলায় দরবারি জমাটি আসর বসিয়েছেন। বলতে বলেছেন কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ আছে কিনা! দলনেতৃত্বের গলায় সারদার ফাঁস লেগে যাওয়ার পর একবার তো কলকাতার টাউন হলেও দরবার বসিয়েছিলেন। মুখোমুখি সওয়াল-জবাব শোনাতে। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোনো অভিযোগই ওঠেনি। কারণটি অন্য কিছু নয়, শাসক অপরাধীদের হিমশীতল চক্ষুকে ভয়। তথ্য প্রমাণ দিলেও মানানো যেত না, অভিযোগ গ্রহণের নিশ্চয়তা মিলত না, উপরন্তু উল্টে মিলত মিথ্যা ও কুৎসা গোলার শিকার হওয়ার পরিণতি। যেমন প্রশ্ন করার মাশুল দিতে ‘শিলাদিত্য’কে তকমা পেতে হয়েছিল, ‘মাওবাদী’! তৎক্ষণাৎ দাগিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। দলের নীচ থেকে ওপর মহল পর্যন্ত সবকিছুই জানা-বোঝা রয়েছে। দুর্নীতির টাকা গোপনে আসে কোথা হতে , আর যায় কোথায়। সবই নির্জলা সত্য। কিন্তু কতদিন আর রেখে-ঢেকে চলা সম্ভব। সব পর্দা ফাঁস করে দিল লোকসভা নির্বাচনে ফলাফলের নিরীখে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে এক বড় অংশে তৃণমূলের ভরাডুবির দশা। ভোটের মার বড় বালাই। কাটমানি খাওয়ার ‘শিল্প’কে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দেওয়ার মাশুল যে এতখানি দিতে হবে তা বোধহয় অনুমান ছিল না। জোর ধাক্কা খেয়ে দলনেত্রীর মুখে তোলাবাজিকে উপলক্ষ বানিয়ে অগত্যা শূন্যগর্ভ ‘হুঙ্কার’। এই হুঁশিয়ারির না রয়েছে কোনো গুরুত্ব, না রয়েছে এর কোনো কার্যকরী ফল মেলার সম্ভাবনা। হয়ত কোথাও কানাকড়িটুকু মিলবে, তার বেশি কিছু নয়। জল গড়াচ্ছে সেভাবেই। মুখ্যমন্ত্রী একটা ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন। তারপর কাটমানির শিকার হওয়া মানুষ যখন এখানে-সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হোক, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মদতে হোক বা বিরোধী দলবলের জোরে হলেও শাসকদলের প্রাতিষ্ঠানিক নেতা-মাথাদের অফিসে-বাড়িতে ঘেরাও শুরু করলেন; তার তে-রাত্তির না পেরোতে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর পার্শ্বচর জনা দুই নেতা-মন্ত্রী ড্যামেজ কন্ট্রোলের মু্খ খুললেন! বললেন, ‘তৃণমূলে ৯৯.৯ শতাংশই সৎ’, দুর্নীতিমুক্ত। শুনে মুখ্যমন্ত্রীও মুখ বন্ধ রাখলেন। প্রহসনের নমুনা সেখানে থেমে থাকছে না। এরপর ময়দানে নামলেন এক পুলিশ অফিসার, যিনি মুখ্যমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ট পছন্দের বলয়ে থাকা, যাঁর বিরুদ্ধেও সারদা তদন্তে তথ্য সরানোর সন্দেহজনক অভিযোগ ওঠে, সেই ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার অলিখিত হুকুম দিলেন, কাটমানি ফেরতের দাবির নামে বিশৃংখলা চলবে না, কোনো অভিযোগ থাকলে জানাতে হবে থানায়, তারপর যা খতিয়ে দেখার দেখবে পুলিশ। শাসকদলের ডাক্তার সংগঠনের এক ডাকসাইটে গোষ্ঠী নেতার বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে। নেত্রী দলকে শাসনের ভাবভঙ্গী দেখাতে গিয়ে দলকেই ঘরে-বাইরে বিশৃংখলা, অসন্তোষ, বিক্ষোভের মুখে ফেলে দেন। তাই দলের ভেতর থেকে চাপ ব্যুমেরাং হতে থাকে সর্বোচ্চ স্তরের দিকে। কাটমানি বিবৃতির সংশোধিত ব্যাখ্যার দাবি করে। অনতিবিলম্বেই ঘনিয়ে নিয়ে আসা হল ‘কাটমানি ফেরত’ নাটকের শেষ অঙ্ক। দলনেত্রীই আবার শোনালেন যবনিকা টানার সংলাপ। বললেন, তাঁর বিবৃতি নিয়ে অপব্যাখ্যা, অপপ্রচার করা হচ্ছে, সৃষ্টি করা হচ্ছে অশান্তি। অর্থাৎ দুর্নীতির মূলোৎপাটনের নামে মুখ্যমন্ত্রীর গর্জনই সার। ওতে কিছু বর্ষাবার নয়। টাকা ফেরত দেওয়ার তো নয়ই, দল থেকে বিতাড়িত হওয়ারও ভয় নেই, কারণ বিতাড়িত হলেও আর কোথাও না হোক বিজেপিতে আশ্রয় মিলবে, বিজেপিই এখন তৃণমূলছুট যত ‘সাধুপুরুষ’দের প্রশ্নাতীত পুনর্বাসন পাওয়ার ঠিকানা। নিত্যদিন লেগেই আছে নানা কারণে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে ভিড়ে যাওয়ার হিড়িক। কাটমানি বিবৃতিটা তার একটা বড় বাড়তি কারণ হয়ে যেতে পারে, সেই ভয়ও তৃণমূলের ভেতরে ভেতরে লাগছে। তাই এই পরিণতি এড়াতে কাটমানি বিবৃতি তৃণমূল এখন চাইছে গোটাতে। হয়ত হাতে রাখবে সুবিধামতো ব্যবহার করার তাস হিসাবে। যারা বিজেপিতে ঢুকবে তাদের হয়ত কাটমানি খাওয়া, তাই বিতাড়িত হওয়া বলে দাগিয়ে দিতে পারে। এছাড়া নিজেদের তৈরি এই কাটমানি সৃষ্ট সংকট থেকে বের হওয়ার অন্য উপায় নেই।
কাটমানির উৎস, উদ্ভব ও মহীরুহ আকার নেওয়ার আধার হল নয়া উদারবাদী অর্থনীতি। এই কাটমানিজাত সংকটও নয়া উদারবাদী সংস্কার নীতির এক সর্বব্যাপী বিষফল। তৃণমূলের কোনো জনকল্যাণকর অর্থনৈতিক দর্শন নেই, রয়েছে নয়া উদারবাদেরই ভজনা। তাই ক্ষমতায় আসা ইস্তক এমন কোনো সংস্কারসূচী গ্রহণ করেনি, যা বিরাজমান অর্থব্যবস্থাকে ভেঙ্গে নতুন জনস্বার্থমুখী জীবিকা ও দুর্নীতিমুক্ত নিরাপত্তা এবং নৈতিক আচার-বিচারের সংস্কৃতি সম্পন্ন পরিমন্ডল তৈরি করতে পারত। তৃণমূল ওপথেরই নয়। ক্ষমতায় এসে নিজের ভাবের ঘরে চুরি আড়াল করতে ঐ নয়া উদারবাদের তালাশে হত্যে দিয়ে থেকে পাশাপাশি কেন্দ্রের ও রাজ্যের কিছু কিছু প্রকল্প ভিত্তিক দান-খয়রাতির সংস্কার চালিয়ে এসেছে। এই ন্যূনতম সংস্কারের ম্যাজিক যেমন সাময়িক দলের ভোটের শেয়ার বাজার চাঙ্গা হওয়ার সহায়ক হয়েছে, তেমনি এই বৃদ্ধির রমরমা দেখে এর মধ্য দিয়েই চালু করিয়ে দেওয়া হয় ‘কিছু পেতে কিছু দাও’ মার্কা কাটমানি চালুর কালচার। এটা শুধু প্রকল্প ক্ষেত্রে সীমিত থাকেনি, ছড়িয়েছে পুরসভা পরিষেবা পাওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, সরকারি-আধা সরকারি কর্মসংস্থান হওয়ার প্রশ্নেও। যখন দলের ভাবমূর্তি দুর্নীতির মূর্তিমান প্রতীয়মান হয় ‘সারদা-নারদে’ জড়িয়ে, তখন কাটমানির হাতও নিয়ন্ত্রণের সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আর তার প্রতিক্রিয়া এবারের লোকসভা নির্বাচনে দলের ভোটের শেয়ার, তৃণমূল স্বীকার করুক না করুক, অনেকটাই ধসিয়ে দেওয়ার এক অন্যতম ফলিত কারণ হয়েছে। সেটা বুঝেই তৃণমূলনেত্রী কাটমানি ফেরতের আওয়াজ দিয়ে ভাবলেন বোধহয় ভাবমূর্তি ফেরানোয় লাভ হবে। কিন্তু ফল দিল উল্টো। ফলে দ্রুত প্রসঙ্গটা গোটানোতেই দলনেত্রী থেকে শুরু করে দলের নেতাদের হতে হচ্ছে শশব্যস্ত।