৮৪ বছর বয়সে রুমা গুহঠাকুরতা নশ্বর জীবনের সীমা পেরিয়ে চলে গেলেন স্মৃতির সুদূরে। বাংলায় “একে একে শুকাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি”। ১৯৩৪ সালে, ২১ নভেম্বর কলকাতায় জন্ম। বাবা সত্যেন ঘোষ, মা তত্কালের বিখ্যাত গায়িকা সতী দেবী। বড় হয়ে ওঠার সময়টাই এমন, যখন বাংলার সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতি তীব্র গতিশীল। একটু সচেতন হলেই একজন মানুষ নিজেকে ভেঙে, গড়তে পারতেন একের বেশি অধিক বিহঙ্গে। তাই চলচিত্রে অভিনয় থেকে গান, এই সুবিস্তৃত প্রয়োগভিত্তিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। সেই ১৯৪৪-এ ‘জোয়ার ভাটা’ দিয়ে শুরু। অভিনয় করেছেন বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন ঢং-এর প্রায় ৪১-৪২টি ছবিতে। তার মধ্যে কোন ধরনের ছবি নেই! ১৯৫৯-এ ‘গঙ্গা’ ও ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ১৯৬২-তে ‘অভিযান’ ও ‘নির্জন সৈকতে’, ১৯৬৭-তে ‘বালিকা বধূ’ ও ‘আশিতে আসিও না’, ১৯৮২-তে ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ১৯৮৯-এ ‘গণশত্রু’, হিন্দি ভাষায় চেতন আনন্দের ছবি ‘আফসার’ করেছেন আবার ইংরেজিতে করেছেন ১৯৮০-তে ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’ ও ২০০৬-এ ঝুম্পা লাহিড়ীর লেখা ‘নেমসেক’। প্রয়াত হওয়ার পর ৪ জুন, ২০১৯ ‘এই সময়’ পত্রিকায় সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় লিখেছেন “অজস্র ছবি তাঁর অভিনয়ের লাবণ্যে ভরপুর”। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি লিখছেন “‘জোড়া দীঘির চৌধুরী পরিবার’ বা ‘পঞ্চস্বর’ বা ‘আরোগ্য নিকেতন’ – এইসব ছবিতে তাঁর যে চারুরেখার মতো অভিনয় আছে এবং যা চিনে কালির আঁচড়ের মতো, যেটা মূল আখ্যানকে একটা অন্য রকম মাত্রা বা অন্য রকম দিগন্তের দিকে নিয়ে যায়”। একদিকে অভিনয় অন্যদিকে গানে এরকম সব্যসাচী সৃজনী ব্যক্তিত্ব কানন দেবীর পর বাংলা সিনেমা প্রত্যক্ষ করেনি। এ প্রসঙ্গে আমরা পলাতক ছবির ‘চিনিতে পারিনি বঁধূ’ বা ‘মনে যে আমার কেমন কেমন করে’ ইত্যাদি গানগুলি কিংবা বাঘিনী ছবিতে ‘শুধু পথ চেয়ে থাকা’কে অবধারিত স্মরণ করতে পারি।
এত কিছু করার মধ্যেও তাঁর সবচেয়ে বড় সৃজন অবশ্যই ১৯৫৮ সালে তাঁর নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত “ক্যালকাটা ইয়ুথ ক্যয়ার”। সত্যজিৎ রায় ও সলিল চৌধুরীকে সাথে নিয়ে তাঁর গড়ে তোলা এই উদ্যোগ অবশ্যই বাঙালীর সাংস্কৃতিক জীবনে এক মাইলস্টোন। অজস্র গান পরিচালনায় পরিবেশিত হয়েছে সম্মিলিত কণ্ঠে। ‘ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম’ থেকে ‘ও আলোর পথযাত্রী’ – এইসব গানের পরিবেশনের আবেদন কি বাঙালী ভুলতে পারবে? এই ক্যয়ার করতে গিয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদের গান আবার নতুন করে বাংলার সাংস্কৃতিক প্রবাহে যুক্ত করা। ১৯৫৮-তে ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ ক্যয়ার’ যখন স্থাপিত হয় সেইসময় বাংলা এবং ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন কিন্তু তীব্রভাবে গতিশীল। ১৯৫৯ ও ১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলন, ১৯৬৭-র নকশালবাড়ি, ১৯৭০-এর সিদ্ধার্থ জমানার কালো দিনগুলি পেরিয়ে শেষ হচ্ছে ১৯৭৭-এর জরুরি অবস্থার অবসানে। সেইসময় ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ ক্যয়ার’ ছিল সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল কিছু বিদগ্ধ মানুষের, রাজনৈতিক পরিভাষায় বললে বাংলার “কালচারাল কমিউনিস্ট”দের মানবিক এক উদ্যোগ, যার সাথে তত্কালীন নেহরু ঘরানার সর্বধর্ম সমভাব ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোনো বিরোধ ছিল না। কিন্তু আজ ৩ জুন ২০১৯ রুমা গুহঠাকুরতা যখন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তখন শুধুমাত্র ভারতের অন্য রাজ্য নয়, বাংলারও রাজনৈতিক মানচিত্র অতি দ্রুত পাল্টে গেছে। ২০২০-২০২১ অবধি রুমা গুহঠাকুরতা বেঁচে থাকলে তাঁর মৃত্যুর পর রাজ্য সরকারের দেওয়া ‘গান স্যালুট’ সম্ভবত তাঁর পাওনাই হত না। আজ তাঁর সমস্ত জীবনের সৃজন, সে চাই কি ‘গণশত্রু’ থেকে ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ হ্যায় মিলকে চলো’ সবই এক চরম ব্রাহ্মণ্যবাদী নজরদারির কবলে। যারা বলতে পারে “হায়, এদের কে বোঝাবে বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ-নেতাজীদের কাল বহু দিন গত, তারপর বাংলার বৃহদশও গত, এখন বাঙালি ছেলেরা হরিয়ানা থেকে কেরালা পর্যন্ত সব জায়গায় ঘর ঝাঁট দেয়, বাঙালি মেয়েরা মুম্বাইতে বার-ডান্স করে, যা আগে অকল্পনীয় ছিল”। [বিজেপি-আরএসএসের বিশ্বস্ত সেবাদাস তথাগত রায় উবাচ]। সত্যি যাদের কাছে আজ বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ-নেতাজী অপ্রাসঙ্গিক তাদের রাজপাটে রুমা গুহঠাকুরতা কে?
জানি, “আলো নেই – তবুও কেউ কেউ/আলো রাখে জ্বেলে,/হাতের আড়ালে।/সে আলোয় লেখা হয়/নির্ভয় জীবনের গান,/অবিরাম। সে গানের সুরে সুরে/ধীরে, অতি ধীর/দেশ জুড়ে গড়ে ওঠে/ঐক্যপ্রাচীর”। (সুশোভন মুখোপাধ্যায়) আজকের ঘন তমসায় রুমা গুহঠাকুরতার সৃজন আলোর পথযাত্রী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করবে। আমরা সুরে সুরে শুনতে পাব তাঁর “আহ্বান, শোনো আহ্বান, আসে মাঠ ঘাট বন পেরিয়ে/দুস্তর বাধা প্রস্তর ঠেলে বন্যার মতো বেরিয়ে”।