বিজেপি প্রার্থী প্রজ্ঞা ঠাকুর বলেন ‘‘নাথুরাম গডসে দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং থাকবেন, যারা তাঁকে সন্ত্রাসবাদী বলেন, তারা এই নির্বাচনে যোগ্য জবাব পাবেন’’ ২০১৯-এর সংসদীয় নির্বাচনের প্রচারের শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী মোদী, বিজেপি এবং আরএসএস এই বিবৃতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে একেবারে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিলেন।
প্রজ্ঞা ঠাকুর নিজেই সন্ত্রাসবাদী বোমা বর্ষণে অংশ নেওয়ায় অভিযুক্ত এবং তিনি এর আগে বলেছিলেন যে তাঁর দেওয়া ‘‘অভিশাপের’’ জন্যই পুলিশ অফিসার হেমন্ত কারকারে মুম্বই সন্ত্রাসবাদী হানাদারির সময় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত হন। কি মোদী কি বিজেপি এর কোনটিতেই কোনো অস্বস্তি বোধ করেনি; বিপরীতে, মোদী এবং অন্যান্য বিজেপি নেতারা প্রজ্ঞা ঠাকুরকে হিন্দু সভ্যতার ‘প্রতীক’ হিসাবে এবং তাঁর প্রার্থীপদকে সেই ব্যক্তিদের কাছে একটা ‘‘শিক্ষা’’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন যারা কোনো হিন্দুর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনার সাহস দেখায়। কিন্তু ঠাকুর, গান্ধির হত্যাকারীর যে উৎকট বন্দনা করেছেন, সেই রেখা অতিক্রমে নিজেদের শামিল করছেন বলে বিজেপি, আরএসএস এবং মোদী দেখাতে চায়নি।
মোদী তাই বললেন, তিনি ঠাকুরকে ‘‘কখনই ক্ষমা করতে পারবেন না;’’ কিন্তু তিনি এটা সুস্পষ্ট করে দিলেন যে, ঠাকুরকে ‘‘ক্ষমা’’ করতে পারার তাঁর এই স্বঘোষিত অক্ষমতা ঠাকুরের প্রার্থীপদ বা বিজেপি থেকে তাঁর সদস্যপদ বাতিল করার দিকে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে না। এছাড়া, মোদী নিজে অথবা বিজেপির কোনো নেতা এই সোজা কথাগুলো তাঁকে বলতে পারেননি যে, ‘‘গডসে একজন সন্ত্রাসবাদী ছিলেন যিনি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে ঘৃণা করতেন এবং গান্ধি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে সমর্থন করতেন বলে তিনি গান্ধিকে হত্যা করেন।’’
ইতিমধ্যে, বিজেপি ঠাকুরকে ক্ষমা চাইতে বলে। তাঁর প্রথম ‘‘ক্ষমা প্রার্থনায়’’ ঠাকুর শুধু বললেন, তিনি বিজেপির এক অনুগত সদস্য এবং বিজেপির লাইন ও তাঁর লাইন একই। এই বিবৃতি থেকে এই বার্তাই বেরিয়ে এল যে, বিজেপির লাইন বস্তুত হল গডসের বন্দনা করা। এর পরপরই ঠাকুরের ট্যুইটার হ্যাণ্ডেল থেকে এই ট্যুইটটা বেরিয়ে এল যাতে তিনি বললেন, ‘‘নাথুরাম গডসে সম্পর্কে আমার বিবৃতির জন্য আমি ভারতের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইছি। আমার বিবৃতি সম্পূর্ণরূপে ভুল ছিল। জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধিকে আমি অতি মাত্রায় সম্মান করি।’’ নির্বাচনী প্রচার শেষ হওয়ার পর তিনি আর একটা ট্যুইট করলেন যাতে তিনি ‘‘৬৩ ঘন্টা মৌন থাকার’’ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন আর সেটা তাঁর কথাগুলো ‘‘যদি’’ ‘‘দেশপ্রেমিকদের ভাবাবেগে আঘাত দিয়ে থাকে’’ তার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য।
তামিল অভিনেতা এবং রাজনীতিবিদ কমল হাসান এই সত্যি কথাটা সোজাসুজিভাবে বলেছিলেন যে, স্বাধীন ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী নাথুরাম গডসে একজন হিন্দু ছিলেন। এই মন্তব্য নিয়ে মিডিয়াগুলো একযোগে ঝড় তোলায় প্রজ্ঞা ঠাকুর তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে গডসে সম্পর্কে তাঁর ঐ মন্তব্য করেন। কমল হাসানের ঐ মন্তব্য ছিল মোদীর বারবারই জোরালোভাবে করা এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে, ‘‘কোনো হিন্দুই’’ কখনও সন্ত্রাসবাদী ছিল না এবং হতেও পারে না।
এ সত্ত্বেও, কমল হাসানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয় এবং মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি তাঁকে আগাম জামিন মঞ্জুর করার সাথে সাথেই কোন সন্ত্রাসবাদী বা দুর্বৃত্তকে কোনো সম্প্রদায়ের সঙ্গে জড়িত করার জন্য তিরস্কার করেন। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেই কোনো হিন্দু কখনও সন্ত্রাসবাদী হতে পারে না বলে সন্ত্রাসবাদের ইস্যুটিতে সাম্প্রদায়িক রং দেন এবং এই দাবিও করেন যে, প্রজ্ঞা ঠাকুর এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো ছিলো এমনই একটা অপমান, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে যে অপমানের বদলা হিন্দুদের নিতে হবে। সংবিধান যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস নিরপেক্ষে আইনের চোখে সকলকেই সমানাধিকার দিয়েছে, সেটিকে প্রকটভাবে লঙ্ঘন করে নির্বাচনী বক্তৃতা দেওয়ার জন্য কমল হাসানের বদলে মোদীরই বিচার বিভাগীয় তিরস্কার প্রাপ্য।
ঘটনা হল, আরএসএস এবং বিজেপি যে গান্ধীর হত্যাকারী গডসে এবং ঐ হত্যায় চক্রান্ত করার জন্য সাভারকারের মত ব্যক্তিদের সঙ্গে মতাদর্শগত আনুগত্যের অংশীদার তাকে কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। এটা সুপ্রতিষ্ঠিত যে, প্রজ্ঞা ঠাকুর অভিনব ভারতের সাথে যুক্ত যা হল একটা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, সহিংস পথে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় রাষ্ট্রকে উৎখাত করে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যেটাকে প্রতিষ্ঠা করেন গডসে ও সাভারকারের উত্তরসূরীরা। ২০১৯-এর নির্বাচনী প্রচারে প্রজ্ঞা ঠাকুরকে এক ম্যাসকট রূপে প্রার্থী হিসাবে বেছে নিয়ে মোদী এবং বিজেপি হিন্দুত্ব সন্ত্রাসবাদকে — গান্ধি হত্যা থেকে মুসলিমদের এবং ধাবোলকার, পানসারে, কালবুর্গি এবং গৌরি লঙ্কেশের মতো বুদ্ধিজীবীদের হত্যা — ‘দেশপ্রেম’ হিসাবে আড়াল করতে চাইছে।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসাকে মেনে নিতে অস্বীকার করার জন্য গডসে এবং আরএসএস যে গান্ধির বিরুদ্ধে একই ধরনের প্রবল ঘৃণা পোষণ করত তার যথেষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। গোয়েন্দা সংরক্ষিত নথিতে আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকারের ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দেওয়া একটি বক্তৃতার উল্লেখ রয়েছে। ঐ বক্তৃতায় গোলওয়ালকারকে সংঘের ক্যাডারদের উদ্দেশে বলতে শোনা গেছে, মুসলমানদের ভারত থেকে তাড়াতে হবে এবং পাকিস্তানকে শেষ করে দিতে হবে এবং ‘‘কেউ যদি আমাদের পথে বাধা হয় তবে তাকেও আমাদের শেষ করে দিতে হবে।’’ ঐ বক্তৃতায় গোলওয়ালকার গান্ধির নাম নেন এবং বলেন, ‘‘বাধ্য হলে’’ সংঘ তাকে ‘‘শীঘ্র নিস্তব্ধ করে দেবে।’’ নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে ১৯৯৪ সালে বলেন, নাথুরাম এবং তার সব ভাই আরএসএস-এর সদস্য ছিল এবং নাথুরাম বলেন তিনি আরএসএস ত্যাগ করেছেন এবং তার উদ্দেশ্য ছিল গান্ধি হত্যার প্রতিক্রিয়া থেকে আর এস এস-কে আড়াল করা। ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের এই কথা লিপিবদ্ধ আছে যে, আর এস এস নেতাদের বক্তৃতাগুলোর ‘‘সাম্প্রদায়িক বিষ’’ই গান্ধি হত্যাকে ডেকে আনে এবং আর এস এস-এর ‘‘লোকেরা গান্ধি হত্যার পর উল্লাস প্রকাশ করে ও মিষ্টি বিতরণ করে।’’
আরএসএস-এর এক অনুগত সদস্য হিসাবে মোদীও গান্ধির প্রতি ঐ ধরনের বিদ্বেষমূলক মনোভাবের উত্তরাধিকারী হয়েছেন। গান্ধি হত্যাকে প্রকাশ্যে অনুমোদন করাটা তাঁর পক্ষে দুষ্কর। আর তাই গান্ধিকে আত্মসাৎ করে তাঁকে শুধু ‘‘নির্মলতার’’ সঙ্গে যুক্ত করে এবং মুসলিম-বিরোধী ঘৃণা ও হিংসাকে প্রতিরোধ করার জন্যই যে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল সেই ঘটনা সম্পর্কেনীরব থেকে তিনি গান্ধির ঐতিহ্যেরই বিকৃতিসাধন ঘটাতে চাইছেন।
সন্ত্রাসে অভিযুক্ত গডসের এক অনুগামীকে ভারতীয় সংসদের এক প্রার্থী করে বিজেপি অতি-দক্ষিণপন্থী হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদী সন্ত্রাসবাদের সমর্থক হিসাবে তার প্রকৃত মুখকে উন্মোচিত করেছে। গান্ধির জন্য মোদী বা প্রজ্ঞা যতই মেকি ‘‘প্রায়শ্চিত্ত’’ অথবা কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন করুন, তা কখনই এই ঘৃণ্য ঘটনাটাকে মুছে দিতে পারবে না।