গত ১২ মে ২০১৯, বীজপুরের দাসপাড়া অফিস ঘরে এআইপিডবলুএ-র বীজপুর আঞ্চলিক কমিটির দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল উপস্থিত ছিলেন ৪৬ জন প্রতিনিধি।
শহীদ বেদীতে মাল্য়দান ও শহীদ-স্মরণের পর ছোট্ট সৃজার রবীন্দ্রসংগীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। আইসা-র রূমেরা দে প্রতিবেদনটি ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে দেওয়াই আজ দেশের সবচেয়ে বড় বিপদ। বিশেষ করে উগ্র হিন্দুত্ব। কাজ খুঁজতে গিয়ে মেয়েদের পাচার হয়ে যাওয়া, কর্পোরেট সংস্থা থেকে ইটভাটা – সর্বত্র মজুরি বৈষম্য, ক্রমাগত বেড়ে চলা যৌন হিংসা, শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দ ছাঁটাই – এগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্ত দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষিত ও জোটবদ্ধ হওয়া আর সেই জন্যই সগঠনকে মজবুত করে তোলাই একমাত্র পথ।
এরপর প্রতিনিধিরা নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এরা ১০০ দিনের কাজ, মিড-ডে-মিল, গৃহপরিচারিকা ও বাড়িতে রান্নার কাজ, সেলাই ও আয়ার কাজ করেন। কেউ মদ্যপ স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সন্তান নিয়ে আলাদা থাকেন, কারও স্বামী অসুস্থ, কারও স্বামী মারা গেছেন। ফলে সম্পূর্ণ আর্থিক দায় ও অত্যন্ত কম মজুরির জন্য সংসার চালাতে একাধিক কাজ করতে তথা অকথ্য পরিশ্রম করতে হয়।
পার্বতী বলেন, ১০০ দিনের কাজে নিয়মিত ও সময় মতো পয়সা পাওয়া যায় না। পড়াশোনা না জানার জন্য সুপারভাইজার অনেক সময় ঠকায়। পরিচারিকার কাজও করেন। অবসর সময়ে পুকুরধার থেকে শাকপাতা কচুরলতি তুলে বিক্রি করেন।
জল্পনা পাল বলেন, স্বামী মারা গেছেন। ছেলে-মেয়ে ও পঙ্গু মাকে দেখতে হয়। স্থানীয় একটি স্কুলে মিড-ডে-মিল-এর কাজ করেন। তিন জন কর্মীর মধ্যেএকজনকে হঠাত্ করে বাদ দেওয়ায় ভাতার পরিমাণ কমে গেছে। ফলে খুব সংকটে আছেন। মিড-ডে-মিলের মজুরি বাড়ানো হোক।
বাসন্তী বলেন, দশ বছরের বিবাহিত জীবনে মদ্যপ স্বামীর অনেক অত্যাচার সইতে হয়েছে। এখন আট বছরের ছেলেকে নিয়ে একা থাকেন। সেলাই করে সংসার চালান।
চন্দনা দাস বলেন, মিড-ডে-মিলের অতি সামান্য টাকায় না চলে সংসার, না হয় অসুস্থ স্বামীর চিকিত্সা।
নমিতা ভদ্র বলেন, মেয়েদের উপর অত্যাচার নির্যাতন বহু যুগ ধরেই চলছে। সমাজের ও শাসকের তাতে প্রশ্রয় আছে। টিভি সিরিয়ালগুলোতে মেয়েদের সবসময় হেয় করে দেখানো হয়।
১০০ দিনের কাজের মজুরি সময়মতো ও ঠিকমতো পাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হবে। মিড-ডে-মিল চালু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যেটুকু মজুরি বেড়েছে তা সংগ্রামী রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের আন্দোলনের জন্যই বেড়েছে। তৃণমূল সরকারের আমাদের জন্য কোনো সহানুভূতি নেই। তাই আগামীতেও আমাদের কাছে আন্দোলনই একমাত্র পথ। এর মাধ্যমেই স্বাধীনতা গণতন্ত্র মর্যাদা অধিকারের দাবি অর্জিত হবে।
সম্মেলনের পর্যবেক্ষক অ্যাপোয়ার রাজ্যনেত্রী অর্চনা ঘটক বলেন, আজ এমনকি কর্পোরেট দুনিয়াতেও মহিলাদের (পুরুষদেরও) কাজের নিশ্চয়তা তথা নিরাপত্তা নেই। অ্যাপোয়া শ্রমজীবী মানুষের জন্য ন্যূনতম ১৮০০০ টাকা মজুরি ও ৬০০০ টাকা পেনশনের দাবিতে লড়ছে। ১০০ দিনের কাজে দু্র্নীতির বিরুদ্ধেও লড়তে হবে। মিড-ডে-মিলের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবাদ প্রতিরোধের পর অন্যায় ও অসম্মানজনক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। লড়াই-ই এগিয়ে চলার শর্ত।
কমিটির বিদায়ী সম্পাদিকা শান্তি দাস বলেন, দীর্ঘদিন সম্পাদিকা থাকার সময় সকলের সহযোগিতা পেয়েছি। আগামী দিনেও পাব আশা রাখি।
সমিতির অন্যতম সংগঠক উত্তম দাস উপস্থিত সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, এমনকি রোজা (সারাদিন উপবাস) পালন করেও প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছেন।
মহিলা সমিতির কাজ প্রসঙ্গে বলেন, পারিবারিক ব্যাপারে নিরপেক্ষভাবে সমস্যাটিকে বুঝে এগোতে হবে। কোনো মহিলা নির্যাতিতা হলে পুলিশের কাছে যেতে হবে। কোনো প্রতিবাদী মহিলা সমাজের তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির দ্বারা নিগৃহীত (চরিত্র হনন, কুত্সা ইত্যাদির শিকার) হতে পারেন। সেখানে মহিলার পক্ষ নিতে হবে। শ্রমজীবী মহিলাদের পরস্পরের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সমিতির মাধ্যমে জোটবদ্ধ হতে হবে। নানা সমস্যার মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রয়োজনে সরকারের ভুল নীতির সমালোচনা করতে হবে। বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ‘সাসপাউ’ (২৫ টাকার বই)-এ লাগাতার লড়াইয়ের ফলে কিছু ফেসিলিটি বেড়েছে। এবার পেনশনের বিষয়টি নিয়ে লড়ত হবে। দুবছর আগের হাজীনগরের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আগামীদিনে যে কোনো প্ররোচনাকে রুখতে গেলে সকলকে একজোট থাকতে হবে আর এজন্য সংগঠনটিকে মজবুত করতে হবে। নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে। তিনি জানান, বর্তমানে সমিতির সদস্য সংখ্যা ১৫০। আগামীতে ৩০০ করতে হবে।
এরপর সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবেদনটি গৃহীত হয় এবং নমিতা ভদ্রকে সভানেত্রী ও শান্তি দাসকে সম্পাদিকা করে ঊনিশ জনের একটি কমিটি তৈরি হয়।
সম্মেলনের সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া মেহুলি চক্রবর্তী রবীন্দ্রজয়ন্তীর রেশটি ধরে এবং নারীমুক্তির বার্তা রেখে তিনটি অসাধারণ গান পরিবেশন করে, তার সুরেলা কণ্ঠে ও অনবদ্য গায়কীতে। এই সংগীত যেন সভার সুরটি বেঁধে দিয়েছিল।