ডুয়ার্সের চা বলয়ে আলিপুরদুয়ার লোকসভার অন্তর্গত মাদারীহাট বিধানসভা কেন্দ্রে বর্তমানে বিজেপির বিধায়ক আসীন। পার্শ্ববর্তী কালচিনি বিধানসভা ক্ষেত্রে বিগত ২০১৬ সালের নির্বাচনে মাত্র ২০০০ ভোটের ব্যবধানে তৃণমূলের কাছে পরাজিত হয় বিজেপির প্রার্থী। এই লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী জন বারলা একদা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সুপ্রিমো বিমল গুরুংদের জোট সঙ্গী থাকা, অন্যদিকে চা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকার দরুণ কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। চা-বলয়ের এই অংশে বিজেপির সুবাদে আরএসএস তার গতিবিধি সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ভোট প্রচারে তৃণমূলের তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদি রাজনীতির শিকড় এখানে ভালো ভাবেই গেড়ে বসেছে। এহেন সমীকরণে বিজেপি ভোটের নিরীখে লাভবান হতেই পারে। চা বাগানগুলিতে আদিবাসী ও নেপালী ভোটার এবং বাকি শহর, গঞ্জগুলিতে তৃণমূলের থেকে মুখ ফেরানো মানুষগুলির বিজেপির দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া একেবারেই সম্ভব। সরকারী বাম সংগঠনগুলি বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই হতোদ্যম, নৈরাশ্যের শিকার। ফলে বাম-ভোটের বৃহদংশ রাম-মুখি হওয়ার সম্ভাবনা রাজ্যের অন্য কেন্দ্রগুলির মতো এখানেও বিদ্যমান।
আরএসএস দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি ইত্যাদি ব্লকগুলির আদিবাসী গ্রামগুলিতে ইদানিং প্রবলভাবে সক্রিয়। খড়িবাড়িতে বিগত প্রায় ৪০ বছর ধরে কার্যরত বনবাসী কল্যাণ পরিষদ এর পরিচালনায় প্রায় প্রত্যেকটি আদিবাসী অধ্যূষিত গ্রামে আরএসএস শিশুদের হিন্দুত্ববাদী শিক্ষাদর্শে দীক্ষিত করতে একল বিদ্যালয় স্থাপন করেছে! শিক্ষক হিসাবে এরা মাত্র ২০০০ টাকা মাস মাইনে দিয়ে নিয়োগ করছে কিছুটা লেখাপড়া জানা আদিবাসী পরিবারের তরুণী গৃহবধুদের। এর মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতিকে পরিবারের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ ঘটাতে সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করা যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে পাহাড়ের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির ভোট নিরঙ্কুশ না হলেও জিএনএলএফ, বিমল গুরুং ও বামপন্থার প্রতি সম্পূর্ণত অনাস্থা প্রকাশ করে বিজেপিকে সমর্থনকারী সিপিআরএম-এর সমর্থনে তৃণমূলের থেকে বিজেপি কিছুটা এগিয়ে থাকবে। সমতলের বাকি চারটি বিধানসভা ক্ষেত্রের মধ্যে চোপড়া ও ফাঁসিদেওয়া ক্ষেত্রে তৃণমূলের এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে কেপিপি-র সমর্থনে তৃণমূলের কিছুটা সুবিধা হলেও আরএসএস এর কর্মকান্ডের ফায়দা লুটতে বিজেপি তৎপর থেকেছে। শিলিগুড়ি সহ অন্য গঞ্জগুলিতে তৃণমূলের প্রতি অনাস্থা, অন্যদিকে বিজেপি প্রীতি বেশ ভালো মাত্রায় থেকেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শিলিগুড়ি পুরনিগম ও মহকুমা পরিষদে (জেলা পরিষদের সমগোত্রীয়) এখনও বামেরাই ক্ষমতা ধরে রেখেছে। অশোক ভট্টাচার্যদের নেতৃত্বে সমগ্র রাজ্যের তুলনায় এখানেই বামেদের তৎপরতা কিছুটা লক্ষ্য করা যায়। এতৎসত্বেও বাম থেকে রামের দিকে ঢলে পড়ায় এখানেও কোনো খামতি নেই। এই প্রবণতা কেবলমাত্র এবারের নির্বাচনেই নয়, বরং ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনী লড়াইতেও পরিলক্ষিত হয়। পাঁচবছর আগে সরকারী বামেরা এতটা হতোদ্যম না থাকলেও তৃণমূলকে হারাতে বামেদের অবলম্বিত ‘অভিনব কৌশল’ একমাত্র চোপড়া ছাড়া অন্য ৬টি বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির সুরেন্দ্র সিং আলুওয়ালিয়াকে বিজয়ী হতে সাহায্য করে। এই ‘আগে রাম, পরে বাম’ শ্লোগান আজ রাজ্যের সর্বত্র উচ্চারিত হয়ে চলেছে। নির্বাচনী প্রচারে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব শেষমূহুর্তে তাদের ভোটারদের নিরস্ত করতে চাইলেও ভাষনের সিংহভাগ তৃণমূলের প্রতি বিষোদ্গারে ব্যবহৃত হওয়াতে বিজেপি প্রধানতম শত্রু হওয়ার গৌরব থেকে খামোখা বঞ্চিত হয়েছে নেতাদের শব্দচয়নে। তার ফলে কফিনের শেষ পেরেকটি পোঁতা সাঙ্গ হয়েছে।
এর বাইরে সিপিএম প্রার্থীর সমর্থনে যৌথ প্রচারে অংশগ্রহণ করার সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে যে নীচেরতলার কর্মীদের বহুলাংশ আমাদের রাজনৈতিক মূল্যায়নের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিপিএম বা বাম শরিকদলের ব্লক পর্যায়ের কর্মীরা আমাদের অংশগ্রহণে তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে প্রচার কর্মসূচী গ্রহণে সাহস পেয়েছেন।
রাজ্যের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক, ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি আরএসএস-এর স্বাভাবিকরণের মধ্য দিয়ে বাড়বে। এই সন্দর্ভে পশ্চিমবঙ্গ প্রতিরোধ হারিয়ে দুর্বলতম অবস্থানে এসে ঠেকেছে। যুযুধান দুইপক্ষ বিজেপি-তৃণমূল ধর্ম ও রাজনীতির সমাপতনের চূড়ান্ত অভিক্ষেপে সন্নত। বাম সংস্কৃতি এই গড্ডলিকাপ্রবাহ থেকে স্বতন্ত্র কোনো নির্ভীক নাস্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থান সজোরে ঘোষণা করতে দ্বিধাগ্রস্ত।
মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়ার সমাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে বামপন্থার মৌলিক মতাদর্শকে পুন:প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে, বুনিয়াদী শিক্ষার সঙ্গে স্পর্ধার মিশেল ঘটানো আজ সময়ের দাবি। যৌথ কার্যক্রমেও শক্ত বনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়ে কিছুটা নির্মম হতে আপত্তি কোথায় ?