মে দিবসের আহ্বান : শ্রমিক আন্দোলনকে নতুন নতুন রূপে এগিয়ে নিয়ে চলুন

এবারের আন্তর্জাতিক মে দিবস নতুন কিছ তাৎপর্য নিয়ে সামনে এলো। এমন একটা সময়ে এবারের মে দিবস উদযাপিত হচ্ছে যখন গোটা ভারতবর্ষ রয়েছে নির্বাচনের ভরা মরশুমে। ফ্যাসিস্ট মোদী রাজকে শাসন ক্ষমতা থেকে হটানোর অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজটি এবারে মে দিবসের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

এতো বড় হামলা ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর কাছে এর আগে আর কোনোদিন নেমে আসেনি। ভারতের কাছেও না। গণতন্ত্র, দেশের সাংবিধানিক কাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল অন্তর্বস্তু বা যা কিছু ভারতীয়তা, মোদী জমানা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আরএসএস-এর অ্যাজেন্ডা হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলার তাগিদে বৌদ্ধিক জগতেও হামলা নেমেছে, পাল্টে দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত সব ইতিহাস, বৈজ্ঞানিক সত্য। আর, শ্রম আইন, ট্রেড ইউনিয়ন সহ দীর্ঘ অনেক সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এ দেশে শ্রমিক শ্রেণী যা কিছু অর্জন করেছিল, মোদী রাজ কর্পোরেটদের স্বার্থে তা পুরোপুরি হরণ করতে নেমে পড়েছে। দেশের বেকারত্ব প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন রেকর্ড ভাঁঙ্গছে। দিন কয়েক আগে, সিএমআইই জানালো, এ বছরে এপ্রিল মাসের প্রথম ৩ সপ্তাহে বেকারত্বের হার বিরাট ভাবে বেড়ে দাঁড়ালো ৮.১ শতাংশে, মার্চ ও ফেব্রুয়ারি মাসে যা ছিল যথাক্রমে ৬.৭% এবং ৭.২%। আর এই লাগামছাড়া বেকারত্বের মাঝে নতুন করে ২৩,০০০ জেট এয়ারওয়েজ-এর কর্মীরা কর্মচ্যুত হলেন, আর নির্বাচন চুকে গেলেই ৫৪,০০০ বিএসএনএল কর্মীদের উপর নেমে আসবে ছাঁটাই এর কোপ। অনাদায়ী ঋণের ভারে ঝুঁকে পড়া ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ককে দিয়ে জেট বিমান সংস্থাকে চাঙ্গা করার শেষ চেষ্টা চলছে।

ন্যুনতম ১৮,০০০ টাকা মজুরি, বিপুল বিশাল অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষদের সামাজিক সুরক্ষা,ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার প্রভৃতি দাবি নিয়ে বার বার ভারতের শ্রমিকশ্রেণী সর্বভারতীয় স্তরে নানা রূপের আন্দোলন, সংগ্রাম এমনকি ধর্মঘটে সামিল হলেও মোদী সরকার এগুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র আমল দিল না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৯০-এর দশকের প্রথম পর্ব থেকেই ভারতের শাসকশ্রেণী অনুসরণ করতে শুরু করল নয়া উদার অর্থনীতি। ভারতীয় রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় ভাষ্য, ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতি পুরোপুরি এই নব্য উদারনীতিবাদের সপক্ষে দাঁড়ালো। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নে বিরোধিতা থাকলেও উদার আর্থিক নীতির প্রশ্নে তৈরি হল এক অভিন্ন ঐকমত্য। রাষ্ট্র, সরকারকে মূলত অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে গুটিয়ে আনার জোরালো সওয়াল সামনে এলো, শ্রম কানুনকে পুঁজির অনুকূলে, বিনিয়োগের স্বার্থে ঢালাও সংস্কারের দাবি প্রবল বেগে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। মাত্র ৫-৬% সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকশ্রেণী বর্তমানে শ্রম কানুনের আওতায়। তাও সেটা নানা শর্তে কন্টকিত। এটাকেও ধুয়ে মুছে সাফ করে বিনিয়োগের রাস্তাকে অবাধ করতে দেশী- বিদেশী কর্পোরেট ঘরাণার প্রবল চাপে শুধু সরকারগুলিই নয় বিচার ব্যবস্থাও নির্লজ্জভাবে শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে খোলাখুলি অবস্থান নিতে শুরু করল। তাই দেখা যায়, ওই সংস্কারের সূচনা লগ্নে সুপ্রিম কোর্ট সবচেয়ে বড় আঘাত আনলো এয়ার ইন্ডিয়ার কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের স্বার্থে ঐতিহাসিক রায়কে খারিজ করার মাধ্যমে। সুপ্রিম কোর্টের ৫ সদস্য বিশিষ্ট বেঞ্চ রায় দিল যে পূর্বোক্ত ক্ষেত্রে স্থায়ী কাজে ঠিকা শ্রমিকদের নিয়োগ করে আইন অমান্য করার “জরিমানা’’ হিসাবে সমস্ত ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ী করার যে আদেশ সুপ্রিম কোর্টের ৩ সদস্য বিশিষ্ট বেঞ্চ দিয়েছিল তা ভুল। যে কাজ বা পেশাগুলোতে এয়ার ইন্ডিয়া কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের নিয়োগ করেছিল, পুরোটাকেই বাতিল করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। ফলে, ঝুঠা কন্ট্রাক্টে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ প্রমাণিত হলে তাদের স্থায়ী করার পূর্বেকার আইন এইভাবে বাতিল হওয়ায় কর্পোরেট ঘরাণা বিরাট ভাবে উল্লসিত হয়ে ওঠে। তারপর আরেকটি মারাত্বক রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট উমা দেবী মামলায়। সরকারি দপ্তরে ১৫-২০ বছর ধরে অস্থায়ী বা ক্যাজুয়াল প্রথায় যারা কাজ করতেন, তাদের স্থায়ী করার পূর্বেকার রায় খারিজ করে দিল ৫ সদস্য বিশিষ্ট সুপ্রিম কোর্টের উমা দেবী মামলা। শীর্ষ আদালত জানালো, কত দিন ধরে একজন অস্থায়ীভাবে কাজ করছেন, সেটা বড় কথা নয়। যেহেতু সরকারি কাজে অস্থায়ী প্রথায় নিয়োগ করাটাই অনুচিত, তাই গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই বাতিল করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। এই মামলার রায় দেখিয়ে নিয়োগ কর্তারা আজকাল অস্থায়ী বা ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের স্থায়ী করেন না। আর গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল হওয়ার আশংকায় ক্যাজুয়াল কর্মীরাও আইনী পথে যাওয়ার ভরসা পান না।

মজার ব্যাপার হল, খোদ সুপ্রিম কোর্টও তার এই অবস্থান সম্পর্কে সমালোচনা করেছে। হরজিন্দার সিংহ বনাম পঞ্জাব স্টেট ওয়েরহাউসিং কর্পোরেশন মামলায় ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ হল, “সম্প্রতি সামাজিক সুরক্ষা,শ্রমিক স্বার্থের প্রশ্নে আদালতগুলোর মনোভঙ্গীতে এক চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের আকর্ষণীয় মন্ত্রগুলো বিচার প্রক্রিয়াকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করছে। ক্রমে এই ধারণা প্রবল হয়ে উঠছে যে, সাংবিধানিক আদালত আর শিল্প ও অসংগঠিত শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতে পারছে না। তাই, সংবিধানের যে সমস্ত নির্দেশাত্বক নীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে সাংবিধানিক দর্শন তার উপরই শ্রমিকদের ন্যায়বিচার দিতে আদালতগুলোকে আরও পরিসর দিতে হবে।’’

সমস্ত শ্রম আইনকে মোদী চারটি কোড-এ মিশিয়ে কার্যত শ্রম আইনকেই বাতিল করে দিচ্ছেন। শিল্পবিরোধ আইনে বিরোধের অশুভ শব্দটিকে বাদ দিয়ে করা হচ্ছে শিল্প সম্পর্ক কোড। বিরোধ মীমাংসার এযাবৎ অনুসৃত প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। ভেঁঙ্গে ফেলা হচ্ছে শ্রম আদালত, বিচারপতিদের ব্যবস্থা। তার জায়গায় আসবে “মধ্যস্থতাকারী" বা “মেডিয়েশনের” এমনই এক ব্যবস্থা যেখনে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াটা হবে কল্পনাতীতভাবে দীর্ঘস্থায়ী। পরিদর্শক বা ইন্সপেক্টরদের থাকবে না কোন অস্তিত্ব। নিয়োগকর্তা ন্যূনতম মজুরি বা অন্যান্য আইন মানছে কিনা তা এবার থেকে দেখার জন্য পরিদর্শকের রিপোর্ট লাগবে না। নিয়োগ কর্তা নিজেই শংসাপত্র দিলে সেটাই গণ্য হবে বৈধ বলে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের প্রক্রিয়াটা অসম্ভব কঠিন হয়ে উঠছে। নিজেদের নেতা নির্বাচনে বা তারা কতদিন নেতৃত্বের পদে থাকবে সেটা এবার থেকে শ্রমিকরা ঠিক করতে পারবে না। পাঁচ বছরের সময় সীমার মধ্যে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের আইনকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সবটাই নির্ভর করবে নিয়োগকর্তার সদিচ্ছার উপর।

তাই প্রচলিত পথে শ্রমিক আন্দোলন আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিন ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। আইন আদালতের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার পথ বন্ধ হলে মাঠে ময়দানে, কারখানা চত্বরে তা জঙ্গী রূপ নিয়ে ফেটে পড়তে বাধ্য। সমস্ত প্রতিষ্ঠান, আইনসভা, সমস্যা নিরসনের মঞ্চগুলো যতই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, ততই শ্রমিকদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব মাথাচাড়া দিতে বাধ্য। তাই, শ্রমিকদের লড়াকু জঙ্গী মনোভাবকে নৈরাজ্যের বিপদ থেকে বাঁচাতে শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে,সংগ্রাম ও রূপে ব্যাপক বদল আনতে হবে। ফ্যাসিস্ট মোদী রাজকে পরাস্ত করে আন্দোলনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে আসুন, মহান মে দিবসে শপথ নিই।

খণ্ড-26