কেন্দ্রের মোদী জমানায় ‘মনরেগা’ (মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট) প্রকল্পে কর্মসংস্থানের অবস্থা এখন অত্যন্ত শোচনীয়। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষশেষ হতে আড়াই মাস বাকী, কিন্তু এর মধ্যে চলমান বছরের ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ তহবিল ফোঁপরা হয়ে গেছে। পরন্তু নিট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১,৭১৯ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক চলতি ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরের জন্য প্রদত্ত বরাদ্দ ৫৯,৫৬৭ কোটি টাকার নাকি পুরোটাই শেষ করে ফেলেছে। অবশ্য এতে কাজ কোন রাজ্যে কোথায় কি হল তার কোন রিপোর্ট কার্ড গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক প্রকাশ করেনি। কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ তো দিতে হবেই, যাবে কোথায়। প্রকল্প রূপায়ণের জিম্মাদারিতে থাকা পঞ্চায়েতি সচিবরা হাত তুলে নিচ্ছেন। কর্মপ্রার্থীদের নাম লেখাতে চাইছেন না, কারণ নাম লেখালে কাজ দিতে হবে, কাজ করালে মজুরি দিতে হবে, না করালেও বেকার ভাতা দিতে হবে। প্রকল্পের কাজটা আইনের কথায় চাহিদা নির্ভর, কর্মক্ষম নিবিড়, সুতরাং না দিয়ে পরিত্রাণ নেই। সামনে লোকসভা নির্বাচন। এখন প্রতিশ্রুতির ‘জুমলা’ চালিয়ে যাওয়া খুবই ঝুঁকির। অবস্থা সামাল দিতে না পারলে মানুষ ছেড়ে কথা বলবে না। মানুষকে নরেন্দ্রজির কোন ইন্দ্রজালে আর বোধহয় বোকা বানানো সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের তহবিল ঘাটতি, অন্যদিকে অর্থমন্ত্রকের হাত সহজে উপুড় হচ্ছে না। এই যদি চলতে থাকে তবে নিয়তির ললাটে ঘনীভূত হবে আরও সংকট। একদিকে কৃষকের অসন্তোষের আগুন দাবানল সৃষ্টি করছে। ঋণমুক্তি আর ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামের দাবিতে আন্দোলন ঘুম ছুটিয়ে দিচ্ছে। তার সাথে কাজ ও মজুরির ন্যূনতম নিশ্চয়তা না পেলে গ্রামীণ মজুর বাহিনীর বিস্ফোরণের সমূহ সম্ভাবনা তো থাকবেই। তাড়া করছে উভয় সংকট। মোদী সরকারের এক মন্ত্রকের সাথে অন্য মন্ত্রকের ঠোকাঠুকি লাগছে নিত্যই। রোজকার বাসি-টাটকা খবর বেরোচ্ছে। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক নাকি আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজ চালানো টিকিয়ে রাখতে অতিরিক্ত ২১,০০০ কোটি টাকা আবশ্যিক প্রয়োজন হিসাব করেছিল। সেইমতো গত নভেম্বরে (‘১৮) ১০,০০০ কোটি টাকা অর্থমন্ত্রকের কাছে চেয়েছিল। সেই টাকা তখনকার জরুরী প্রয়োজন মেটাতে দেওয়া হয়নি, বরং অর্থমন্ত্রক দীর্ঘটালবাহানা করেছে, বিলম্ব করেছে; তারপর সেই টাকার মাত্র ৬,০০০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে, অর্থাৎ প্রয়োজনের ৪০ শতাংশ ছেঁটে দিয়েছে, এবং সেটুকু দিয়েছে জানুয়ারী (‘১৯)- র দ্বিতীয় সপ্তাহে। সেটাই খরচা হয়ে এখন চলছে দু’হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি ঘাটতি।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরী আমলারা মনে করছেন ২০১৯- ২০ অর্থবর্ষ শুরুর আগে আর এই খাতে বরাদ্দ মিলবে কিনা অনিশ্চিত। না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর পরবর্তী অর্থবর্ষ সূচনার পর, এমনকি লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কাল হিসাবে আপৎকালীন বাজেটে বরাদ্দ কিছুটা হলেও, তা পেতে পেতে এপ্রিলের আগে তো নয়ই। ততদিনে কাজ-মজুরি না পাওয়া গ্রামীণ মজুরদের জীবন আরও ভয়ঙ্কর অভাব-দারিদ্র্য যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
এখন এক নজিরবিহীন মাত্রায় সার্বিক, বিশেষত গ্রামীণ বেকারি বেড়ে চলার সময়, পরন্তু সাম্প্রতিকতম ব্যাপক বিধ্বস্ত করে দেওয়া বন্যাত্তোর কেরল, ঘূর্ণিঝড়ে পর্যুদস্ত তামিলনাড়ু, জেলার পর জেলা খরা কবলিত গুজরাট, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ; অন্যদিকে, বিমুদ্রাকরণের আঘাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ হারিয়ে এক বিশাল গ্রামীণ মজুত বাহিনীর ঘরে ফিরে রুজির প্রশ্নে হন্যে হয়ে পড়া অবস্থায়, তাছাড়া প্রধানত ভূপৃষ্ঠ-সেচের অভাবে চাষের ফসল শুকিয়ে যাওয়া ঠেকাতে তথা গ্রামীণ জনপথের উন্নয়ন ইত্যাদি প্রয়োজনে ‘মনরেগা’য় কর্মদিবস সৃষ্টির গুরুত্ব রয়েছে অপরিসীম। অথচ এই প্রশ্নে দায়দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গে মোদী রাজত্ব নির্মম উপেক্ষা তাচ্ছিল্য দেখিয়ে এসেছে। গড়ে একশ দিনের কাজের লক্ষ্যমাত্রা অধরা রয়ে গেছে, তা বড়জোর গড়িয়েছে ৪০ দিন। অথচ কাজের জন্য হাহাকার অবস্থার প্রকৃত মূল্যায়ন করলে বছরে ন্যূনতম ২০০ দিনের কাজের দাবি জ্বলন্ত।
কিন্তু তার পরিণতি গড়িয়েছে চরম বিপরীতে। যেহেতু প্রকল্পটাকে চাহিদা ভিত্তিক পরিকল্পিতভাবে না চালিয়ে সুচতুরভাবে বাজেট বরাদ্দ ভিত্তিক চালিয়ে আসা হয়েছে। উপরন্তু ফি বছর কমেছে বরাদ্দ, বেড়েছে কেবল দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা। আজ সম্পূর্ণ হতশ্রী অবস্থা।
সূচনাকাল থেকেই একশ দিনের মজুরি- শ্রমের কাজ নিয়ে মোদী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল চূড়ান্ত নেতিবাচক। এটি যে কৃষির সংকটকালীন পরিস্থিতিতে গ্রামীণ মজদুর শ্রেণীর অকৃষিক্ষেত্রের ন্যূনতম আয়ের একটা উৎস হতে পারে, যার ফলে চাষবাসের ক্ষেত্রেও (সেচের) পরিকাঠামোগত উপকার সম্ভব হতে পারে, এসব বিষয়ে মোদী কোনদিন গুরুত্ব দিতে চান নি। জল-জমি-জঙ্গল মায় কৃষির কর্পোরেটকরণের ও নয়া উদারবাদের ঠিকেদারিই যার ধ্যান-জ্ঞান, তিনি স্বভাবতই গ্রামীণ চাষিমুখী, গরিব মজুরমুখী কখনোই ছিলেন না। ‘চা-ওয়ালা বেটা’ আত্মপরিচিতি ফেরী করার মধ্যে দিয়ে আপন জনপ্রিয়তাবাদ নির্মাণের পথে চলতে চলতে মোড় পরিবর্তন করে পেটোয়া পুঁজিবাদের ছাতিওয়ালা হয়ে উঠতে মোদী বল্গাহীন হয়ে পড়েন। এটা বুঝতে মাঝখান থেকে পাঁচটা বছর দেখতে হল। বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। মোদী একশ দিনের কাজের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্রে অদক্ষ কাজ নিয়ে শুধুমাত্র নয়, জুমলাবাজি করেছে বছরে ২ কোটি হাতে কাজ দেওয়া নিয়ে, যার মধ্যে ধারণাগতভাবে দক্ষ-অদক্ষ উভয় ধরণের কাজের বিপুল বায়বীয় মোহ তৈরী করা হয়েছিল। পরে সবেতেই মিলেছে মূলত প্রতারণা। প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রতিশ্রুতি যে জুমলায় ভরা, সেটা ক্রমাগত ব্যর্থতার জবাব দিতে জেরবার হওয়ার পরিস্থিতিতে আর সামাল দিতে না পেরে দম্ভের সাথে বলে দেন খোদ বিজেপি সর্বভারতীয় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ্। কালের ফেরে সেই জুমলার মাশুল গুণতে হচ্ছে এখন মোদী-শাহ্ জুটিকে। সংকটাপন্ন অবস্থায় লোকসভা নির্বাচন আসন্ন হওয়ার পরিস্থিতিতে যতই নতুন নতুন জুমলার তাস খেলতে চান না কেন বিজেপিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলবে তাদের নিজেদের তৈরী ও সম্পূর্ণ উন্মোচিত পুরানো জুমলার প্রতিক্রিয়ার ভূত। মোদী-শাহ্’দের জুমলার নয়া নর্তন-কুর্দন প্রদর্শন আর বিদ্বেষ-বিভাজনের উৎকট আক্রমণ বুঝিয়ে দিচ্ছে ফ্যাসিবাদী বিজেপি পরন্তু ভূত দেখছে দেশজুড়ে, গ্রামীণ সর্বহারাদের ক্ষোভ উগরে দেওয়ার ভূত, জনপ্রতিক্রিয়ার ভূত।