শীতের পাতা ঝরার এই মরসুমটা বাংলার সংস্কৃতি জগৎকে অনেকটা রিক্ত করে দিয়ে গেল। মৃণাল সেন এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো দুই মহীরুহ ডিসেম্বরের শেষে চলে গেলেন পরিণত বয়সে, নব্বই পেরিয়ে। কিন্তু নতুন বছরের শুরুতেই একইদিনে কথাকার দিব্যেন্দু পালিতের পাশাপাশি যে কবিকে আমরা হারালাম, সেই পিনাকী ঠাকুরের বয়েস হয়েছিল মাত্র উনষাট। ভীষণভাবেই এই সময়ের সৃজনশীল কবিদের অন্যতম প্রধান ছিলেন তিনি। বিয়োগ পরবর্তী স্মৃতিচারণার প্রথাগত গণ্ডী নিরপেক্ষভাবেই বলা যায় পিনাকীর অকাল প্রয়াণে বাংলা কবিতার বড় ক্ষতি হয়ে গেল।
আশির দশক থেকেই ছোট পত্রিকার পাতায় কবিতা লিখে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করেন পিনাকী। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই একদিন, অশরীরী। এরপর একের পর প্রকাশিত হয়ে কবিতা পাঠকের মন জয় করে নেয় আমরা রইলাম, অঙ্কে যত শূন্য পেলে, হ্যাঁ রে শাশ্বত, সাত মিনিট ঝড়, বিপজ্জনক, রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, জীবন বেঁধেছি হাতবোমায়, নিষিদ্ধ এক গানের মতো, বসন্ত মস্তান, শরীরে কাঁচের টুকরো, কালো রঙের আগুন, চুম্বনের ক্ষত ইত্যাদি। শেষোক্ত বইটির জন্য ২০১২ সালে পিনাকী আনন্দ পুরস্কার পান। তবে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় বই সম্ভবত ‘অঙ্কে যত শূন্য পেলে’। ১৯৯৯ সালে এই বই প্রকাশের পরই বাংলার কবিতা জগতে পিনাকী ঠাকুরকে নিয়ে আলোড়ন পড়ে যায়।
পিনাকী কবিতায় বাংলা কবিতার মহান ঐতিহ্যটিকে সচেতনভাবেই ছুঁয়ে থাকতে চান। একেবারে প্রথম জীবনে লেখা ‘কথকজন্মের কথা’ কবিতায় তিনি লেখেন –
কত মহাজনপদ একা গাই। সন এগারোশো সাত।
এই রাঢ় বাংলার আঠালো কাদায় ডুবে গেল
আমার সামান্য গাথা। বর্ষায় ঘর ভেসে
তোমার আতপ পচে ওঠে, জ্বরে কাঁপি, ভুল বকি ঘোরে
আমার নিজের গান মুছে দেয় ভারী হাতে মহাপদাবলী!
কথকতা ছেড়ে তাই হাটুরে বেগার, যত মড়া পোড়ানোর
কীর্তনেও ডাকে আজ। ভুলে গিয়ে চারণকবিতা
মাঠেঘাটে আল বাঁধি; আমার পুঁথির ব্রজবুলি
পোকাদের কাছে দিয়ে হেসে উঠি, কাঁদি, আর আকাশরেখায়
শ্রী রাধা হারিয়ে যান; মড়কের চাঁদ গুণে ক্লান্ত হয়ে গেলে
এই জীবনের মতো তোমার কাছেও মরে যাই ...
পিনাকীর প্রথম দিককার কবিতায় কখনো কখনো পূর্বজদের উচ্চারণের রেশ শুনি আমরা। যেমন চিড়িয়াখানা কবিতার এই লাইনগুলো পড়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অতি বিখ্যাত শাশ্বতী কবিতার কথা মনে আসতে পারে –
শেষ জলধারা খুইয়ে ফেলেছি জেনে
সে যে ডেকেছিল অসময়ে মেঘমালা
বাতাস তাহার বারতা আনিল টেনে
বাঁচব বাচব : হেসে ওঠে ডালপালা
দেওয়ালের কালো নিষেধ তুলিল হায়
নিষেধের পোকা স্বর্ণের কথা বলে
দূষণে শ্রাবণ, শীতের পাখিটি যায়
মেঘের দুহাত ছাড়িয়ে যাবার ছলে।
‘অঙ্কে যত শূন্য পেলে’ বইয়ের কবিতাগুলিতে পিনাকী নিজের কবিতার ভাষাটিই শুধু পেয়ে যান তা নয়, তাকে অতি বিশিষ্ট করে তোলেন। এক জীবনে কবিতায় পিনাকী যখন লেখেন –
ফিরিয়ে দাও ট্রেনের ভাড়া, ফিরিয়ে দাও মেলাপথের
আস্ত সিকি, বরফ খেয়ে ধন্য আশা!
‘মীরাদিদির মন্টু খোকা’: রঙতামাশা
‘আদর বেশি দিলেই শিশু আশকারা পায়’...
ফিরিয়ে দাও প্রাইজ-পাওয়া রাজকাহিনী,
টিফিনবেলা লড়াই, মাথা ফাটিয়ে আসা,
ভক্তস্যার ক্লাসে ঢুকেই: ‘আমরা জানি...’
লভে পড়ার রাইকিশোরী সর্বনাশা!
হঠাৎ পাওয়া ছুটির মত খরচাপাতি ফুরিয়ে ফেলে
জীবন, আমি তোমার কাছে হাত পেতেছি,
ভরদুপুরে পাত পেতেছি, ফিরিয়ে দাও
ফিরিয়ে দাও এক জীবনে অঙ্কে যত শূন্য পেলে।
- তখন বাংলা কবিতার আসরে এক নতুন প্রজন্মের আধুনিক নস্টালজিয়ার নতুন উচ্চারণ আমরা শুনতে পাই, যার মধ্যে চিরকালীন সময়ের এক বিচ্ছেদবোধ মিশে আছে।
‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে’ কবিতায় পিনাকী যখন লেখেন –
ছেড়ে যাওয়া ভিটে, বন্দর, রাজধানী
বালির চরায় নতুন মৃত্যুফাঁদ
নদী, কাশবন, সাঁকো আর
সাঁকো দোলানোর উন্মাদ
চেনামতো যেন! ভেবেছিলে, ডেকে আনি-
ডেকে এনে দেবে বনভোজনের ভাগ?
‘আপনি আজ্ঞে’ শুনে সে তো জড়সড়
চান না করলে তাকে তুমি
খুব জবরদস্তি করো
চিনতে পেরেছঃ
পাঁচ ফুট দশ, সারামুখে ব্রণদাগ...? – তখন মিতভাষণের মধ্যে প্রেমের নাগরিক উচ্চারণের এক নতুন কবিতাভাষার জন্ম হয়। এই নতুন কবিতাভাষার সৃজনই মহৎ কবির অভিজ্ঞান, যা পিনাকী বারবার আমাদের উপহার দেন। ঘরওয়ালি কবিতায় পঞ্চদশ শতকের চণ্ডীদাসের কবিতামুখের সাথে একুশ শতকের নাগরিক ভাষাকে অনায়াসে মিশিয়ে এটা তৈরি করতে দেখি তাকে –
সুখের লাগিয়া এই ঘর বাঁধা। ঘেরাটোপ পরানো রেডিয়ো
একজনেরই কথা শোনে- একজন আলতো আদরের
চড় দিলে বেজে ওঠে: শোঁ শোঁ। খসখস। ক। খ। বিবিধ ভারতী।
ব্যাটারি বাঁচিয়ে গান, একটা চল্লিশ থেকে নিচু ভলিউমে
একেকদিন ভাল দিন যেদিন শোনায় দেবব্রত।
সুখের লাগিয়া এই জানলা ধরে দুপুর গড়ানো।
মনে মনে চিঠি লিখে মনে মনে ছিঁড়ে ফেলা সুখ।
‘আজ একটু আগে ফিরো।’ আগে মানে রাত এগারোটা।
প্রায়ই বলে ট্রেন খারাপ, কুহকিনী কেউ ধরেনি তো?
জাতীয় সংহতি নিয়ে রেডিয়োর রচনা থামছে না।
চন্দ্রাদির মতো যদি-বাংলার বধূটি ভাবে-কী মজা, আমিও
খুচরো প্রেম করে টানা দুপুর কাটাই, সে কি পাপ?
সুখ কামড়ে সুখ চুষে সুখ গিলে সুখ উগরে দিয়ে
অবেলা, ঘুমিয়ে উঠে আয়নায় চিরসুখী তার
মিলিমিটারের মাপে রোজ একটু, সামান্য, কিছু না,
রোজ একটু একটু করে বুকের মরশুম ঝরে যায়...
‘সাহিত্যিক কথ্য ভাষার মূলে রহিয়াছে কলিকাতার উপভাষা’ – ভাষার ইতিবৃত্ত বইতে লিখেছিলেন সুকুমার সেন। পিনাকী ঠাকুর ভাষাবিদের এই নিদানটির সামনে প্রশ্নের মতো সাজিয়ে তোলেন তাঁর রাতের ট্রেনে কবিতায় –
নাম শোনছেন গোয়ালন্দ? স্টিমার ঘাটে ভাতের হোটেল।
ইস রে সে কী ইলশা মাছের সোয়াদ – কী ভাই, শোনছেন নাম?
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ
দুষ্ট অসৎ হটেল-মালিক পরদেশীয়া ধুর পাইলেই
বেকুব বানায় প্যাসেঞ্জারে। কেমনে জানেন? না তো
খাইতে বইছে। অরা নিজেই ছোকরা দিয়া ঘন্টা বাজায়।
নূতন মানুষ ভাববে বুঝি জাহাজ ছাড়ার বেল দিতাসে-হুরমুড়দূর-
বয়রা তখন পাতের থিকা আমাখা ভাত, মাছের টুকরা
তুইলা রাখে। আবার যখন-
এ মা। ছি ছি-
সব হোটেলে নষ্টামি নাই। একটা দু’টা। আচ্ছা ধরেন
নারান সাহার ডি লুক্স হোটেল। খাওনটি ফ্রেস। সদব্যবহার।
ফরটি সিক্সে সেটেল করি কলিকাতায়। আর যাই নাই।
আপনে অমন হাসেন ক্যান? ও, আমার কথায়? স্টুডেন্ট বুঝি?
[সবাই নীরব]