প্রতিবেদন
‘কৃষক বন্ধু প্রকল্প’-র ভাঁওতায় না ভুলে, কৃষি ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ বেশি দামের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে

বিগত বছরগুলোতে কৃষি ফসলের লাভজনক দাম না পেয়ে এবং ঋণের দায়ে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছিল। তখন ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের এবং রাজ্য সরকারগুলোর মাথাব্যথা ছিল না। এমনকি ঋণের দায়ে আত্মহত্যাকে স্বীকার ও করেনি। কিন্তু যখন আত্মহত্যা থেকে বিক্ষোভ আজকে বিদ্রোহে পরিণত হয়েছে। প্রতিবাদ প্রতিরোধে পরিণত হচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্য থেকে রাজধানী দিল্লিতেও কৃষক বিদ্রোহের পদধ্বনি আছড়ে পড়ছে। মধ্যপ্রদেশের মান্দাসোরে গুলি চালিয়ে কৃষক হত্যা করেও আন্দোলনের জোয়ার প্রতিহত করা গেল না। এমনকি বিজেপি-র জাতিগত, সম্প্রদায়গত ও ধর্মগত হিংসা, বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতি, রাম মন্দির তৈরীর নামে অযোধ্যা অভিযানের ডাক দিয়ে ও ৫টা রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে জনগণের রায়ে ধরাশায়ী হতে হল। তারপরই কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের শাসকদলের মনে হয় যেন কিছুটা টনক নড়ল। কৃষক দরদে মন উথলে উঠলো। তড়িঘড়ি কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের সরকারগুলো ঋণ মুকুব ও বিভিন্ন ধরণের অনুদান - সংস্কারের প্রকল্পের ঘোষণা করতে শুরু করেছে। বিগত বছরগুলোতে ছিল শিল্পের নামে শাসকদের কৃষক উচ্ছেদের এজেন্ডা। আর বর্তমানে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ বিক্ষোভ আন্দোলন শাসকদের সেই এজেন্ডা থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে। আগামী লোকসভা নির্বাচনে কৃষক সমর্থন পাওয়ার জন্য কৃষকের প্রতি দরদ দেখানোর জন্যি শাসকদলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। বেশ কয়েকটি রাজ্য অনুদান ও বিভিন্ন সংস্কার ঘোষণা করেছে। এইসব ঘোষণা বর্তমান কৃষক আন্দোলনের বর্ষামুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা।

এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারও কৃষকদের জন্য কিছু সংস্কার কর্মসূচী ঘোষণার বাধ্যতা আছে। তৃণমূল শাসনে পশ্চিমবাংলায় যখন আলুচাষী, ধানচাষী, সব্জিচাষী ও পাটচাষী আত্মহত্যা করে তখন এই সরকার স্বীকারই করে না। পারিবারিক কারণ বলে উড়িয়ে দিয়ে থাকে। তৃণমূল রাজত্বে এই পর্যন্ত ১৮৭ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। অনাহারে মৃত্যুও একটিও স্বীকার করেনি। তৃণমূল নেতা দীনেশ ত্রিবেদী দিল্লিতে কৃষক মুক্তি মার্চের জমায়েতে হলফ করে বলে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের আয় তারা তিন গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদি সেই কথাই সত্যি হয়ে থাকে তাহলে কৃষক বন্ধু প্রকল্পের প্রয়োজনই বা কেন? আসলে পশ্চিমবাংলায় ও কৃষকরা আজকে আর আত্মহত্যা ও অনাহার মৃত্যুতে থেমে নেই, আন্দোলনে নামছে - ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। চলছে বিভিন্ন জেলায় ফসল রাস্তায় ফেলে অবরোধ। বড় বড় পদযাত্রা বিক্ষোভ অবস্থান। কৃষক মুক্তি যাত্রার সমর্থনে মিছিল পরিক্রমা। আদিবাসী জনগণের ৪৮ঘন্টার অবরোধ আন্দোলন। সারাভারত সাধারণ ধর্মঘট সফল করার কৃষকদের সাড়া জাগানো উদ্যোগ। কৃষক আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখে ভয় পেয়েছে।

তৃণমূলের কৃষক-বন্ধু প্রকল্পে বলা হয়েছে বছরে ২টো ফসলের উৎপাদনে একর পিছু মোট ৫০০০ টাকা অনুদান দেওয়া হবে। মানে একটা ফসলের ২৫০০ টাকা। যেখানে বর্তমানে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ধানের দাম হওয়া উচিত ২৩০০- ২৫০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল। বর্তমানে বাজারে ধানের দাম ১২০০-১৩০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল। মানে কৃষক কুইন্টাল পিছু ১০০০ টাকার বেশি দাম কম পাচ্ছে। সেখানে একরে ২৫০০ টাকা অনুদান দিয়ে কৃষকদের আয় বাড়ানোর গল্প ভোটের ভাঁওতা ছাড়া কিছুই নয়। আসলে প্রশ্ন হচ্ছে সবরকম কৃষি ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুন বেশি দাম দিয়ে সরকারকে কৃষকের ফসল ক্রয় করার ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকদের ঋণ মুক্ত করতে হলে অবশ্যই দরকার ফসলের লাভজনক দাম অথবা উৎপাদন খরচ কমানোর। সেক্ষেত্রে ডিজেলের সরকারি কর কমিয়ে এবং বিদ্যুৎ-র ভর্তুকি দিয়ে ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের দাম কমিয়ে উৎপাদন খরচ কমান সম্ভব।

আর যে অনুদান ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে অনথিভুক্ত বর্গাদার, পাট্টাহীন গরিব কৃষক এবং খরার মরসুমে যে ব্যাপক সংখ্যক গরিব কৃষক লীজে ধান চাষ করে থাকে তারা সম্পুর্ণ এই অনুদান থেকে বঞ্চিত হবে। তাছাড়া ভাগীরথী, জলঙ্গী বা অন্যান্য নদীর চরের খাস জমিতে হাজার হাজার গরিব কৃষক টুকরো টুকরো জমিতে অনেক কসরত করে চাষ করে থাকে। যাদের কোন আইনি কাগজ নেই। তারাও বঞ্চিত হবে।

অনেক ক্ষেত্রেই জমির মালিক চাষ না করেও অনুদান আত্মসাৎ করবে। তার উপর অন্যান্য অনুদানের মত তাদের পছন্দমতো লোককে দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করাবে, চলবে দূর্নীতি-দলবাজী। আর এটাই চাইছে তৃণমূল নেতারা। কেননা ভোট কব্জা করার জন্য মস্তানবাহিনী পোষার সরকারি ব্যবস্থা করতে হবে।

আর কৃষক বন্ধু প্রকল্পে বলা হয়েছে ১৮- ৬০ বছর বয়সে কেউ মারা গেলে তার পরিবারের সদস্যদের দুই লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া হবে। অতীত অভিজ্ঞতা কিন্তু বড়ই তিক্ত, কাগুজে ঘোষণা যত থাকে, তত সরকারের হাত খোলে না।

বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে ৬০বছর বেশি বয়সের বহু গরিব মানুষ হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় অথবা অনাহার-অর্দ্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। কৃষক পেনশন বা বার্ধক্য-ভাতার ব্যবস্থা করা হয়না। এইসব ভাতা কোটা ভিত্তিতে দেওয়া হয়। সকলের জন্য নয়। কেবল সরকারি দলের পেটোয়ারা পেয়ে থাকেন।

কৃষকদের সংকট যখন চরম, তখন গ্রামীণ গরিবদের সংকট আরও বেশি পরিমাণে বেড়ে চলেছে। ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলার গরিবদের বাইরে কাজের সন্ধানে যেতে হবে না, ক্ষমতা পেলে রাজ্যেই কাজের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু বর্তমানে কৃষিতে কাজ না পেয়ে ব্যাপক মাত্রায় গ্রামীণ মজুররা বাইরে কাজের সন্ধানে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। না হয় অন্যান্য কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছেন। যেমন হকার, রিকশা চালক, ভ্যান, মটরভ্যান, টোটোচালক, মুটে - মজদুর, লোডিং- আনলোডিং, তাঁত শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, ইটভাটা, রাইস মিল শ্রমিক, হিমঘর শ্রমিক, এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ। এই সমস্ত গ্রামীণ মেহনতী শ্রমজীবি মানুষের জীবনে দুর্দ্দশা চরমে। তাদের কাজে কোথাও কোন ন্যূনতম মজুরি কার্য্যকরী নেই। সন্মানজনক কাজের নিশ্চয়তা নেই। ১০০ দিনের কাজ বছরে ২০০ দিন কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ১০০ দিনও পাচ্ছে না।

দৈনিক মাথা পিছু ৬৬ গ্রাম খাদ্য শস্য ২টাকা কেজি দরে দিয়ে খাদ্য সুরক্ষা বা খাদ্য সাথী প্রকল্পের ঢাক বাজানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘরের অনুদানের টাকা আত্মসাৎ করার বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছেড়ে যাচ্ছে। ৪০ লক্ষ ঘর তৈরি এখনও শেষ হল না কেন। আমলাদের তিরস্কার করা হচ্ছে। এর বাহিরে ও টাকা নেওয়ার আশঙ্কা করছেন। বাস্তবে ৫০%টাকা তাদের দলের লোকজনই আত্মসাৎ করেছে। এখনও একজনকেও শাস্তি দিতে পারে নাই। এখন ভোট সামনে অনেক কথা বলছেন। এই সব ভাঁওতায় ভুললে চলবে না। আগের ঘোষণাগুলোর জবাব দিতে হবে। নিজ ভূমে নিজ গৃহ প্রকল্পের কি হল? পুরোনো ভবিষ্যনীধি বা পি এফ এ জমা দেওয়া টাকা গরিব মানুষ ফেরত পাচ্ছে না কেন? নির্মাণ শ্রমিক ও বিড়ি শ্রমিকদের অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হল কেন? তাই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

সমস্ত অনথিভুক্ত বর্গাদার, পাট্টা হীন গরিব কৃষক, লীজে নেওয়া গরিব কৃষক ও চরের জমি চাষ করে এমন গরিব কৃষককে অনুদান দিতে হবে।

ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ বেশি দাম দিয়ে সরকারকে কৃষকের ফসল ক্রয় করার ব্যবস্থা করতে হবে ।

সমস্ত ঋণ থেকে গ্রামীণ মজুর কৃষকদের মুক্তি দিতে হবে।

৬০বছরের বেশি বয়সের সমস্ত কৃষক ও গ্রামীণ মজুরদের ৬০০০ টাকা পেনশন দিতে হবে।

সমস্ত গ্রামীণ মজুরদের মাসিক ন্যূনতম ৫০০ টাকার কম মজুরী দেওয়া শাস্তিমুলক অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।

প্রতিটি গরিব পরিবারের বাস্তু ও ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-2