কৃষকের লংমার্চ বা দীর্ঘ পদযাত্রা দেশের কৃষক আন্দোলনে নতুন এক ধারার জন্ম দিয়েছে। যা কিনা আজ দেশের রাজনৈতিক এজেন্ডাকেই বদলে দিয়েছে। কর্পোরেট পুঁজিপতিদের স্বার্থবাহী কৃষিনীতির গতিপথকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সামনে এনে দিয়েছে কৃষকের মৌলিক দাবিগুলি। কৃষিকে “লাভজনক নয়” বলে চিহ্নিত করে আর পেছনে ফেলে রাখা যাচ্ছে না। এই সত্য আজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যে, কৃষক যদি উৎপাদনের দেড়গুন দাম পায়, যদি মধ্যস্বত্বভোগী এবং মহাজনী পুঁজির শোষনের নাগপাশ ছিন্ন করতে সরকার যথাযথ ভূমিকা নেয়, সরকারি বরাদ্দের প্রাপ্য অংশ যদি কৃষিতে নিয়োজিত হয়, তাহলে কৃষি আর অলাভজনক হয়ে থাকতে পারে না। তাই আজও প্রায় ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা কৃষির উপর নির্ভরশীল, এদের জীবন-জীবিকার দাবিতে দেশ জুড়ে উঠেছে আন্দোলনের নতুন ঢেউ। এ রাজ্যেও তার প্রভাব পড়ছে, খুব জোরেসোরে না হলেও ফল্গুধারা বা চোরা স্রোতের মতো যা বইছে। যেহেতু মোদী আর দিদির কৃষিনীতির কোন ফারাক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষকের ক্ষোভ আর জ্বালা যন্ত্রণাও তাই একই জায়গায় থাকতে বাধ্য।
এরাজ্যে কৃষকের আয় তিনগুন করার সাফল্যকে সজোরে চপেটাঘাত করেছে ঋণগ্রস্ত চাষীর আত্মহত্যার ঘটনা। বাস্তবে কৃষকের আয়বৃদ্ধির কথা গ্রামের গরিবদের কাছে এক হাস্যকর তামাসা বলেই মনে হচ্ছে, গ্রামের মানুষ জানে যে এই প্রচার আসলে শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটারদের মন জয় করার জন্য। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির একটা তথ্য বিচার করা যেতে পারে। সম্প্রতি নাবার্ড জানাচ্ছে যে, এ রাজ্যে কৃযি ক্ষেত্রে নিয়োজিত সমগ্র ব্যাঙ্ক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গত এক বছরে এই বৃদ্ধির হার ৩৯ শতাংশ। অথচ রাজ্যে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের পরিমাণ কত? এ রাজ্যে প্রায় ৭৩ লক্ষ কৃষক পরিবারের মধ্যে কার্ড রয়েছে মাত্র ১৯ লক্ষ! অর্থাৎ ব্যাঙ্ক ঋণসহায়তা পাওয়ার কথা মাত্র ২০ ভাগ পরিবারের! দেখা যাবে যাদের কার্ড আছে তাদের বহুসংখ্যকই নানা শর্তাবলী পূরণ করতে না পেরে কোনরকম সহায়তাই পায় নি! আর কার্ডনেই এমন ৮০ ভাগ রয়েছে সরকারি প্রকল্পের বাইরে। যারা মহাজনের উপর নির্ভরশীল। এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র-মধ্যচাষীরা ঋণফাঁদে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রয়েছে। তাহলে “সরকারের দ্বারা” উপকৃত হচ্ছে কারা? আয় বাড়ছে কাদের? আর যারা চুক্তি বা লিজে চাষ করে সেই বিশাল সংখ্যক ক্ষুদ্র চাষীরা, যারা কোনরকম সহায়তা পায় না, এদের নাম নথীভূক্ত করা, পরিচয় পত্র প্রদান করা হচ্ছে না কেন? বহুল প্রচারিত কিষাণ মান্ডিগুলি কার্যত চলে গেছে ফড়েদের দখলে। যেখানে সরকারি ধানকেনার নামে চলছে নতুন নতুন কায়দায় “ধান কেলেঙ্কারী”। তথাকথিত কৃষক বন্ধু রাজ্য সরকার সহায়ক মূল্যের সাথে অতিরিক্ত “বোনাস” দেবে না কেন? মোদী সরকার তো সহায়ক মূল্য নির্ধারণে চাষীদের ভালো মাত্রায় ঠকিয়েছে, আর দিদি কি দিচ্ছেন ? কুইন্টালে লোকদেখানো মাত্র ২০ টাকা? মোদী সরকার সেচে বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে। উল্টে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আর দিদি কৃষিতে বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে দিয়েছে। মোদীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরাজ্যে কৃষিবিপণন আইন সংশোধন করে সরকার কৃষিপণ্যের ব্যবসা তুলে দিয়েছে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে। যাদের লক্ষ্য অতিমুনাফা, চাষীর স্বার্থ ওরা দেখবে না। সরকার যদি বিপণনের পরিকল্পনা গ্রহন করে, চাষীকে জলের দরে ফসল বেচে আত্মহত্যার পথে যেতে হয় না।
এরাজ্যে গ্রামীণ মজুরদের কাজ মজুরি, খাদ্যের দাবি আজও তীব্রভাবে সামনে এসেছে। যৎসামান্য পরিমাণে ২ টাকার চাল অনাহার অর্ধাহারের দিনপঞ্জিকার পরিবর্তন আনতে পারে নি। কৃষিতে সরকারি মজুরি সবচেয়ে কম, ১০০ দিনের কাজেও সরকারি মজুরি দেওয়া হয় না। ১০০ দিনের কাজের টাকা নিয়ে নিত্যনতুন কলাকৌশলে চলছে লুঠের রাজত্ব। ১০০ জন রাজ্যবাসীর ২০ জন চলে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে ভিন্ন রাজ্যে। এই বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবীরা কোন কল্যাণমূলক প্রকল্পের আওতায় নেই। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার কেউই সামাজিক সুরক্ষার দায় নিচ্ছে না।
এই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ গরিবদের জ্বলন্ত দাবিগুলিতে গ্রামাঞ্চলে পদযাত্রা সংগঠিত করার পরিকল্পনা কিষাণ মহাসভার রাজ্য কমিটির বৈঠক থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। গত ৩ জানুয়ারী কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আয়ারলার নেতৃত্বের উপস্থিতি ও সহমতের ভিত্তিতে ঠিক হয়েছে যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী জেলায় এই “কৃষক ও গ্রামীণ মজুর অধিকার যাত্রা” অনুষ্ঠিত হবে। তৃণমূলের বিভিন্ন চমকপ্রদ “জনপ্রিয়” প্রকল্পগুলির স্বরূপ উন্মোচন করা ও সেগুলিতে হস্তক্ষেপ ঘটানোর লক্ষ্যে এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কৃষক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে অধিকারের প্রশ্নকে তুলে ধরতে এই পদযাত্রা সংগঠিত হবে। সহযোগী সংগঠনগুলির সাথে আলাপ আলোচনা করে এ বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা দ্রুতই গ্রহণ করা হবে।