কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলির আহ্বানে দেশজুড়ে শ্রমজীবী জনগণের দুদিনব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট সফল হতে পেরেছে। তবে চ্যালেঞ্জটা সবথেকে বেশি ছিল পশ্চিমবঙ্গে। কারণ, একমাত্র এ রাজ্যের তৃণমূল সরকারই চরম হুমকি দেয়।
ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়েছিল শ্রমজীবী জনতার একগুচ্ছ আশু জ্বলন্ত দাবি নিয়ে, আর কেন্দ্রের মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। মোদী সরকারের নির্দয় নির্লিপ্ততাই শ্রমজীবী জনতাকে ধর্মঘটের পথ নিতে প্ররোচিত করে। বিজেপির কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন বি এম এস অবস্থান নেয় ধর্মঘটের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ কেন্দ্রের শাসকের পক্ষে। একইসাথে তৃণমূল পরিচালিত আই এন টি টি ইউ সি ধর্মঘটের বিরোধিতার অবস্থান গ্রহণ করে, যেহেতু মমতা সরকার এই ধর্মঘটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে; আর তাদের সরকার যেহেতু অবস্থান নেয় ধর্মঘটের বিরুদ্ধে, তাই শাসক দল তৃণমূলের অবস্থান হয়ে দাঁড়ায় পুরোপুরি হামলাকারীর। তৃণমূল সবশুদ্ধু মিলে দমনমূলক অবস্থান নেওয়ায় রাজ্যে সহমতের দল হিসেবে পেয়েছে একমাত্র বিজেপিকে, এটা ঘটেছে নিশ্চিতভাবেই গেরুয়া দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে। দেখা গেল ধর্মঘটের বিরোধিতায় কেন্দ্রের- রাজ্যের দুই শাসকদলের এক অর্থেকি বিচিত্র মিলিজুলি চেহারা, অন্য অর্থে কি বিপজ্জনক সহাবস্থানের বার্তা!! তবে রাজ্যের বিজেপি যে ধর্মঘটের সক্রিয় বিরোধিতায় না নামার অবস্থান নেয় তার পিছনে অতি চালাকির স্বরূপটা হল, দমনের দায়ভাগটা যাতে বিজেপির গায়ে না লাগে সেটা এড়িয়ে যাওয়া, কারণ মোদী পার্টিকে এরাজ্যে মাথা তোলার কৌশল নিতে হচ্ছে এক ঢিলে দুই পাখী মারার; নিজের দেশজোড়া গণতন্ত্রবিরোধী চেহারা থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে এখানে তৃণমূলের গণতন্ত্রবিরোধী চেহারাকে পুঁজি করে চলার। তৃণমূলও হয়ত মুচকি হাসি হাসছে এটা ভেবে যে, অন্তত এই নির্দিষ্ট জ্বলন্ত প্রেক্ষিতে তৃণমূল বিরোধী ফায়দা তোলার কোন সুযোগ বিজেপি পেল না। কিন্তু কথায় আছে, চালাকির দ্বারা সর্বদাই বোকা বানানো যায় না। এবারের ধর্মঘটের মুখোমুখি হয়ে ফ্যাসিবাদী বিজেপি আর স্বৈরাচারী তৃণমূলের অভিন্ন চরম বিরোধী শ্রেণীচরিত্র উন্মোচিত হয়ে গেল। এই দুই রাজনৈতিক প্রবণতা অবধারিত তাড়নায় পারস্পরিক ‘বিকল্প’ হয়ে ওঠার ন্যক্কারজনক প্রতিযোগিতায় মত্ত হতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে মেহনতী জনগণের কোন স্বার্থ প্রতিফলিত হচ্ছে না, বরং তাকে দমনের দৃষ্টিভঙ্গি ধরা পড়ছে। ধর্মঘট দমন করতে মমতা সরকার পুলিশী আক্রমণে ও তৃণমূল গুন্ডামী চালাতে কতদূর যেতে পারে সেটা দেখা গেল। আর, সব বুঝেও বিজেপি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাতে বা কিছুই পু্ঁজি করতে পারল না, মূক হয়ে থাকতে হল।
দু’দিনের টানা ধর্মঘটী লড়াইটা শ্রমজীবী জনতাকে চালাতে হয়েছে কেন্দ্র-রাজ্যের সরকারপক্ষের শ্রমস্বার্থবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শুধুমাত্র নয়, লড়তে হয়েছে কর্পোরট পু্ঁজি নিয়ন্ত্রিত ও পুঁজির তল্পিবাহক শাসকদলের ভজন-কীর্তন করে চলা মিডিয়ার মোকাবিলা করেও। এহেন প্রচার-মাধ্যম গোড়া থেকেই ধর্মঘটের দাবিগুলির কি সুরাহা হবেসেই নির্দিষ্ট প্রশ্নে সরকারপক্ষকে কোন বেগ দিল না, গণতন্ত্রের চতুর্থস্তম্ভের দায়িত্ব পালন করল না, কোন ইতিবাচক মনোভাব থেকে আলোচনা বা বিতর্ক চালানোর ন্যূনতম দায় পালন করেনি। বরং সে প্রসঙ্গ সরিয়ে রেখে বিপরীতে ধর্মঘটের বিরোধিতায় যেন শাসক পক্ষের ‘পঞ্চম বাহিনী’র ভূমিকা নিল। ধর্মঘটের কর্মসূচীকে ‘কর্মনাশা’ তকমা দিয়ে দিল। মোদী সরকারের কর্মনাশা ও মজুরিঘাতী শ্রমনীতি নিয়ে চুপ থাকল। কুৎসিত আক্রমণ করল প্রতিবাদে প্রতিরোধে পথে নামা শ্রমজীবী শক্তিকে, তাদের প্রতিনিধিত্বকারী ইউনিয়ন ও ফেডারেশন সমূহকে, সমর্থনের অবস্থান নেওয়া বাম ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে। এমনকি ধর্মঘটের দু’দিন ধরেও একই জঘন্য ভূমিকা রাখে। ধর্মঘটিরা যে আক্রান্ত হল পুলিশী আচরণে, শাসকদল তৃণমূলের হামলায়, তার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় তুলল না, উল্টে দু’একটি যে অনভিপ্রেত সামান্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে সেটাকেই বেশী চিত্রিত করল। অথবা স্তব্ধ শিল্পাঞ্চলকে প্রধান গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনল না, ধর্মঘটের ‘কোন প্রভাব পড়েনি’ বোঝাতে উঠে-পড়ে লাগে।
এত অসম লড়াইয়ের পরিস্থিতির মোকাবিলা করে ধর্মঘট করতে হয়েছে বলেই এক বিশেষ রাজনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ধর্মঘটের হাতিয়ারকে ইতিহাসের জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার পন্ডিতী অভিশাপ শ্রমজীবী শক্তিকে নিজের লক্ষ্য থেকে নিবৃত্ত করতে পারবে না। এ পশ্চিমবঙ্গের ‘পরিত্যক্ত’ সংস্কৃতি নয়, এর নয়া জাগরণ ঘটছে দেশজুড়ে ধর্মঘট সংঘটিত হয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সুদূর প্যারিসে, দুনিয়ার দে দে যেখানেই অনিবার্য হয়ে পড়ছে সেখানেই।
যে ধর্মঘটী বার্তা শ্রমজীবী শ্রেণী দিল, দেখা যাক তার লিখন শাসকশ্রেণীর কেন্দ্র-রাজ্যের প্রতিনিধিরা কেমন পড়ে!