বিজেপি বাংলায় 'গণতন্ত্র বাঁচাও' রথ বের করতে পারার আগেই হিন্দী বলয়ের তিন রাজ্যে রথের চাকা বসে গেল। অনুমান ছিল মোদী জমানার মোহাবিষ্টকরণের পারদ আর উঠছে না, ক্রমেই নামছে; তবু সময়ের লিখন পড়তে না চাওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে এসেছে। যে হিন্দী বলয়ের ভিত্তিতে বিজেপির উত্থান, সেখান থেকেই মিলতে শুরু করেছে একের পর এক তেতো 'সন্দেশ', উপনির্বাচন ও নির্বাচন, পৌরসভা কিংবা বিধানসভা, যাইই হোক, গুণতে হয়েছে ফ্যাসিবাদী জুমলাবাজী আর জুলুমবাজীর মাশুল, বনতে হয়েছে বুদ্ধু এবং হেরো। তবে সময় যে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগেভাগে এতটাই নির্মম রসিকতার পাত্র করে তুলবে সেটা বোধহয় গেরুয়া নেতৃত্ব ততো ভেবে উঠতে পারেনি।
বাংলায় থাবা বিস্তারের লক্ষ্যে রথযাত্রার কর্মসূচী তৈরি করেছে বিজেপি বেশ সুপরিকল্পিতভাবেই। সঙ্গে রয়েছে সংঘ পরিবারেরও পরিকল্পনা। উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গের যে তিনটি পয়েন্ট থেকে রাজ্যের সমস্ত লোকসভা কেন্দ্র পরিক্রমার নকশা তৈরি সারা, তার প্রত্যেকটা যাত্রাশুরুর গেরুয়া পতাকা নাড়ার কথা দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ্-র। তাছাড়া, আসার কথা স্বয়ং মোদী সহ যে তিনটি রাজ্য সদ্য হাতছাড়া হল তার মুখ্যমন্ত্রীদের, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মায় দলের আরও সব ওজনদার নেতাদের। সর সংঘচালক মোহন ভাগবত পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনী রায় প্রকাশের আগেই রথযাত্রার বিজেপি-আরএসএস সমন্বয় প্রস্তুতি চূড়ান্ত খতিয়ে দেখতে চার দিনের কর্মসূচী নিয়ে এসেছেন। তবে এই গেরুয়া যাত্রা শুরুর আগে মুশকিলে পড়েছে। প্রথমত, তৃণমূল সরকার প্রশাসনিক নিরাপত্তা দিতে অপারগতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করায়, যার প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি যায় আদালতে, আদালত বিরোধ নিষ্পত্তির বল ঠেলে দিয়েছে উভয়পক্ষের কোর্টে, রাজ্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে বিজেপির প্রতিনিধিদের সাথে বসে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে। বিজেপি প্রচার করছে আদালতের আদেশে তার জয় সূচীত হয়েছে। এর পরিণতি কোথায় সেটা পরবর্তীতে আরও বোঝার। এমনকি তিন রাজ্যে ধরাশাহী হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি নেতৃত্ব বাংলার রথ কর্মসূচী নিয়ে কোন্ মানসিকতা দেখায় সেটাও একটু সবুরে পরখ করার। তাদের কর্মসূচীতে পরিস্থিতিকে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতিতে বিষিয়ে তোলার উদ্দেশ্যপ্রণোদনা থাকার অভিযোগ অস্বীকার করতে অমিত শাহ যা বলেছেন তা অতীব মিথ্যাচার। শাহের সওয়াল হল, এরাজ্যে বিজেপির কর্মযজ্ঞের ফলশ্রুতিতে সম্প্রীতি নষ্ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি হয়েছে প্রমাণ করার মতো একটিও নাকি নজীর নেই! হায়, নৈহাটি, ধূলাগড়, বাদুরিয়া, বসিরহাট, বারাসাত, আসানসোলে বিজেপি কি 'কীর্তি' স্থাপন করেছে কার আর জানতে বাকী আছে! গেরুয়াদলের রথযাত্রার কর্মসূচীতে 'গণতন্ত্র বাঁচানোর' ধূয়ো তোলা সহ 'বেআইনী বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ', 'রোহিঙ্গা সমস্যা' 'সংখ্যালঘু তোষণ', 'এনআরসি' ইত্যাদি জিগির তোলারও পরিকল্পনা রয়েছে, যেসব বিষয়ে ফয়সালা চাওয়ার নামে চালাবে ফ্যাসিবাদী মেরুকরণের রাজনীতি, তৈরি করবে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পরিমন্ডল। কিছুদিন আগেও যার পরপর মহড়া দিয়েছে উত্তর দিনাজপুরের দাড়িভিটে, কোচবিহারের সালবাড়িতে। বিজেপির পাখীর চোখ উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে বাংলাদেশের লাগোয়া জেলাগুলোতে, বিশেষত নতুন জায়গা পাওয়া আদিবাসী-বনবাসী অধ্যূষিত প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে। 'বনবাসী পরিষদ' নামে তার সংগঠন আছে, 'আদিবাসী বিকাশ পরিষদ'-এর ওপর তার প্রভাব আছে, ভেতরেও অনুপ্রবেশ আছে। এরাজ্যে বলাবাহুল্য, বিজেপি-আরএসএস উভয়েই শাখা অনেক বাড়িয়েছে। অর্থাৎ বানাতে পেরেছে একটা ভিত, যার উপর দাঁড়িয়ে বড় লাফ দিতে চায়। এভাবে, রাজ্যে রাজ্যে এবং কেন্দ্রে ক্ষমতার জোরে গণতন্ত্রের হত্যাকারী বিজেপি এরাজ্যে জমি বাড়াতে ভেক ধরছে 'গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের' পরিত্রাতা সাজার! অন্যদিকে, 'বিজেপির শেষের শুরু'র আওয়াজ দিয়ে তৃণমূল নেত্রী নিজেদের 'পবিত্রতা' জাহির করতে চাইলেও সেটা বিরুদ্ধতার ধোপে টিকছে না। অনবরত প্রমাণিত হয়ে চলেছে, বিজেপির এখানে পল্লবিত হয়ে ওঠার পেছনে একটা বাহ্যিক দৌরাত্মের প্রভাব যেমন রয়েছে, তেমনি এরাজ্যের অভ্যন্তরীণ কিছু শর্তও পেকেছে, যার প্রধান কারণ হল তৃণমূল রাজত্বে গণতন্ত্র হরণ, গণতন্ত্রের নিধন, প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত পরিসরে; প্রধানত স্বৈরাচার চালানো ও হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে 'ঠেকানোর' নামে ওদেরই দ্বারা চাপ সৃষ্টির পার্বণ পালনের সাথে রকমফের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠার দুর্মতিতে তৃণমূল খাল কেটে গেরুয়া কুমীর ডেকে আনছে। বিজেপির বেড়ে ওঠার অপ্রধান অপর কারণটা হল বামপন্থী শক্তিগুলোর পর্যাপ্ত শক্তি নির্দ্ধারক না হয়ে উঠতে পারার দুর্বলতা। তৃণমূল চুলোয় যাক। বামপন্থীদের বিজেপিকে প্রতিহত করেত অবশ্যই দৃঢ়তা, সাহস ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে দ্রুততার সাথে আগুয়ান হতে হবে, বড় শক্তি হয়ে ওঠার প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে।