বাংলার বামপন্থী শক্তিসমূহের বড় অংশের নেতৃত্ব ফের সিঙ্গুর নিয়ে উল্টো সুরে কেন? সিঙ্গুর থেকে রাজভবন লঙ মার্চ নতুন কোনো আশার বাণী শোনানোর বদলে নিজেদের ফের প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল। বিশেষত যখন দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে রাজধানী দিল্লীতে অভিযান করে সমাবেশিত হলেন হাজার হাজার কৃষক, তাদের হক আদায়ের দাবি তুলে, ঋণ মুক্তি আর সহায়ক মূল্যের দাবিতে, যে সমাবেশে এরাজ্য থেকেও কৃষকরা সামিল হয়েছিলেন, এরাজ্যের বড় বাম দলটিও তাদের কৃষক সংগঠনকে দেশব্যাপী এই কৃষক জাগরণ ও প্রতিরোধ মঞ্চে শরিক করেছে, দিল্লী অভিযানে অংশীদারী হয়েছে, হয়ত সিঙ্গুর থেকেও কৃষকদের দিল্লী অভিযানে সামিল করিয়ে থাকবে; তাহলে আবার সিঙ্গুর থেকে একেবারে উল্টো সুরে কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের মিছিল করানো হল কেন! দিল্লীতে সাড়া জাগানো কর্মসূচী সংঘটিত হল, দেশজুড়ে তার বার্তা গেল। কিন্তু সিঙ্গুর থেকে নেওয়া কর্মসূচী? এর মধ্যে নাসিক থেকে মহারাষ্ট্র কৃষক অভিযানের স্মৃতি উস্কে দেওয়ার সাযুজ্য দেখানো সম্ভব হয়নি। কয়েক হাজার কৃষিজীবীদের দীর্ঘ পথ হাঁটানো হল, তারা অনেক ঘাম ঝরালেন, কিন্তু তার রাজনৈতিক দাম মিলল না, না পেল তার সংগঠক দল, না পেল দলের কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠন। সবটাই রাস্তায় পরিত্যক্ত হয়ে থাকল। দলনেতারা দিল্লীর কর্মসূচীতে সিঙ্গুর থেকে নেওয়া বিপরীত শ্লোগানের কর্মসূচীর কথা বড় মুখ করে বলতে পারলেন না। এই রাজ্য এই দেশের কোনো অংশেই বৃহত্তর বাম-গণতান্ত্রিক পরিসরে তা কোনো তাৎপর্যের বার্তা প্রচার করতে সফল হল না। উল্টে বাড়িয়েছে উদ্বেগ বিড়ম্বনা বিরক্তির প্রতিক্রিয়া। আসল বিষয় হল, ‘শিল্পায়নের’ নামে কৃষকের জমি গ্রাসে কর্পোরেট পু্ঁজির স্বার্থবাহী যে শরিকী পলিসি নেওয়া হয়েছিল, সেই কলঙ্কিত নীতির জের শুধু ক্ষমতা থেকে নয়, এরাজ্যে মূল ধারার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রধান অবস্থান থেকেও অনেক নীচে নামিয়ে দেয়, দল পড়ে যায় সংকটের আবর্তে। নীতিগত প্রশ্নে নীচতার পরিচয় দিলে পরিণাম হয় এরকমই। এই সংকট অতিক্রম করতে হলে একদিকে দরকার ভুল স্বীকার ও অকপট আত্মসমালোচনা এবং অন্যদিকে কৃষকের জমিগ্রাস বিরোধী দৃঢ় অবস্থান নেওয়া। এই দুটো দিকের মধ্যেকার শর্তকারণ সম্বন্ধটা ওতপ্রোত। কিন্তু সিঙ্গুরে কৃতকর্মের অপরাধ তার পরিচালক দলটি আজও স্বীকার করেনি, রয়ে গেছে সম্পূর্ণ অনড় অবস্থানে, তাই যদিও পরবর্তীতে বিরোধী বাম অবস্থান থেকে ভাঙ্গরের জমি ও পরিবেশ রক্ষার যুক্ত আন্দোলনে জড়িয়েছে, তবু তথাকথিত ‘ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক’ সমীকরণের ধুয়ো দিয়ে, ‘চাষবাস হচ্ছে না’ ও ওমাটিতে ‘শিল্প করতে দেওয়া হল না’ জিগির তুলে উপরোক্ত বাম ধারার নেতৃত্ব আজ আবার সিঙ্গুর নিয়ে অহেতুক মাতন তোলায় প্রবৃত্ত হচ্ছে। এভাবে সিঙ্গুরের কৃষক জনতার আকাঙ্খাকে আবারও অপমানই করা হচ্ছে। উপরন্তু ভ্রান্ত পথে সেখানকার কৃষিজীবীদের মধ্যে ফের অবাঞ্ছিত দ্বন্দ্ব-বিবাদ লাগানোই সার হবে।
অথচ সিঙ্গুরেও কেন্দ্র-রাজ্যের সরকারদ্বয়কে কৃষি সম্পর্কিত দেশজোড়া উত্তাল হয়ে ওঠা দাবিগুচ্ছের নির্দিষ্টকরণের ভিত্তিতে চেপে ধরার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া, তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে উদ্ধারিত জমি ফেরত নীতির রূপায়ণ নিয়ে বহু চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তার সাথে রয়েছে ডোল নীতির কার্যত বাস্তবায়ন ও পঞ্চায়েতী প্রাপ্য মেলার প্রশ্নে বেড়ে চলা অসন্তোষ। এগুলোই তো হতে পারে কৃষক আন্দোলনের মূল সুরে সুর মেলানোর সূত্র। পাশাপাশি কাজের দাবিতে ‘শিল্প কোথায়’, ‘বন্ধ কারখানা খুলছে কোথায়’, ‘বন্ধ হচ্ছে কেন’, এইসব দাবিতে জোরদার আন্দোলন হোক, কিন্তু তার সাথে সিঙ্গুরকে ফের জড়ানো বা জট পাকিয়ে তুললে সেটা হবে আরও একবার রাজনৈতিক হারাকিরি।
ফ্যাসিবাদের ও স্বৈরাচারের বিদ্বেষ-বিভাজন, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক হামলা তথা গণতন্ত্রের হত্যাকারীদের ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও প্রদানের’ ভেকধারীর মোকাবিলায় আজ যখন বাম ও বাম-গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ সবচেয়ে জরুরি, অত্যন্ত আবশ্যিক তার বৃহত্তর দৃঢ় ঐক্য, তখন এমন কোনও অনভিপ্রেত ইস্যু তোলা উচিত নয় যা যুক্ত সংগ্রামী উদ্যোগ ও ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিড়ম্বনায় ফেলে। বরং আজকের সময়োচিত সজাগতা-সচেতনতার প্রমাণ দিতে ঐকমত্যের বিষয়গুলিতে সমমর্যাদার ভিত্তিতে অনুশীলনকেই জোরদার করা প্রয়োজন। এই অনুশীলনী প্রয়াসের অবিচলতার মধ্যে দিয়ে এবং জনগণের আন্দোলন গড়ে তুলেই বামপন্থী শক্তিগুলোর নতুন করে আশা জাগানো উত্থান ঘটানো সম্ভব।