তৃণমূল লোকসভা নির্বাচনকে পাখীর চোখ করতে শুরু করেছিল পাঁচ মাস আগে থাকতে। তাদের বাৎসরিক ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে। সমস্ত বিরোধী দলগুলোর ভোট বিজেপি-র বিরুদ্ধে এক জায়গায় করার কথা বলে। আর যে দল যেখানে শক্তিশালী সেখানে তার প্রার্থী দেওয়ার অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত সূত্র তুলে ধরে। কিন্তু এখনাবধি তৃণমূলনেত্রীর এই অঙ্ক জাতীয় ও আঞ্চলিক চরিত্রের অ-বাম দলগুলোর কোন উল্লেখযোগ্য চর্চায় স্থান পায়নি। নেত্রী মাঝেমধ্যেই রাজধানীর রাজনীতি করতে যাওয়া আসা করছেন, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। সবই নির্দিষ্ট অর্থে আজ পর্যন্ত নিস্ফলা। এই বায়বীয়তা আড়াল করতে অনেক আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ডেকে বসেন নিজের দলের ব্রিগেড সভা এবং আমন্ত্রণ জানিয়েছেন নাকি গুচ্ছের বিরোধীদলের নেতাদের। তবে তাদের মধ্য থেকে কারা আসবেন না-আসবেন তার কোন সবুজ সংকেত এখনও দেখা যাচ্ছে না। একমাত্র সাড়া দেওয়ার বহর দেখালেন অন্ধ্র নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু। তিনি মাসখানেক আগে এরাজ্যে সেরে গেলেন এক ঝটিতি সফর। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে খুব দাবি করলেন মোদী-র বিরুদ্ধে যোগ্য মুখ হয়ে ওঠা বলে এবং তাঁর সূত্রায়িত বিরোধীপ্রার্থী মনোনয়ন পলিসি সঠিক উল্লেখ করে। কিন্তু মমতাও যেমন বিরোধী দলগুলোর আসরে বিশেষ সমাদর পাচ্ছেন না, তেমনি চন্দ্রবাবুও বিরোধী কনক্লেভের ময়দানে বহুদিন হল বিশেষ কল্কে পান না। সুতরাং মমতা-চন্দ্র মতৈক্য যদি কোন স্তরে কাঁচাপাকা হয়ে গিয়েও থাকে তাতে পারস্পরিক লাভেরও কিছু নেই, কারণ তারা যে দু'রাজ্যের নেতা-নেত্রী সেখানে একজন আরেকজনের প্রভাব কাজে লাগাতে পারবেন না। আর তা বিরোধীপক্ষের ব্যাপকতর ঐকমত্য তৈরীতেও বিশেষ প্রভাব ফেলার মতো নয়। তাছাড়া, উভয়পক্ষেরই সুবিধাবাদী অভিন্ন এক অতীত আছে, সেটা হল কংগ্রস বিরোধিতার সূত্রে এন ডি এ শরিক হওয়ার বকলমে লোকের চোখে বিজেপি শিবিরে ভিড়ে যাওয়া। অতীতের সেই অবিশ্বস্ত অদৃঢ় নজীর তৈরীতে জড়িয়ে যাওয়ার কালি তোলা সহজ নয়। ফলে পরম্পরায় খাঁটি বিজেপি বিরোধী এমনটা বিশ্বাস করানো সম্ভব নয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিরোধিতা করেও বাজপেয়ী সরকারে শরিক হয়েছিল তৃণমূল। তারপর অবশ্য ঐ সরকারের গায়ে দুর্নীতির কালি লাগার প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূল বেরিয়ে আসে। যাক সে কথা। তারপরে তো বাংলায় ক্ষমতায় এসে, খোদ দলনেত্রী সহ তৃণমূলের ডাকাবুকো ডজন ডজন নেতা-মন্ত্রীর গায়ে লেগেছে নানা চিট ফান্ডের লুঠ ও প্রতারণার সঙ্গদোষের কলঙ্ক। সে দূর্নামও মুছে ফেলা যায় নি। ইতিমধ্যে মোদী জমানা পৌঁছে গেছে আকাশছোঁয়া নানা কেলেংকারী ও দুর্নীতির চূড়ায়। কিন্তু তাকে সাচ্চা চ্যালেঞ্জ জানানো তৃণমূলের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। যার নিজের লেগেছে কালি সে আর বহুগুণ বেশী কলঙ্কিত বিজেপিকে কোন্ মুখে আর কত চেপে ধরতে পারবে! আস্ফালন দেখানোই সার।
তৃণমূল ব্রিগেডের সভা ডেকেছে কেন্দ্রের হাতে বিশেষত পেট্রোপণ্য সহ সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি, ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, এন আর সি, বিজেপি-র বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু এইসব ইস্যুতে সংসদের ভেতরে-বাইরে কোন ঝড় তোলার পথ নেয়নি। সুতরাং কীসের তার প্রার্থী প্রদান পলিসির মোড়লি ফলানো? 'যে দল যেখানে শক্তিশালী' সূত্র বাতলানো হচ্ছে সেটা তথাকথিত 'ফেডারেল'পনা দাবি করতে। কিন্তু তার ভিত্তি ধরা হবে কীসে? যে দল যেরাজ্যে শাসনক্ষমতায় রয়েছে তার ভিত্তিতে! যে দলের কাছে লোকসভা আসনটি রয়েছে অথবা সংখ্যায় বেশী আসন রয়েছে ভিত্তিতে? কিন্তু মজুদ আসন তো বিচার-বিশ্লেষণের ভিত্তি হতে পারে না। কারণ গতবারের লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল কেন্দ্রে কংগ্রেস রাজত্বের বিরুদ্ধে। এবারের নির্বাচন হতে চলেছে ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে হটানোর নির্ধারক লক্ষ্যে। কংগ্রেস আর বিজেপি অনেক নীতিতে মিল থাকা সত্ত্বেও হুবহু এক চরিত্রেরও নয়, আর ২০১৪-র এবং ২০১৮-র নির্বাচনী পরিস্থিতির মধ্যে ফারাকটাও একেবারে গুণগতভাবে বদলে গেছে। তাই ২০১৪-র নির্বাচনে ভোট ও আসন প্রাপ্তির মাপকাঠি এবারের পরিস্থিতিতে অগ্রাধিকার নির্ধারণের মূল সূত্র হতে পারে না। এমনকি গত বিধানসভা নির্বাচনে পাওয়া ফলাফলগুলোকেও ভিত্তি হিসেবে ধরা যায় না। বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলেও রং পাল্টাচ্ছে, দিক পাল্টাচ্ছে, যেমনটা সদ্য সদ্য মালুম পেল প্রধানত বিজেপি নয়, এমনকি কিঞ্চিৎ কংগ্রেসও। তাই সবদিক থেকে বিচার করলে বিগত ভোট, আসন, এগুলো প্রার্থী প্রদানে অগ্রাধিকার পাওয়ার ভিত্তি হতে পারে না। বরং সেই ভিত্তি নির্ণয় হওয়া উচিত কেন্দ্রের মোদী জমানা সহ রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি তথা বিজেপি জোট সরকারগুলোর বিরুদ্ধে কারা লড়াই চালিয়ে আসছে। এমনকি অ-বিজেপি সরকারগুলোর জনবিরোধী নীতিগুচ্ছের বিরুদ্ধে কারা লড়াই করে আসছে। এই তুলনায়, আন্দোলনে হিম্মতের সাথে লাগাতার নেতৃত্ব দেওয়ার সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রেখে আসছে বামপন্থী শক্তিগুলো, এছাড়া আন্দোলনে ধেয়ে এসেছে বেশ কিছু নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক-আঞ্চলিক ও ক্ষেত্রভিত্তিক বাম ঘেঁষা বা অ-বাম গণতান্ত্রিক শক্তি। পক্ষান্তরে, তৃণমূল কেন্দ্র বিরোধী কোন আন্দোলনের ধার ধারে নি, নিছক কখনও সখনও কিছু প্রতীকি ভঙ্গি প্রদর্শন ছাড়া। বরং পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল আমল চালাচ্ছে আন্দোলন দমনের স্বৈরাচার। বিজেপির কট্টর হিন্দুত্বের চাপের সামনে নেমে পড়েছে ধর্মীয় উৎসবে সরকারের আর্থিক মদত যোগানোয়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা নিছক কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যেকার সংঘাতের বা রাজ্যের শাসকদলের কিছু মুষ্টিভিক্ষা দিয়ে সেরে ফেলার নয়। এই লড়াই গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে সব ধরণের ধর্মবর্জিত ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য, আর তার সাথে জনগণের জীবন-জীবিকার স্বার্থের জন্য। এই সমস্ত লড়াই এক একীকৃত বুনোটেই চালিয়ে যাওয়ার। এই মৌলিক বিষয়টিকে ধর্ত্যব্যের মধ্যে না রাখলে কিছু অশুভ সুবিধাবাদী আঁতাত তাদের খাস স্বার্থ হাসিল করতে মরীয়া হবে। তৃণমূলের বিজেপি বিরোধিতার দৌড়টা আপন শাসনের রাজ্যে আখের গোছানোর। এটা করতে গিয়ে অন্য কোন অ-বিজেপি রাজ্য সরকার যা করার ধৃষ্টতা দেখায় নি, তৃণমূল সরকার সেই নীতিগত অপরাধও করেছে। কেন্দ্রের মোদী নীতির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনতার ধর্মঘটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, দমন নীতি নিয়েছিল, উৎপীড়ন চালিয়েছিল। তাই তৃণমূলকে মাফ করা যায় না। এই দিশা ও লক্ষ্যের অন্তর্বস্তু ব্যতিরেকে ফ্যাসিবাদ হটাও অভিযানে কোন মৌলিক তাৎপর্য থাকবে না। পুনরুত্থানের জমির অবশেষ থেকে যাবে। যে কারণে বাজপেয়ী জমানার অবসান হলেও একদশকের মধ্যেই আবার 'কংগ্রেসমুক্ত ভারত' নির্মাণের আওয়াজ তুলে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পেরেছে, ফ্যাসিস্ত জমানার শুরুয়াৎ করতে পেরেছে। ঠিক যেমন দেশজুড়ে বিজেপি হটাও পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলায় তৃণমূলের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে পুঁজি করে বিজেপি জমি তৈরীর সুযোগ পাচ্ছে। এই কারণে এখানে ক্ষমতায় না থাকলেও বিজেপি বামপন্থী শক্তিগুলোর সামনেও বিরাট বিপজ্জনক। উপরন্তু তার মাথার ওপর আছে আর এস এস, তাই বিজেপি হটাও এক নিরন্তর চলমান সংগ্রামের বিষয়, এবং সেই সংগ্রামের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ হিসেবেই আগামী লোকসভা নির্বাচনে লড়তে হবে, সেই অভিজ্ঞতা ও নতুন নতুন নজীর সৃষ্টির ভিত্তিতে আসন বন্টনের বোঝাবুঝিতে অগ্রাধিকার দেওয়া থেকে শুরু করে বুথ স্তর পর্যম্ত আগ্রাসন প্রতিরোধ সুনিশ্চিত করতে হবে যে কোন মূল্যে। এই পরীক্ষায় তৃণমূলের অবস্থানও বুঝে নিতে হবে তার আগামী ব্রিগেডের সভার আগে ৮-৯ জানুয়ারী দেশব্যাপী শ্রমজীবী জনতার ধর্মঘটে।