প্রতিবেদন
ঐক্যবদ্ধ কৃষক প্রতিরোধ যখন ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিল

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮)

দাঙ্গাবাজ জনতার হাতে সংঘটিত এবং টিভি-তে সম্প্রচারিত আধুনিক ভারতের সবচেয়ে মর্মঘাতী ধ্বংসোন্মাদনার ঘটনাটি ঘটার পর ছাব্বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। রাম জন্মভূমি আন্দোলন যদি বিশাল আকারে সাম্প্রদায়িক সমাবেশের সংঘ-বিজেপির অভিপ্রায়ের প্রথম দৃষ্টান্ত রূপে সামনে এসে থাকে, তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস সুস্পষ্ট রূপে দেখিয়েছিল যে, তার ফ্যাসিস্ট অ্যাজেন্ডার চরিতার্থতায় বিজেপি কিভাবে সংবিধানের তোয়াক্কা না করে আইনের শাসনকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বরের সর্বনাশা অপরাহ্নের পর থেকে ফ্যাসিস্টদের হাতে ঘটা রাষ্ট্রের বহু বিপর্যয়ের সাক্ষীই আমরা থেকেছি, যদিও 'মন্দির ওখানেই বানাবো' শ্লোগানের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এখনও ঘটেনি। ২০১৯-এর গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন এগিয়ে আসায় সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত কলঙ্কিত মোদী সরকারের পরিত্রাণে আরো একবার অযোধ্যার উপরই ভরসা করছে।

এমন একটা আইন তৈরি করুন যার ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের স্থানে মন্দির নির্মাণ সম্ভব হয়—মোদী সরকারের কাছে এই আর্জি পেশ করে মোহন ভাগবতই বিষয়টার সূচনা ঘটান। আইনের আদালতগুলো অযোধ্যা নিয়ে এখনও তাদের চূড়ান্ত রায় দেয়নি। মসজিদ ধ্বংস সম্পর্কে ফৌজদারি মামলা এখনও চলছে এবং চলছে 'বিতর্কিত জমি' নিয়ে মালিকানা সম্পর্কিত মামলা। সংঘ পরিবার কিন্তু আইনি পথ নিয়ে চাপাচাপি করছে যাতে করে এই ইস্যুকে ধরে সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক মেরুকরণকে তীব্রতর করে তোলা যায় এবং আমাদের রাষ্ট্রীয় সমাজে যেটুকু ধর্মনিরপেক্ষতা এখনও অবশিষ্ট রয়েছে তাকে ক্ষইয়ে-ক্ষইয়ে ফোঁপরা করে দেওয়া যায়। পাল্লা দিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে শিব সেনাও অযোধ্যা নিয়ে নতুন উদ্যমের প্রচারে নিজেদের সামিল করে। মিজোরাম, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানা—এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনও বিজেপির কাছে সাম্প্রদায়িক প্রচারকে উচ্চগ্রামে তোলার মঞ্চ হয়ে ওঠে, যাতে নেতৃত্ব দেন বিদ্বেষ বচনে অভ্যস্ত উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী।

কিন্তু এবার অন্ততপক্ষে সম্প্রসারিত হিন্দুত্ব শিবিরের বিবিধ শক্তিগুলো দ্বারা চালিত অযোধ্যা অভিযান পর্বতের মূষিক প্রসব হয়েই দেখা দিল। বস্তুত, অযোধ্যার স্থানীয় জনগণের অসন্তোষ অত্যন্ত প্রকট হয়ে সামনে এসেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরপ্রদেশের যে শ্রমিকদের মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তারা যখন ঐ রাজ্যগুলোর উৎপীড়কদের উত্তরপ্রদেশে গিয়ে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করতে দেখল, তাতে তাদের একটুও আহ্লাদ হয়নি। উত্তরপ্রদেশ সরকার নাম পাল্টানোর যে অভিযানে নামে তাও কোন উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারেনি এবং বিজেপি ঘোষণা করতে বাধ্য হয় যে তারা সুপ্রীম কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করবে এবং এইভাবে সংঘ বাহিনীও পিছু হঠতে বাধ্য হয়। সংঘ বাহিনীর অযোধ্যা অভিযান যখন সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হল, তার সম্পূর্ণ বিপরীতে তখন সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির ''দিল্লী চলো'' আহ্বান সারা দেশেরই নজর কাড়ল। এই কিষাণ সংঘর্ষ কমিটি হল বিভিন্ন রাজ্যে সক্রিয় দুশোরও বেশি কৃষক সংগঠনের এক ছত্র মঞ্চ। প্রায় সমস্ত অ-বিজেপি বিরোধী দল প্রতিবাদী কৃষকদের সমর্থন জানাতে বাধ্য হয়। সারা দেশ থেকে সমবেত হয়ে এই কৃষকরা ২৯-৩০ নভেম্বর দিল্লী অভিযান করে এবং তারা সংসদের এক বিশেষ অধিবেশন ডাকার দাবি জানায়। তারা ভারতের সংকট-জর্জরিত কৃষক এবং গ্রামীণ মেহনতিদের আশু দাবিগুলোর সমাধানে একটা ইস্তাহার গ্রহণ করে। ভারতীয় গণতন্ত্রের এই সংকটকালে ভারতের কৃষক জনগণের মধ্যে থেকে উঠে আসা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং শ্রেণী ঐক্যের এই শক্তিশালী বার্তার চেয়ে ভরসাজনক আর কিছু হতে পারে না। আসুন, ক্রমবর্ধমান এই ঐক্যকে আমরা আরো শক্তিশালী করে তুলি এবং ২০১৯-এর অতীব গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলোকে মুখের মত জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হই।

খণ্ড-25
সংখ্যা-37