বাংলায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির বিষ ছড়াতে বিজেপি কর্মসূচী নিল রাম রথ বের করার। যথারীতি সঙ্গে থাকছে সংঘ পরিবার। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের জন্য মেরুকরণের রাজনীতির উন্মাদনা সৃষ্টি করতেই এই বিষ-উদ্যোগ। এটা ওদের সর্বভাবতীয় প্রকল্প। এর আগেও রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে তার বিচিত্র সব তাণ্ডব ধরা পড়েছে। এখন তারা আবার সোরগোল তুলছে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের। সুপ্রীম কোর্টে মন্দির-মসজিদ বিরোধ সংক্রান্ত মামলার শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় ইস্যুটাকে মাঠে-ময়দানে ফের তুঙ্গে তোলা হচ্ছে। সঙ্ঘ নেতা মোহন ভাগবত সব কাজ ফেলে ঘাঁটি গেড়েছেন সরযূর তীরভূমিতে, ‘মন্দির ওখানেই (বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্থলে) বানানো’র আইন তৈরির দাবিতে চাপসৃষ্টির আলোড়ন তুলতে। সরসঙ্ঘচালক সাধু-সন্ত্-সঙ্ঘ শিবিরগুলোকে নিয়ে পড়েছেন। এছাড়াও আরও নতুন নতুন কিছু বিষয়কে বিজেপি-আরএসএস মিলে সামনে আনছে আক্রমণাত্মকভাবে।
দেশের পশ্চিমভাগে গুজরাট থেকে শুরু করেছে এক নতুন বাহানা, ‘অখন্ডতা রক্ষার হিন্দু নায়ক’ হিসেবে তুলে ধরে সর্দার প্যাটেলকে ব্যবহার করার রাজনীতি; উত্তর ভারতে শুরু করেছে ঐতিহাসিকভাবে ঊর্দু বা আরবি শব্দখচিত প্রসিদ্ধ স্থানসমূহের পরিচিতি মুছে ফেলার ‘নাম বদলের’ রাজনীতি; এক সংখ্যালঘ সম্প্রদায়ের স্মৃতিবিজড়িত সবকিছুকে ধ্বংস করা-মুছে দেওয়ার রাজনীতি; দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটকে গত বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দুত্বের ঢেউ তোলার মহড়া বড় মাত্রায় ধাক্কা খাওয়ার পরও দমার লক্ষণ নেই, বরং প্রতিহিংসায় বাম শাসিত কেরলে নামিয়েছে ঋতুমতী মহিলাদের শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশাধিকার রোধের রাজনীতি, এক্ষেত্রেও সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশকে অমান্যের প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে সঙ্ঘপন্থীরা; আর পূর্ব-ভারতে বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি চালু করেছে অসম রাজ্য থেকে ৪০ লক্ষ অ-অসমীয়াকে বিতাড়নের তথাকথিত তথ্যপঞ্জীকরণ অভিযান নামিয়ে। মোদীর ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ যে কতবড় ধোঁকাবাজি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার সার্বিক পরিচয় দেশবাসী পেয়ে চলেছে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ হুঙ্কার ছাড়ছেন, ‘পার্লামেন্ট থেকে পঞ্চায়েত সব ক্ষমতা চাই’।
হিন্দুত্বের এই সর্বাত্মক আক্রমণের অঙ্গ হিসেবেই এই বাংলায় বিজেপি আর কিছুদিনের মধ্যে রাম রথ বের করার পরিকল্পনা এঁটেছে। হুমকি দিয়েছে প্রশাসনিক সহযোগিতা না পেলে আদালতে যাবে। শবরীমালা মন্দিরের ব্যাপারে আদালত মানামানি নেই, অথচ এরাজ্যে রাম রথযাত্রা প্রসঙ্গে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার রোয়াব দেখাচ্ছে। ৬ ডিসেম্বরের আগে-পরে মিলিয়ে রাজ্যের তিনটি পকেট থেকে রথ বের করার কথা। দিনটা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেওয়া, ভারতের সংবিধান স্বীকৃত বহুত্বের সহাবস্থান ও ধর্মনিরপেক্ষতার ন্যূনতম মৌল ভিত্তির ওপর আঘাত হানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কালা দিবস হিসেবেই পালিত হয়। আর সেই দিনক্ষণে এখানে রাম রথ পরিক্রমার ক্ষমতা দেখাতে চায় ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীরা। তিনটি জায়গা থেকে এই রথ বের করার পরিকল্পনা—রাঢ়বঙ্গের তারাপীঠ, দক্ষিণের গঙ্গাসাগর ও কুচবিহার সীমান্ত।
ঘটনাবলীর দিকে সমস্ত প্রকৃত বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। যাতে প্রতিহত করতে প্রয়োজনে সাথে সাথে পাল্টা উদ্যোগ নেওয়া যায়। ৬ ডিসেম্বরের কালা দিবস পালনের কর্মসূচী সংগঠিত হওয়া উচিত সর্বত্র। কেবল দিবস পালনে সীমাবদ্ধ না থেকে গতিধারায় সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের প্রতিটি নির্দিষ্ট প্রকাশের স্বরূপ উন্মোচন ও বিরোধিতা চালিয়ে যেতে হবে নিরন্তর। মমতা সরকারের পুলিশ-প্রশাসনের ভেতর থেকে যাতে কোনোরকম মদত ফ্যাসিবাদীরা না পায়, রাখতে হবে সেই নজরদারীও।