পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান সরকার বড়াই করে বলে যে তারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থার অনেক উন্নতি করেছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য জেলায় জেলায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল করতে বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালে বেড ফ্রি হয়েছে। কিছু কিছ ওষুধ বিনামূল্যে হাসপাতালে পাওয়া যাচ্ছে। পিপিপি মডেলের ডায়গনস্টিক কেন্দ্র থেকে বাজারদরের তুলনায় একটু কম খরচে ইউএসজি, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি করা যাচ্ছে। নতুন কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ চালু হয়েছে। তাহলে কি এরাজ্যে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংকটের সমাধান প্রায়ই হয়েই গেল?
একথা ঠিক ‘৯০-এর দশক থেকে সিপিএম-এর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার একটি অঙ্গরাজ্যে ‘পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোনো বিকাশ নেই। শিরোধার্য করে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও সরকারি উদ্যোগ কমিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোমগুলিকে সস্তায় জমি দিয়ে, হাসপাতাল (সরকারি) বিক্রি করে চিকিৎসা ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের সমস্ত ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এর ফলে যে সব গরিব ও মধ্যবিত্তদের বাধ্য করা হয়েছে অ্যাপোলো, আমরীর মত প্রচণ্ড ব্যয়বহুল কর্পোরেট হাসপাতালে বা গজিয়ে ওঠা নার্সিং হোমগুলিতে ভীড় জমাতে। বামপন্থী নেতারাও অসুস্থ হয়ে পিজি হাসপাতালের উডবার্ণ ওয়ার্ড ছেড়ে দৌড়ে গিয়েছেন বেলভিউ, অ্যাপোলোতে ...। ফলে সমস্ত প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাপক ক্ষোভ।
এই ক্ষোভ বুঝে মমতা ব্যানার্জী কিছু প্রসাধনি সংস্কারের ব্যবস্থা নিয়েছেন মাত্র। তৃণমূল আমলে চিকিৎসা ব্যবস্থার সমস্যার গভীরে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। ব্যাপারটা একটু বিশদেই খতিয়ে দেখা যাক।
তৃণমূল সরকার সর্বরোগহর ব্যবস্থা হিসেবে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ব্যবস্থার ওকালতি করে। কিন্তু সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের আবশ্যিকতা থাকে মূলত জটিল রোগ নিরাময়ের জন্য। সাধারণভাবে বেশিরভাগ মানুষই ভীষণ জটিল রোগে আক্রান্ত হয় না—যে সামান্য শতাংশ আক্রান্ত হয় তাদের জন্য শুধু প্রয়োজন সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজগুলি। অধিকাংশ মানুষের প্রয়োজন নিয়মিত সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা। এই নিয়মিত সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ব্লক বা কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও জেলা হাসপাতালগুলিকে যথার্থভাবে গড়ে তোলা ও পরিষেবা চালু করা দরকার।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার যে পরিকাঠামো গড়ে তোলা দরকার তার ভিতের কাজ করে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র আর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা তার (এনএফএইচএস-র) ২০১৫-১৬ অনুযায়ী এ রাজ্যে ৬২ শতাংশ মহিলা (৪৯ শতাংশ অল্পমানের, ১৩ শতাংশ মাঝারি মানের এবং ০.৮ শতাংশ উচ্চমানের) রক্তাল্পতায় ভোগে। এখন ৪৯ শতাংশ অল্প ও ১৩ শতাংশ মাঝারি মানের রক্তাল্পতায় ভোগা মহিলাদের আয়রণ ও ফলিক অ্যাসিড দিলেই তা অনেকাংশে ঠিক করা যায়। এর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী আশা কর্মী ও উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এএনএম-রা যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারলে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এর জন্য কোনো সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের প্রয়োজন নেই। এ প্রসঙ্গে অবশ্য বলা দরকার যে এ রাজ্যে মহিলাদের মধ্যে ব্যাপক রক্তাল্পতার জন্য অর্থনৈতিক অসাম্য ও সমাজে তাঁদের অবস্থানও অধিকাংশে দায়ী।
আবার প্রসব আসন্ন মায়েদের গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে প্রসবের পূর্বে অন্তত চারবার পরীক্ষা করা, টিটেনাশ ইনজেকশন দেওয়া ও ১০০ দিন আয়রণ ও ফলিক অ্যাসিডের সিরাপ বা ট্যাবলেট খাওয়ার কথা। কিন্তু এরাজ্যে এই সবকটি বিষয় গ্রামাঞ্চলে মাত্র ২২.২ শতাংশ গর্ভবতী মহিলারা পেয়ে থাকেন। উত্তর দিনাজপুরে ৫৩ শতাংশ, দক্ষিণ ২৪ পরগণায় ৪৮ শতাংশ, মালদহে ৪৫ শতাংশ এবং মুর্শিদাবাদে ৩৬ শতাংশ শিশু প্রসব হন বাড়িতে কারণ এইসব অঞ্চলে প্রসবের জন্য উপযুক্ত সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই (তথ্যসূত্র : এনএফএইচএস-৪)।
এরকমভাবে অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায় যেখান থেকে বোঝা যায় যে আমাদের প্রথমে দরকার এক সুষ্ঠ প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা।
কম্পট্রোলার এণ্ড অডিটর জেনারেল অফ ইণ্ডিয়ার (যাকে সংক্ষেপে সিএজি বলা হয়) সাধারণ ও সামাজিক ৩নং রিপোর্ট ২০১৭ থেকে কতগুলি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র এরাজ্যে বাস্তবে আছে এবং কত সংখ্যায় থাকা দরকার তা দেওয়া হল।
যে রাজ্যে প্রয়োজনের তুলনায় ৪৩ শতাংশ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৭০ শতাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ৬২ শতাংশ কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র কম আছে সেই রাজ্যে সুচিকিৎসার যতই ঢক্কানিনাদ চলুক না কেন বাস্তব হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে সরকারি প্রাথমিক চিকিৎসা পরিষেবার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। এখানে এটাও বলা দরকার যে ৯০৯টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মাত্র ২৩৪টি কেন্দ্রে ২৪ ঘন্টা প্রসবের ব্যবস্থা আছে। বাকিগুলিতে খালি বর্হিবিভাগ চালু আছে।
উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র | প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র | কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র | |
থাকা দরকার | ১৮২৮০ | ৩০৪৬ | ৯১৪ |
বর্তমানে অছে | ১০৩৬৯ | ৯০৯ | ৩৪০ |
কত কম | ৭৯১১ (৪৩ শতাংশ) | ২১৩৭ (৭০ শতাংশ) | ৫৭৪ (৬২ শতাংশ) |
এবার দেখা যাক এ রাজ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে ডাক্তার, নার্স ও প্যারামেডিকেলদের কতগুলো অনুমোদিত পদ আছে ও তাদের মধ্যে কত জন নিযুক্ত আছেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংখ্যা যেখানে ৯০৯ সেখানে ডাক্তারের সংখ্যা ৭২১ অর্থাৎ ১৮৮টি কেন্দ্রে আসলে কোনো পরিষেবাই দেওয়া হয় না।
ডাক্তার | নার্স | প্যারামেডিক | |
অনুমোদিত পদ | ১৩২৪ | ২৩০৫ | ১২৯৪ |
নিযুক্ত অাছেন | ৭২১ | ১৬৭৭ | ৮৭৭ |
কত কম | ৬০৬ (৪১ শতাংশ) | ৬২৮ (২৭ শতাংশ) | ৪১৭ (৩২ শতাশ) |
সিএজি এই অডিট করতে গিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও উত্তর দিনাজপুর জেলায় ২২টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পরিদর্শন করে ও দেখতে পায় যে ইণ্ডিয়ান পাবলিক হেলথ স্ট্যাণ্ডার্ড অনুযায়ী ১১০টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের মধ্যে কোথাও ৬০টি ওষুধ আছে কোথাও বা মাত্র ৬টি ওষুধ আছে। এমনকি এই চারটি জেলার জেলা হাসপাতালে যত ধরনের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ থাকার কথা তার অর্ধেকও নেই।
অতএব কলকাতার পিজি, মেডিক্যাল, এনআরএস, আরজিকর হাসপাতাল দেখে যদি আমরা পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বোঝার চেষ্টা করি তা হলে এক চরম ভ্রান্তির শিকার হব।
তাই দাবি তোলা দরকার, সিএজি রিপোর্ট অনুযায়ী সবকটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করতে হবে। চিকিৎসক, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সরবরাহের মাধ্যমে যথাযথ চিকিৎসার পরিষেবা সকল রাজ্যবাসীকে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে দিতে হবে।
(১) সমতলে ৫০০০ ও আদিবাসী-জনজাতি অধ্যুষিত বা পাহাড়ি এলাকায় ৩,০০০ জনসংখ্যা পিছু একটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকতে হবে।
(২) সমতলে ৩০,০০০ ও আদিবাসী-জনজাতি অধ্যুষিত বা পাহাড়ি এলাকায় ২০,০০০ জনসংখ্যা পিছু একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকতে হবে।
(৩) ১ লক্ষ জনসংখ্যা পিছু একটি কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকতে হবে।