(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
২০১৯ ক্রমশ এগিয়ে আসায় সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব সাংগঠনিক চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অন্যান্যদের কাছে পৌঁছানোর এক বিশাল উদ্যোগ শুরু করেছে। কিছুদিন আগে ২০১৯-এর জন্য সমর্থন পেতে চেয়ে আমরা প্রতিদিনই অমিত শাহকে বিশিষ্ট নাগরিকদের কাছে যেতে দেখেছি। নাগপুরে আরএসএস প্রচারকদের সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর ভাষণ দেওয়ার দৃশ্যও আমরা চাক্ষুষ করেছি। এখন আমরা আবার বিজ্ঞান ভবনে তিনদিন ধরে আরএসএস-এর কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হতে দেখলাম। বিজ্ঞান ভবন হল ভারত সরকারের মালিকানাধীন মর্যাদাপূর্ণ এক সম্মেলন কেন্দ্র, এতদিন তা এমন প্রেক্ষাগৃহ হিসাবে পরিচিত ছিল যেখানে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হত, অথবা আয়োজিত হত কেন্দ্রীয় সরকারের কোন মন্ত্রকের উদ্যোগে চালিত কোন সরকারি অনুষ্ঠান, অথবা এমন সরকারি অনুষ্ঠানের আয়োজন হত যাতে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী অংশ নিতেন। এই কনক্লেভকে আর এস এস এবং ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরএসএস প্রধান এবং নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট প্রতিনিধিদের মধ্যে মত বিনিময়ের এক অনুষ্ঠান হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমগুলিতে ব্যাপকভাবে আর এস এস প্রধান মোহন ভাগবতের কিছু মন্তব্যকে এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে যে সেগুলি যেন তার নির্দিষ্ট সম্প্রদায়গত ও ফ্যাসিস্ট ভাবমূর্তির বিপরীতে আ এসএস-এর এমন সংগঠন হয়ে ওঠার ভরসা জাগানো সংকেত বহন করে যেখানে সবার ঠাঁই হবে এবং যে সংগঠন হবে গণতান্ত্রিক। বিজ্ঞানভবনে ভাগবতের আলোচনা থেকে উঠে আসা নিম্নে বর্ণিত চারটি অভিমতই ঐ দাবির কেন্দ্রে থেকেছে :
(১) কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং দেশকে অনেক মহান ব্যক্তিত্ব উপহার দিয়েছে,
(২) সংবিধান এবং জাতীয় পতাকার প্রতি আরএসএস-এর কোন বৈরিতা নেই,
(৩) আরএসএস মুসলিমদের বাদ দিতে চায় না, বস্তুত মুসলিমদের গ্রহণ করতে তার কোন সমস্যা নেই,
(৪) সরকারের সঙ্গে আরএসএস-এর কোনো সম্পর্ক নেই, তাকে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন তো ওঠেই না, আরএসএস সরকারের কিছু ধারণার অংশীদার এবং সরকারের কিছু উদ্যোগে সে সমন্বয়সাধন করে থাকে। বিজেপি যে কংগ্রেস-মুক্ত ভারত নিয়ে চিল-চিৎকার করেছে, অথবা মোদী যে নেহরুর বিরুদ্ধে লাগামছাড়া এবং বদ্ধমূল আক্রমণ শানান, কিছু ভাষ্যকার ভাগবতের এই মন্তব্যগুলির মধ্যে তার সূক্ষ্ম খণ্ডন অথবা সংশোধনের প্রয়াসও দেখতে পেয়েছেন।
ভাগবত স্পষ্টতই তাঁর সুবিধামতো আরএসএস-এর ইতিহাসকে এমন বিকৃত ধারায় উপস্থাপিত করা এবং তার কেন্দ্রীয় বীক্ষা ও লক্ষ্যকে এমন ভাষায় ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন যাতে তা সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রূপে প্রতীয়মান হয়। তবে, ঘটনাচক্রে ভাগবতের স্বরূপ উদঘাটন করতে আমাদের হেডগেওয়ার বা গোলওয়ালকারের রচনার দিকে ফিরে তাকাতে হবে না, মাত্র দশদিন আগে চিকাগোতে বিশ্ব হিন্দু সম্মেলনে যে ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন সেটা বিশ্লেষণ করলেই তা আমাদের কাছে যথেষ্ট হবে এবং তা প্রভূত শিক্ষাপ্রদও হবে। চিকাগো অনুষ্ঠানের উপলক্ষ ছিল চিকাগোতে স্বামী বিবেকানন্দ প্রদত্ত ঐতিহাসিক বক্তৃতার ১২৫তম বার্ষিকী উদযাপন। এবং দুয়ের বৈপরীত্যও চূড়ান্ত রূপে প্রকটিত হয়েছিল : বিবেকানন্দ বিভিন্ন ধর্মের জনগণের এক আন্তর্জাতিক সমাবেশে হিন্দু ধর্মের এক আখ্যান উপস্থাপিত করেছিলেন, আর ভাগবত বক্তৃতা দিয়েছিলেন মূলত: এক খাস সমর্থক গোষ্ঠীর সামনে। সেখানে বিদেশে বসবাসকারী কিছু ভারতীয় মানুষজন—যাঁরা আরএসএস-কে হিন্দু ধর্ম এবং ভারতবর্ষের পক্ষে এক প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন—যে বিরোধিতার আওয়াজ তুলেছিলেন, তাদের নির্মমভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
১৮৯৩ সালে বিবেকানন্দ ঔপনিবেশিক শক্তির পদানত এক জাতির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং সর্বজনীন মানবতা এবং আত্মপ্রত্যয়ী ও অতিথিবৎসল এক ভারতবর্ষের ভাবমূর্তির বার্তা নিয়ে বিশ্বের কাছে পৌঁছেছিলেন। তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বিবেকানন্দ দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, ''এমন এক দেশের মানুষ হিসাবে গর্ববোধ করি যা বিশ্বের সমস্ত ধর্মের এবং দেশের নিপীড়িত ও শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে।'' সহনশীলতাকে তিনি সম্মানের স্তরে উন্নীত করেন—''আমরা শুধু সর্বজনীন সহনশীলতাতেই বিশ্বাস করি না, সমস্ত ধর্মকেই আমরা সত্য বলে গ্রহণ করি।'' এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে তিনি ধর্মান্ধতা এবং উগ্র উন্মাদনার বিরুদ্ধে ঐকান্তিক আবেদন জানিয়ে বলেন : ''সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা, ধর্মান্ধতা এবং তার ভয়াবহ সৃষ্টি উগ্র উন্মাদনা দীর্ঘদিন ধরেই এই সুন্দর পৃথিবীর দখল নিয়েছে। ... তারা পৃথিবীকে হিংসায় ভরিয়ে দিয়েছে, বারবারই মানুষের রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে, সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে এবং গোটা জাতিকেই নৈরাশ্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ... এবং আমি দৃঢ়ভাবেই আশা করি যে, এই সম্মেলনের সম্মানে আজ প্রভাতে যে ঘন্টাধ্বনি হয়েছে, তা যেন সমস্ত ধরনের উগ্র উন্মাদনার মৃত্যু ঘন্টা হয়ে ওঠে।''
ফেরা যাক ২০১৮ সালে এবং আমরা ভাগবতকে এমন এক হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বলতে শুনি যা যুদ্ধে রত। হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যায় যে উপমা তিনি তুলে ধরেন তা হল এক সিংহের—আমরা জানি না, গোরক্ষকের মুখোশ পরা সন্ত্রাসবাদীদের সুবিধার জন্য শুধুই দেশের অভ্যন্তরে সহৃদয় গরুর কথা বলা হয় কিনা—যাকে ঘিরে ধরেছে একদল বন্য কুকুর। সম্মেলন ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিবাহ সমূহকে তুলে ধরে হিন্দুদের নীরব গণহত্যা রূপে। হিন্দুদের ব্যাখ্যায় সম্মেলনের ব্যবহার করার আর একটা উপমা হল গৈরিক লাড্ডুর, কিন্তু সংঘ মনে করে আজ যে অবস্থায় লাড্ডুটা রয়েছে তা একেবারেই ছোট ও নরম, আর তাই আহ্বান দেওয়া হয় লাড্ডুটাকে আরো বড় ও শক্ত করার। সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে কি বলা হয়? ফ্যাসিবাদের ধ্রুপদী বচন থেকে সরাসরি তুলে আনা ঈষৎ প্রচ্ছন্ন আর একটা উপমা দিয়ে এর উত্তর দেওয়া হয় : প্রথাগত ভারতীয় কৃষির কীটনাশক দরকার হয় না, কারণ, তা হত্যা করে না, কিন্তু জানে কেমন করে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে হয়।
বিজ্ঞান ভবনের আলোচনায় সন্ধান পাওয়া তথাকথিত সর্বজনীনতা এবং উদারতাবাদের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। ভাগবত গোটা ভারতীয় সমাজকেই হিন্দু বলে অভিহিত করেন এবং তারপর বলেন, আরএসএস বৈচিত্রকে সম্মান জানায় এবং মুসলিমদের গ্রহণ করতে তার কোনো অসুবিধা নেই। প্রকৃত ইস্যুটা যখন আরএসএস-এর পরামর্শে চালিত গুণ্ডাবাহিনীগুলোর প্রতিদিনই প্রকাশ্যে সংবিধানের লঙ্ঘন এবং সংরক্ষণ ও সামাজিক ন্যায়ের বিরোধী মনুবাদী শক্তিগুলোর পার্লামেন্ট স্ট্রিটে আক্ষরিকভাবেই সংবিধানের দাহন, তখন তিনি মনে করছেন, সংবিধান গ্রহণের দাবি করে তিনি বুঝি আমাদের বিরাট অনুগ্রহ করলেন। একইভাবে, সংঘ যখন যর্থাথই এমন এক শিল্পকে চালাচ্ছে যা লাগাতার মিথ্যাচার, বিকৃত ব্যাখ্যা এবং ইতিহাস ও ইতিহাসের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বদের হাতিয়ে নেওয়ার ধুরন্ধর হয়ে উঠেছে, তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রেস বা অন্য কোন মূল ধারার ঐতিহাসিক ভূমিকাকে স্বীকার করাটা কোন তাৎপর্যই বহন করে না। বিজ্ঞান ভবনের কনক্লেভকে ঘিরে যে সমস্ত পোস্টার ও ব্যানার লাগানো হয়েছিল তাতে ভারতবর্ষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নামে চালানো একটা মন্তব্যও ছিল যাতে রবীন্দ্রনাথ নাকি বলেছেন যে, ভারতবর্ষ বরাবরই একটা হিন্দু রাষ্ট্র ছিল। আর এটা প্রশ্নহীনভাবে ছিল সংঘের মিথ্যা উৎপাদনের কারখানা থেকে বেরোনো আর একটা ভুয়ো উদ্ধৃতি।
একেবারে স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো যে মন্তব্যটা ভাগবত জোর গলায় করেন তা ছিল এই যে, মোদী সরকারের সঙ্গে আরএসএস-এর কাঠামোগত কোন সম্পর্ক নেই এবং সরকারের নীতি রচনা বা তার রূপায়নে আরএসএস-এর কোনো ভূমিকাই নেই। কিন্তু গোটা দুনিয়াই তো মোদীর প্রশাসনিক পরিকল্পনায় আরএসএস-এর বিশদ নীলনকশার কথা জানে। এটা কি আর এস এস-বিজেপির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে জনগণকে প্রতারিত করার আর একটা কৌশল ছিল, নাকি তা ছিল মোদী সরকার নামক বিপর্যয় এবং আসন্ন যে পরাজয়ের ছায়া প্রকট হয়ে উঠেছে তার থেকে নিজেদের দূরত্ব রচনার আরএসএস-এর একটা চতুর ফন্দি? সেই অর্থে ভাগবত ঠিক সেই ধারারই প্রতিধ্বনি করছেন যার আশ্রয় নিয়ে সেদিন ভারতে ব্যবসার সাম্প্রতিকতম চাঁই বাবা রামদেব বললেন যে, ২০১৯ সালে তিনি বিজেপির হয়ে প্রচার করবেন না। গান্ধিকে হত্যা করার পর যে সংগঠনকে নয় নয় করে তিনবার নিষিদ্ধ করা হয়, সেই সংগঠন লুটিয়ান দিল্লীর সরকারের অভিজাত কনভেনশন কেন্দ্র থেকে তার বেদবাক্য প্রচার করছে। এতটা পথই আর এস এস পেরিয়ে এসেছে এবং সময় থাকতে থাকতে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা সে করে চলেছে।