তাদের কন্ঠ থেকে তখন যে শব্দ উঠে আসে তা কোনো পশুর কান্না নয় – যুদ্ধের বাজনা -- (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় )
গান্ধীজির জন্মের ১৫০ বছর মহা সমারোহে পালন করতে শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, ভারতীয় জনতা পার্টি ও তাদের নেতা কর্মীরাও এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এতদিন গান্ধীজির নামে চোরাগোপ্তা অপপ্রচার আর তাঁর হত্যাকারীর মূর্তি বসানো ছিল যাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ, তারাই আবার ঘটা করে মালা পরাচ্ছেন গান্ধীজির গলায়! গান্ধীর প্রতীক নিয়েও ব্র্যান্ড-মোদী শুরু করেছে দিনে ডাকাতি! কিন্তু, এই অতিভক্তি যে হৃদয় পরিবর্তন নয়, বরং, প্রবাদ প্রতিম চোরেরই লক্ষণ, তা একেবারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল রাফাল অস্ত্র-দুর্নীতি। একদিকে তা ফাঁস করে দিচ্ছে অহিংসার আড়ালে শুধু সহিংস নয়, ক্রমশ যুদ্ধবাজ আগ্রাসী হয়ে ওঠা মোদীর ভারতের বিপদজনক রূপ, অন্য দিকে স্বচ্ছতার মুখোশের নিচে লুক্কায়িত লোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত মুখ। বফর্সের পর এই মাপের অন্য কোনো অস্ত্র-দুর্নীতি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে ফাঁস হতে দেখা যায়নি। শুরুতে, গোপনীয়তা ছিল প্রায় নিশ্ছিদ্র। কিন্তু, কথায় বলে বজ্র আটুনি–ফস্কা গেরো। আক্ষরিকভাবে ঠিক সেটাই এখানে ঘটেছে। দুর্নীতির ছবিটা এখন এতটাই পরিষ্কার, যে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এই কেলেংকারী প্রধানমন্ত্রী মোদী, তার কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষক আম্বানি, এবং ভারতীয় জনতা পার্টির কপাল পুড়িয়ে ছাই করে দিলেও, কেউই তাতে একটুও অবাক হবেন বলে মনে হয় না।
যত দিন যাচ্ছে, রাফাল-কান্ড ততোই আরো চুনকালি মাখিয়ে দিচ্ছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর গালে। অনেকেই মনে করছেন–যে শেষে এই বিতর্ক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতেই তথাকথিত “আরবান নকশাল” জিগির তোলা ও সমাজকর্মীদের গ্রেপ্তার করার পথ নিয়েছে ইদানিং চুপসে যাওয়া “৫৬ ইঞ্চি” ছাতির সেই নেতাটি—নিজেকে যিনি মনে করেন ভারত ভাগ্য বিধাতা! কিন্তু, রাফাল-রাজনীতির আলোচনাতেও এই ফাঁকে আরেকটা জরুরি জিনিস আড়ালে চলে যাচ্ছে, তা হল হাল আমলে দেশে ক্রমশ নিবিড় হয়ে ওঠা সামরিক-কর্পোরেট শিল্প–আতাঁত, ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, আমেরিকার গণতন্ত্রের প্রধান বিপদ হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন
রুজভেল্ট এই প্রবণতাকেই চিহ্নিত করেছিলেন। রুজভেল্টের আশংকা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। অস্ত্র-ব্যবসা আর এই জাতীয় সামরিক-কর্পোরেট শিল্প–আতাঁত-এর সহায়তা ছাড়া “উন্নত” বা “উন্নয়নশীল” কোনো দেশেই স্বৈরাচারী শাসকরা আজকাল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। এবং একবার গেড়ে বসতে পারলে, বকলমে, শিল্প–আতাঁতই দেশ শাসন করে। স্বৈরতন্ত্রও সবক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হয় না। হয় এক দলীয় নয় দ্বিদলীয় ‘গণতন্ত্রের’ আড়ালে, এই সামরিক-কর্পোরেট শিল্প–আতাঁতই আমেরিকা সহ বহু দেশ ঠিক যেমন আড়াল থেকে শাসন করছে তাদের ‘মহান গণতন্ত্র’। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় জনতা দলের একটি অংশ এই ব্যবস্থাটা এখন ভারতেও পাকাপোক্তভাবে কায়েম করতে চায়। রাফাল তাই ভারতে যেটুকু গণতান্ত্রিক অধিকার কষ্টেসৃষ্টে টিকে আছে তা এক দমকা বাতাসে, নিবিয়ে দেবার প্রয়াস। ঘটনাচক্রে, ফরাসী ভাষায় রাফাল কথাটার অর্থও ঠিক তাই। দমকা বাতাস। হিন্দিতে বলা যেতে পারে আঁধি। তপ্ত ঝঞ্ঝাবাত। ড্রাগনের মতই যা দেশের ঘাড়ের ওপর আজ নিঃশ্বাস ফেলছে।
তত্ত্ব ও প্রেক্ষিত ছেড়ে, আসুন এবার তাকাই ঘটনা প্রবাহের দিকে। রাফাল, ফ্রান্সে তৈরী একুশ শতকের একটি অত্যাধুনিক বহুকর্মনিপুন যুদ্ধবিমান। ফ্রান্সের বেসরকারী অস্ত্র নির্মাতা কর্পোরেট বা ডিফেন্স কন্ট্রাক্টর দাসো (Dassault) এই যুদ্ধবিমান তৈরি করে আফগানিস্তান। ইরাক, সিরিয়া সহ অন্যান্য যুদ্ধে যা ব্যবহৃত হয়েছে। বিশ্বায়নের পর্বে ভারতসরকার বিভিন্ন জনসম্পদ ও রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানির মালিকানা বিক্রির টাকা ঢালতে থাকে সামরিক অস্ত্র, যুদ্ধবিমান ও পরমাণু চুল্লির বাজারে। যেখানে লক্ষ কোটি টাকার অংকে কেনাবেচা হয় আর দালালি ও সেলামির টাকায় ফুলে ফেঁপে ওঠে দলীয় রাজনীতির তহবিল। এ ব্যাপারে কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে কোনোই তফাৎ নেই। রাজীব জমানার বফর্স কেলেংকারীর শিক্ষা দুর্নীতির অবসান নয়, তা পর্দার আড়ালে আরেকটু গা বাঁচিয়ে করা। রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার কথাবার্তাও কংগ্রেস শুরু করেছিল সোনিয়ার হাতের পুতুল মনমোহন সিং ও চিদাম্বরম-এর মারফৎ। মনমোহন ১২৬ টি রাফাল কিনবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। এই কেনাবেচার টাকার অংকের কাছে বোফর্স ছিল নস্যি! কিন্তু, চুক্তির আগেই নির্বাচনে কংগ্রেসের গণেশ উল্টোয়। বর্তমান সরকার সেই চুক্তির খোলনলচে একেবারে বদলে দিয়েছে। দুর্নীতি এখন পরেছে স্বচ্ছতার পোশাক। আম্বানিদের কোম্পানিদের হাত ঘুরে দেশী টাকায় নির্বাচনী বন্ড হিসেবে আইন বাঁচিয়ে রাফাল–কান্ডের টাকা যে ঢুকবে ভারতীয় জনতা দলের নির্বাচনী তহবিলে, সেটাও এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
ইউপিএ আমলে যখন রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার কথা শুরু হয়, তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন এ কে এন্টনি। প্রতিটি বিমানের দাম ৭১৫ কোটি টাকা হিসেবে প্রথম দফায় ৩৬টি বিমান কেনার জন্য ফাইল তৈরী হয়। যা ছিল নিছক যুদ্ধবিমানের দাম। আর একে অস্ত্র সজ্জিত করার পরে খরচ পড়বে বিমান পিছু ২০০০ কোটি টাকা, এমনটাই ঠিক ছিল। ঠিক ছিল যে সেনাবাহিনীর চাহিদা মাফিক মোট ১০৬টি বিমান কেনা হবে। বাকি গুলির আংশিক নির্মাণ বা সজ্জা হাতে নেবে ব্যাঙ্গালোরের রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা হিন্দুস্থান এরনেটিক্স লিমিটেড। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে লোকসভায় এই নিয়ে প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী সুভাস ভামরে জানিয়ে ছিলেন যে এই সরকারের আমলে বিমান পিছু দাম কমিয়ে ৬৭০ কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছে, এবং যুদ্ধাস্ত্র সজ্জিত বিমানের দাম খানিকটা গোপনীয় রাখার কথা হলেও–রিলায়েন্সের নথি থেকে দেখা যাচ্ছে যে প্রতিটি অস্ত্র সজ্জিত রাফালের দাম হবে ১৬৬০ কোটি টাকার মত। নির্মলা সীতারামনও সম্প্রতি কংগ্রেসের চাপের মুখে এই অংক দুটির কথা স্বীকার করেছেন। আগের আমলের তুলনায় রাফাল বিমান ও আনুসঙ্গিক অস্ত্রের দাম যে বেড়েছে তা নয়।। রাহুল গান্ধী নিছক বিমানের দাম ও অস্ত্রসজ্জিত বিমানের খানিকটা গুলিয়ে দিয়ে দুর্নীতির টাকার অংকটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাচ্ছেন। এটা ভোটের রাজনীতি। একাউন্টস এবং ভিজিলেন্স দপ্তর (সিএজি ও সিভিসি) বিষয়টি খতিয়ে দেখবে বলে জানিয়েছে। ইউপিএ জমানার শেষ পর্বে কমনওয়েলথ গেমস, টুজি স্পেকট্রাম, কয়লা ব্লক বন্টন কেলেংকারীর তদন্তে এই দুটি সংস্থা বিজেপিকে যেভাবে সুবিধে এনে দিয়েছিল, আটকে দিয়েছিল কংগ্রেসের তহবিলের উৎস, সেই কায়দা হাতে নিয়েছে কংগ্রেস। আনন্দ শর্মার নেতৃত্বে কংগ্রেস নেতারা সিএজি প্রধান রাজীব মহার্ষির সঙ্গে দেখা করে আপত্তি নথিভুক্ত করিয়েছেন। একই পথ নিয়েছেন বাজপেয়ী জমানার দুই মন্ত্রী অরুণ শৌরি ও যশবন্ত সিনহা এবং আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। এটাই সাংবিধানিক পথ। অভিযোগের সত্যমিথ্যা এখানেই ধরা পড়বে। যে কোনো বিদায়ী সরকারের শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তগুলি যে দুর্নীতির রাজপথ—সেটা ভারতীয় নাগরিকদের অজানা নয়। এই চুক্তিকে সরকারের শেষলগ্নে যেন কার্যকরী করা না যায়, সেটাই দেখতে হবে।
খুবই ন্যক্কার জনক বিষয় হল হ্যালকে সরিয়ে রাতারাতি ভুইফোড় রিলায়েন্স কোম্পানিকে বরাত পাইয়ে দেওয়া। এই কাজে একদিকে যেমন ফ্রান্সের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাদের কাজে লাগানো হয়েছে, তেমনি জড়িয়ে নেওয়া হয়েছে রাফালের নির্মাতা বেসরকারী কোম্পানি দাসোকে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর রিলায়েন্সের মালিকদের সঙ্গে নিয়ে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণের নেপথ্যে যা ঘটছিল তার আঁচ এখন পাওয়া যাচ্ছে। না, তার কোনটাই নিছক প্রমোদ ভ্রমণ ছিল না। আচমকা, ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী অনিল আম্বানির রিলায়েন্স এরোস্ট্রাকচার লিমিটেড দাসো –রিলায়েন্স এরোস্পেস লিমিটেড যৌথ প্রকল্পে রাফাল বানাবে বলে ঘোষণা করে। যে অনিল আম্বানির রিলায়েন্স এরিকসন কোম্পানির দেনা শোধ করতে অপারগ, তার হাতে আকাশের চাঁদ রাফাল -বরাত জুটল কোন জাদুতে, সেটাই দেশবাসী জানতে চাইছে। নির্মলা সিতারামন দাবি করেছিলেন যে হ্যালের নাকি এই কাজের প্রযুক্তিগত দক্ষতা নেই। কিন্তু, তথ্য হল, দাসো হ্যালকে নিয়মিত কাজের বরাত দেয়। এটা যে তাদের হাত ফসকে যাবে, সেটা হ্যাল ভাবতেও পারেনি। হ্যালের অধিকর্তা তাদের যোগ্যতা যথেষ্টই আছে সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন। বরং সদ্যোজাত আম্বানির কোম্পানির যোগ্যতা কি তা ভবিষ্যতই বলবে। আপাতত, আম্বানির যুদ্ধাস্ত্র তৈরির অভিজ্ঞতার খাতা নিছক শূন্য। নরেন্দ্র মোদির বন্ধুত্বটুকুই সম্বল। ভারতের ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের সব থেকে বৃহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছে রাফাল–কান্ড। এখানেই বফর্সের সঙ্গে মিল। কোয়াত্রচির জায়গায় আম্বানিকে পাওয়াই কি তাহলে স্বাদেশিকতার চিহ্ন?
কিন্তু এখন দেশজুড়ে দুর্নীতির কটু গন্ধে আমাদের গা গুলিয়ে উঠলেও, মুখে বমন এলেও, রক্ত বমন করতে করতেও, আমাদের শেষ পর্য্যন্ত বলতেই হবে যে, রাফাল কান্ড অস্ত্র-দুর্নীতি তো বটেই, কিন্তু এখানে দুর্নীতির চাইতেও রাজনীতির অভিমুখের বদলটাই আরো অনেক অনেক বেশি মারাত্মক। এই কালবেলায়, যখন কানে আসছে মুহুর্মুহু পশুর হুহুঙ্কার আর নেপথ্যে ভেসে আসছে ভাতৃঘাতী, আগ্রাসী, মুনাফা লোভী ও অন্তবিহীন যুদ্ধের বাজনা। দেখতে হবে দিগন্তে জ্বলে ওঠা শ্মশানের আগুনের লকলকে শিখা। চিনতে হবে কাপালিকদের। আমাদের বুঝতে হবে যে এই সব রাফাল-কান্ড অনায়াসে চলতে দিলে, সদ্য গজানো সামরিক-কর্পোরেট শিল্প –আতাঁতই ভবিষ্যতে আমাদের টুঁটি চেপে, ঘাড় ধরে, দেশ শাসন করবে। শুধুমাত্র এই কাজটা নির্বিবাদে, সুচারুভাবে, করবার জন্যেই সরকারী প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্থান এরনেটিক্স লিমিটেড বা হ্যাল-কে সরিয়ে রাফাল-চুক্তির জন্য গজানো হয়েছে রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড, রিলায়েন্স এরনেটিক্স লিমিটেড এর মতো অস্ত্র তৈরির কোম্পানি। এটাই শেষের শুরু। একবার এই পথে চলতে শুরু করলে, আগামী দিনে ভারত হয়ে উঠবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এক প্রধান যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র। রাজনীতি আবর্তিত হবে, চিরস্থায়ী অর্থনীতির সংকটকে এড়িয়ে, প্রবল তেজস্বী যুদ্ধ-যুদ্ধ জিগিরকে ঘিরে।
বিশ্বের দীর্ঘতম সর্দার বল্লভ ভাইয়ের মূর্তি স্থাপন থেকে শুরু করে রাফাল-চিত্রনাট্য ক্ষমতার রাজনীতির একই সুরে বাঁধা। কংগ্রেসের তোলা চোর–চৌকিদার, খিস্তি খেউরে এই নতুন রাজনীতির মূলনীতিটা যেন হারিয়ে না যায়, সেটাই সর্বাগ্রে আমাদের নজরে রাখতে হবে।