সম্প্রতি পশ্চিম বাংলায় এমন কিছু ঘটনা জনগণকে যেমন বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলল, তাদের আতঙ্কের কবলে ঠেলে দিল, তেমনই ‘উন্নয়ন’ নিয়ে সরকারের দম্ভতেও একটা বড় ধাক্কা দিল। ঘটনাগুলোকে সংক্ষেপে বিবৃত করা যাক।
মধ্য কলকাতার সঙ্গে বেহালার সংযোগকারী অতি গুরুত্বপূর্ণ মাঝেরহাট সেতুটি মাঝখান থেকে দুভাগ হয়ে ৪ সেপ্টেম্বর ভেঙ্গে পড়ল খালের মধ্যে। এই ঘটনায় আহত একজনের ৫ অক্টোবরের মৃত্যুকে ধরে সেতু ভেঙ্গে নিহত মানুষের সংখ্যা দাঁড়াল চার। আহত বেশকিছু মানুষ এখনও আরোগ্যের জন্য লড়াই করছেন। এরপর শিলিগুড়ির কাছে ফাঁসিদেওয়ায় পিছলা নদীর উপরের পুরনো এক সেতু ৭ সেপ্টেম্বর ভেঙ্গে পড়ল নদীতে, আহত হলেন এক ট্রাক ড্রাইভার। দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপে ২৪ সেপ্টেম্বর ভেঙ্গে পড়ল কালনাগিনি নদীর উপর নির্মীয়মান সেতু। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে তিনটি সেতুর ভেঙ্গে পড়াটা পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বেহাল দশাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে এই সমস্ত সেতু ভাঙ্গার দায় কার? সংবাদে প্রকাশ, মাঝেরহাট সেতু ভেঙ্গে পড়ার ছ-সপ্তাহ আগে ইস্টার্ণ রেলের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার কেএমডিএ-কে চিঠি দিয়ে সেতুর স্বাস্থ্যের বেহালা দশা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন (সেতুর নীচ দিয়ে রেল লাইন যাওয়ায় তার একটা অংশের দায়িত্ব যেহেতু রেলের, তাই তারা সেতুর অবস্থা পরীক্ষা করেছিলেন), যে স্ল্যাবটা ভেঙ্গে পড়েছে সেটার সম্পর্কেই তাঁরা ‘’শিয়ালদহের দিকে হেলে পড়েছে’’ বলে দেখতে পাওয়ার কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এই সতর্কবার্তা সত্ত্বেও সেতুর ভেঙ্গে পড়া আটকানো যায়নি। ভাঙ্গার পরে মমতা ব্যানার্জী নিজেও বলেন, “(সেতুতে) সমস্যা আছে জানা সত্ত্বেও সেতুর ভেঙ্গে পড়াকে আটকাতে কোন সতর্কমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পূর্ত বিভাগ তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। ... পুলিশ আইনি পদক্ষেপ নেবে।’’ পরিস্থিতির চাপে গণক্ষোভ প্রশমনের লক্ষ্যেই এই মন্তব্য করা হয়ে থাকতে পারে, এমন অনুমান অমূলক নয়। তবে, তাঁর মন্ত্রীসভারই একটা দপ্তরের দায় তিনি নিজেও এড়াতে পারেন না। মাঝেরহাট, ফাঁসিদেওয়া ও কাকদ্বীপে সেতু ভাঙ্গা নিয়ে গঠিত কমিটিগুলোর রিপোর্ট একদিন পাওয়া যাবে, কিন্তু তাতে ভবিষ্যতের বিপর্যয় রোধ কতটা নিশ্চিত হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। এখন আমাদের জানানো হচ্ছে—কলকাতার আশেপাশে ২০টা সেতুর স্বাস্থ্যই ভালো নয়, এগুলোর ব্যবহারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এই বাস্তব অবস্থার উপলব্ধির জন্য, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য মাঝেরহাটের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা সেতু ভেঙ্গে পড়ার দরকার হল!
এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ সেপ্টেম্বর ভস্মীভূত হল পাইকারি ও খুচরো ব্যবসার শতাব্দী প্রাচীন কেন্দ্র বাগরি মার্কেট। আগুনের ব্যাপকতা এতটাই ছিল যে, আগুন লাগার ৩০ ঘন্টা পরও দমকল বাহিনী আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এই অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর কোন ঘটনা না ঘটলেও ভস্মীভূত হয়ে এবং আগুনের তাপে বিনষ্ট হয়ে বরবাদ হওয়া ওষুধ এবং অন্যান্য সামগ্রীর পরিমাণ শতাধিক কোটি টাকার। যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা এবং দোকানগুলি দাহ্য পদার্থে বোঝাই থাকার জন্যই আগুন অত ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল বলে মনে করা হচ্ছে। এই অগ্নিকাণ্ডের পর মমতা ব্যানার্জী বললেন, ‘’এটা একটা দুর্ঘটনা ছিল আর কেউই এটাকে আটকাতে পারে না।’’ তবে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় যা বললেন তা মমতা ব্যানার্জীর অবস্থানের বিপরীত—বাড়ির মালিকরা যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখলে এই অগ্নিকান্ডকে সম্ভবত এড়ানো যেত। অগ্নিকাণ্ডকে আটকানোর কোনো সম্ভাবনা যদি না থাকে তাহলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার দরকার কেন, বড় বড় আবাসনের দমকলের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেওয়ার প্রয়োজনই বা হয় কেন? এর কিছুদিন পরই ৩ অক্টোবর ভোরে আগুন লাগে মেডিক্যাল কলেজের বেসমেন্টে ওষুধ ভাঁড়ারে। এই অগ্নিকাণ্ডের জেরে কেউ নিহত না হলেও (একজনের মারা যাওয়ার যে খবর ওঠে তা ডাক্তারদের মতে অসুস্থতার জন্য) তা ২০১১ সালের আমরি হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতিকে ফিরিয়ে এনেছিল (মমতা ব্যানার্জী তখন যেটাকে ‘’অমার্জনীয় অপরাধ’’ বলে বর্ণনা করেছিলেন)। ফ্রিজারে সর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগার কথা প্রাথমিকভাবে বলা হলেও, ওষুধ কেনা নিয়ে দুর্নীতিকে আড়াল করতে অন্তর্ঘাত চালানোর প্রশ্নও উঠেছে।
শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভের পরিণতিতে ইসলামপুরের দাড়িভিট স্কুলে গুলিতে প্রাক্তন দুই ছাত্রের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটল ২০ সেপ্টেম্বর। সংস্কৃত ও উর্দু ভাষার শিক্ষক নিয়োগের নির্দেশ হল, শিক্ষকরা স্কুলে যোগ দিতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়লেন, শ্লোগান উঠল, ‘’উর্দু শিক্ষক চাই না, বাংলা ভাষার শিক্ষক চাই’’, বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে পাকিয়ে ওঠা গোলমালে গুলি চলল, গুলিতে মারা গেল ১৯ বছরের রাজেশ সরকার এবং ২১ বছরের তাপস বর্মন নামে ঐ স্কুলেরই দুই প্রাক্তন ছাত্র। গুলি কে চালাল? নিহতদের পরিবারের লোকজন এবং অঞ্চলে যথেষ্ট সক্রিয় বিজেপি দাবি করল গুলি পুলিশ চালিয়েছে, আর পুলিশ গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করল। তৃণমূল ও পুলিশ কর্তারা বললেন, গোলমাল পাকাতে বিজেপি বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসেছে আর তারাই গুলি চালিয়েছে। নিহতদের পরিবারের লোকজন ছেলেদের দাহ করার পরিবর্তে কবর দিল এই আশায় যে, সিবিআই তদন্ত হলে তাদের দেহ মাটির নীচ থেকে তুলে আবার পরীক্ষা করা যাবে। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে; নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে, অঞ্চলে সক্রিয় বিজেপি ঘোলা জলে মাছ ধরতে মুখিয়ে আছে — এ সমস্ত খবর পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে না থাকার কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ সত্ত্বেও প্রশাসন পরিস্থিতির মোকাবিলায় ব্যর্থ হল, তৃণমূলের স্থানীয় দুই পক্ষ পরিস্থিতিকে ঘোরালো করে তুলতে যথেষ্ট অবদান রাখলেন। আর বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের খেলা জোরদার করার সুযোগকে দু-হাতে লুফে নিয়ে বাংলা বনধেরও ডাক দিল।
দমদমের নাগেরবাজারে ২ অক্টোবর এক বোমা বিস্ফোরণে নিহত হল এক পরিচারিকার ৮ বছরের ছেলে বিভাস ঘোষ, আহত হন পরিচারিকা সহ আরো কিছু মানুষ। এর পাঁচদিন পরই ৭ অক্টোবর সোনারপুরে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত হলেন ১৯ বছর বয়স্ক দেবাশীষ সর্দার। আহত হলেন আরো সাতজন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঐ বাজি কারখানায় এ নিয়ে দু-বছরের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটল দুবার। দুটি বিস্ফোরণের ক্ষেত্রেই নিরাপত্তাহীনতার কবলে পড়ে স্থানীয় জনগণ তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া, এ সময়ের মার্কামারা ঘটনা না হলেও ঘটেছে তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘাতের বেশ কিছু ঘটনা, যা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে। গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের ঘটনাগুলির পরিণতিতে কিছু কর্মীর প্রাণ যাওয়া এবং কিছু কর্মীর আহত ও পঙ্গু হওয়ার সাথে স্থানীয় এলাকাও আতঙ্কের কবলগ্রস্ত হয়েছে। ঘটনাগুলো কোথাও ঘটেছে পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনকে কেন্দ্র করে, কোথাও বা অটো রুটের দখল নেওয়া, সিণ্ডিকেট ব্যবসাকে কব্জা করা এবং এমনকি রক্তদান শিবিরের আয়োজনকে কেন্দ্র করে।
সরকারকে বিব্রত করার মত অল্প সময়কালের মধ্যে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনার ব্যাখ্যা কি হতে পারে? এটাই বোধ হয় বাস্তবের নিয়ম, ঘটনার বহুলতা যখন আমাদের ঝুঁটি নাড়িয়ে দিয়ে বাস্তবের হালহকিকতকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ঘটনাগুলোর একদিকে রয়েছে প্রশাসনিক অপদার্থতা, দুর্ঘটনার দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সেগুলার পুনরাবৃত্তি রোধে অনীহা, রাজনৈতিক পেশির জোরে টাকা কামানোর পথের কাঁটা সরানো। পঞ্চায়েতে যাঁরা যাবেন তাঁরা তো পঞ্চায়েতের কাজ করবেন, যথার্থ অর্থে তাদের তো হওয়া উচিত জনগণের সেবক। পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষের ব্যাপকতা দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে জনৈক রসিক বন্ধুর মন্তব্য, যিনি হালফিলের জনসেবকদের কাজকারবার সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন—এরা পেটে ছুরি ধরে বলে ‘’জনগণের সেবা করতে দিবিনে!’’ আর ইসলামপুরের দাড়িভিট স্কুলের ঘটনা মমতা ব্যানার্জীর দলের জনভিত্তিতে ভাঙনকেও নির্দেশিত করছে। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণবঙ্গের বীরভূম, পুরুলিয়ার মতো কিছু জেলায় তৃণমূলের প্রতিপক্ষ হয়ে সামনে আসছে সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিবাদী বিজেপি। এর ইঙ্গিত বেশ কিছুদিন ধরেই আসছিল। তৃণমূলের স্বৈরাচারী আচার-আচরণ, ‘মুসলিম তোষণ’, বাংলাদেশ থেকে ঘটা ‘অনুপ্রবেশ’-এর মত ইস্যুগুলোকে ধরে কোথাও কোথাও বিজেপির বাড়বাড়ন্তের অভিব্যক্তি প্রকট হচ্ছিল। কিন্তু বিজেপির রাজনীতি-মতাদর্শের আপোষহীন মোকাবিলা না করে মমতা ব্যানার্জী আরো বেশি রামনবমি উদযাপন, আরো বেশি গণেশ পূজোকে তাঁদের কৌশল করে তুললেন। এই নির্বিষ কৌশল হিন্দুত্ববাদী ভাবধারাকেই শক্তিশালী করল। আর সর্বোপরি, এই ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে জনপ্রিয়তাবাদের সীমাবদ্ধতাও সামনে এল। কন্যাশ্রী (রাষ্ট্রপুঞ্জের পুরস্কৃত হওয়া সত্ত্বেও), রূপশ্রী, সবুজ সাথী, খাদ্যশ্রী ইত্যাদি প্রকল্প সীমিত লাভই দিতে পারে। তৃণমূল সরকারের ‘উন্নয়ন’ যে ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণের কাছে পৌঁছায়নি, সরকারের জাহির করা প্রকল্পগুলো যে জনগণের বুনিয়াদি সমস্যার সমাধান করতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে, স্বাস্থ্য পরিষেবাকে সহজলভ্য করতে, শ্রমিক-কৃষকের সংকটের সুরাহা করতে পারেনি, তৃণমূল সরকার সম্পর্কে জনগণের মোহভঙ্গের প্রক্রিয়া যে শুরু হয়েছে—কোন না কোন ঘটনা প্রতিদিনই তার সংকেত দিচ্ছে।