খবরা-খবর
বামনী ঝর্ণা ফিরিয়ে নেওয়ার কর্মসূচি বনাধিকার আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিল
forest rights movement

১৫ নভেম্বর বিরসা মুণ্ডা জন্মজয়ন্তিতে বামনী ঝর্ণা ভ্রমণক্ষেত্রে প্রবেশপথের কাছে জমায়েত হয়েছিলেন শত শত গ্রামবাসী। তাঁরা ফিরে নিতে চান বনভূমির ওপর তাঁদের অধিকার। এই অধিকার আইনসিদ্ধ। ২০০৬ সালের বনাধিকার স্বীকৃতি আইন বনসম্পদের ওপর বন ও বনসংলগ্ন গ্রামগুলির আদিবাসী ও অন্যান্য পরম্পরাগত অধিবাসীদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকার স্বীকার করেছে এবং এই অধিকার বাস্তবায়িত করার কথা বলেছে। তাঁদের যাপন জীবন-জীবিকা এই পাহাড় অরণ্য ঝোরার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। বরুয়াজারা, দুলগুবেড়া, বাঁধঘুটা গ্রামের মানুষেরা গ্রামসভা গঠন করে এই আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কর্মসূচি নিয়েছেন। তাঁরা এই ঝর্ণা অরণ্য ও পাহাড়কে বাঁচিয়ে রাখতে চান। বাঁচাতে চান এক মেগা প্রজেক্টের গ্রাসে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাত থেকে। বিরসা মুণ্ডা জন্মজয়ন্তিতে তাঁরা সমষ্টিগত বনাধিকার ঘোষণা করতে বামনী ঝর্ণার প্রবেশপথে একটি বোর্ড লাগিয়ে দেন। পুরুলিয়া জেলার বাঘমুণ্ডি ফরেস্ট রেঞ্জের সরকারি সাইনবোর্ডের নিচে তাঁরা এই বোর্ডটি টাঙিয়ে দেন। ভ্রমণপিপাসু মানুষকে স্বাগত জানিয়ে এই বোর্ডে তাঁরা বামনী ঝর্ণাকে ‘গ্রামসভা পরিচালিত দর্শনীয় স্থান’ বলে বর্ণনা করেন।

বাঘমুণ্ডি ফরেস্ট রেঞ্জের অফিসার গ্রামসভাকে বেআইনি বলে সাব্যস্ত করে, কর্মসূচিতে বাধা দেয় এবং গ্রামসভার সংগঠক আদিবাসী নেতাদের ১১ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করে। তিনি আদিবাসীদের প্রতি জাতিবিদ্বেষী কটূক্তিও করেন বলে অভিযোগ।

অযোধ্যা অরণ্যপাহাড়ের গ্রামবাসীদের এই লড়াই ২০১৭ সাল থেকে দানা বাঁধতে শুরু করে। তাঁদের জীবন-জীবিকার ভিত্তি এই অরণ্য পাহাড় ঝর্ণার ওপর প্রত্যক্ষ আগ্রাসন অবশ্য তারও এক দশক আগে নেমে এসেছিল। ২০০৮ সালে পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট (পিপিএসপি) উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালে বয়ে চলা পাহাড়ি ঝোরা বামনী নদীকে বেঁধে দেয় এই প্রকল্প। ২,৯৫৩ কোটি টাকা খরচে জাপানি কোম্পানিকে দিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হয়। সাতটি টিলার বারোশ একর বনভূমি তথা সাড়ে তিন লক্ষ বৃক্ষ বিলুপ্ত হয়। গ্রামবাসীরা প্রথমে বিরোধ করেছিলেন, কিন্তু প্রতিরোধ দানা বাঁধেনি। তৎকালীন সরকার তাঁদের বুঝিয়েছিল যে এই প্রকল্পের ফলে তাঁদেরও অনেক উন্নতি হবে। বলেছিল, পিপিএসপি’র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত সব গ্রাম বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পাবে, যুবকেরা চাকরি পাবে, জলাধারের জলে চাষবাসের চেহারাও বদলে যাবে। বলাই বাহুল্য, স্থানীয় কারোরই চাকরি হয়নি। প্রকল্পে সঞ্চিত বিদ্যুৎশক্তি চলে যায় আরামবাগ ও রাঁচি শহরে। বামনীর জলধারায় পুষ্ট চাষ ঝাড় খেয়েছে। ক্ষতিপূরণমূলক বনসৃজন প্রকল্পে যে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো হয়েছে তা মাটির জলতলকে আরও শুকিয়ে দিয়েছে। প্রকল্পের নির্মাণকাজে বিশাল পরিমান জমির উপরিতলের মাটি চলে গেছে। সবুজ এলাকা রুক্ষভূমিতে পর্যবসিত হয়েছে। হাতির পাল খাবারের সন্ধানে নেমে আসছে সমতলের গ্রামগুলিতে। আর বামনী নদীবাঁধ পিকনিক স্পট হয়ে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য গৃহপালিত ও অন্যান্য জীবকুলের মারাত্মক ক্ষতি করছে। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে চলতে চলতেই ২০১৫ সালে যখন আরও একটি প্রকল্প এসে হাজির হয় তখন প্রতিরোধ গড়তে তৎপর হন গ্রামবাসীরা। ‘ঠুড়গা পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট’ বা টিপিএসপি। এবং সেখানেই শেষ নয়, লাইনে আছে আরও দুইটি পিএসপি  কাঠালজল পিএসপি এবং বান্দু পিএসপি।

new dimension to the forest rights movement

বামনী ঝোরার পিপিএসপি থেকে ঠুড়গা নদীর টিপিএসপি-র দূরত্ব মাত্র আড়াই-তিন কিলোমিটার। সব মিলিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের এই চারটা প্রকল্পের বিধ্বংসী প্রভাব যে কতটা বিপর্যয় তৈরি করবে তা জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই আঁচ করতে পারছেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু সরকার প্রকল্প নিয়েছে গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনা না করেই। বনাধিকার আইন অনুযায়ী এই অরণ্যকে অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন আদিবাসী গ্রামগুলির সমস্টিগত সাধারণ সম্পত্তি হিসাবে মান্যতা দেওয়ার কথা। বনভূমিতে যে কোনও প্রকল্প ছাড়পত্র পেতে গ্রামগুলির গ্রামসভা ডেকে গ্রামের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তত ৫০ শতাংশের অনুমোদন দরকার এবং সম্মতিদাতাদের ন্যুনতম এক তৃতিয়াংশ হতে হবে মহিলা। বলাই বাহুল্য, সরকার এসব কিছুই করেনি। গ্রামবাসীরা এই আইনকে হাতিয়ার করে লড়াইয়ের আশায় বুক বাঁধে। ২০১৮ সালে কলকাতা হাইকোর্টে গ্রামবাসীদের করা মামলায় সরকার ১৭টি গ্রামের মধ্যে মাত্র দুটি গ্রাম পঞ্চায়েতের (গ্রামসভা নয়) ‘অনুমোদন’ দেখাতে পারে যার মধ্যে ১৬০০ জনসংখ্যার আযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে মাত্র ২৪ জনের স্বাক্ষর ছিল, বাঘমুণ্ডির ক্ষেত্রে কোনও স্বাক্ষরই ছিল না। হাইকোর্ট গ্রামবাসীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে টিপিএসপি স্থগিত রাখার আদেশ দেয়। সরকার ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানায়। আদিবাসী নেতৃত্ব গ্রামে গ্রামে গ্রামসভা গঠনের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যায়। বড় বড় জমায়েত করে বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও প্রতিবাদপত্র জমা দেওয়া চলে। প্রতি পদে পদেই পুলিশী নিপীড়নের শিকার হতে হয় আন্দোলনকর্মী তথা আদিবাসী নেতাদের। এমনকি গ্রামে গ্রামে ‘জনসচেতনতা অভিযান’ কর্মসূচির সংগঠকদের বিরুদ্ধেও করোনাকালীন বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে কেস দেওয়া হয়।

বামনী ঝোরা রিক্লেইম করার কর্মসূচি বনাধিকার ও পরিবেশ-অধিকার আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করল। বনাধিকার আইন অনুযায়ী অল্পস্বল্প মাত্রায় কিছু জমির ওপর ব্যক্তিগত দাবিকে মেনে নিলেও সমস্টিগত দাবি মানার উদাহরণ একেবারে নাই বললেই চলে। বনাধিকার আইন পাস হওয়ার পর এরাজ্যের সরকার যখন ২০০৮ সালে রুলস তৈরি করে তখনই তারা তৎকালীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ‘গ্রাম সংসদ’কেই ‘গ্রামসভা’ হিসেবে অভিহিত করেছিল যা বনাধিকার আইনে বর্ণিত গ্রামসভার ধারণাকে নাকচ করে দেওয়ার সামিল। গ্রামসভাকে হাতিয়ার করে আদিবাসী-বনবাসীদের স্বায়ত্ত্বতার লড়াই গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। সমষ্টিগত বনাধিকারের দাবিও তেমন আর সামনে আসতে দেখা যায়নি। এবং আদিবাসীদের প্রতি যে জাতিবিদ্বেষী অবমাননাকর মন্তব্য বাঘমুণ্ডির ফরেস্ট অফিসার করেছেন তা আসলে আদিবাসী-বনগ্রামবাসীদের প্রতি এই অফিসার শ্রেণীর সাধারণ মনবোভাব এবং তা দেখিয়ে দেয় যে আইন থাকলেও সমষ্টিগত বনাধিকার বাস্তবে লাগু করা কতটা কঠিন। বাঘমুণ্ডির ফরেস্ট অফিসার সম্ভবত ২০০৮’র রুলস মাথায় রেখে গ্রামসভাকেই বেআইনি বলে দেগে দিয়েছেন। অন্যদিকে এরাজ্যে অসংখ্য আদিবাসী মানুষের বসবাস থাকা সত্ত্বেও কোনও আদিবাসী এলাকা পঞ্চম তপশিলভুক্ত নেই। অযোধ্যা পাহাড়ের গ্রামবাসীদের গ্রামসভা গঠন আন্দোলন এবং গ্রামসভাগুলির পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট বনভূমি, পাহাড় ও ঝর্ণাকে ফিরিয়ে নিতে এই দৃঢ় আত্মঘোষণা বিরসা মুণ্ডার তোলা শ্লোগানকে আবারও জীবন্ত করে দিয়েছে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-45