প্রতিবেদন
বিচারের বাণী কেঁদেই চলেছে
The judgment cry

গণধর্ষণ কাণ্ডে লিপ্ত তিনজন অপরাধীকে এবার বেকসুর খালাস করে দিল সর্বোচ্চ আদালত! আটবছর পর। গণধর্ষণের পর নৃশংস ভাবে সেই মহিলাকে খুন ও করা হয়। যে ট্রায়াল কোর্ট ওই তিনজন অপরাধীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট সেই রায়কে খারিজ করে আসামীদের মুক্তি দিয়ে দিল।

সুপ্রিম কোর্টের তিনজন বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ — সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ইউ ইউ ললিত, এস রবীন্দ্র ভট্ট, এবং বেলা এম ত্রিবেদি, বিচার প্রক্রিয়ার শেষে জানান, যে সমস্ত পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য সাবুদের উপর নির্ভর করে এই তিনজনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়, তা অত্যন্ত দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আর প্রমাণ সাপেক্ষ নয়।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফাঁসির আদেশ দেওয়ার সময় সেশন কোর্ট বলেছিল, “এই তিনজনের বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই। যে ঘৃণ্য অপরাধ তারা করেছে, তার জন্য এদের নেই বিন্দুমাত্র অনুতাপ”। ২০১৪ সালের আগস্টে দিল্লি হাইকোর্টে এই মামলাটির শুনানির পর সেখানেও নিম্ন আদালতে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয়।

স্বভাবতই, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ে ভেঙে পড়েন মেয়েটির বাবা ও মা। তারা বলেন, “আমরা গরিব। তাই আমাদের এই পরিণতি।” মৃতার বাবা একজন নিরাপত্তা কর্মী। বোঝাই যাচ্ছে, অভাবে দিন কাটানো এই পরিবারটির পক্ষে অনেক অর্থের বিনিময়ে কোনো একজন প্রথম সারির আইনজীবীকে নিয়োগ করা সম্ভবপর ছিল না।

১৯ বছরের ওই মহিলাটি গুরুগ্রামের সাইবার সিটি অফিস থেকে ফেরার সময় অপহৃত হন। মেয়েটির সাথে তাঁর তিন বন্ধু ছিল। আততায়ীরা গাড়ি করে এসে তাঁকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নেয়। বাড়িতে দীর্ঘক্ষণ না ফেরায় তাঁর পরিবার পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ দায়ের করে। পরে পুলিশ বেশ কিছুটা দূরে তিন দিন পর এক গ্রামের পাশে মেয়েটির ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার করে। পুলিশ পরে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের অনুসন্ধান রিপোর্টে বলা হয়েছে, মেয়েটির ক্ষত বিক্ষত দেহে অনেক আঘাতের চিহ্ন। পুলিশের রিপোর্ট জানিয়েছে, গণধর্ষনের পর মেয়েটিকে খুন করা হয়েছে। মৃতার বাবা বলেন, তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ করার পর অ্যাসিড ঢেলে বেদম শারীরিক অত্যাচার করে খুন করা হয়।

সর্বোচ্চ আদালতের যুক্তি হল, তারা খতিয়ে দেখেছেন যে যাদের যাদের সাক্ষী হিসাবে দাঁড় করানো হয়, তারা জানিয়েছে যে কোনো টিআই প্যারেড হয়নি (অপরাধীদের সনাক্ত করার জন্য যা করা হয়ে থাকে), কোনো সাক্ষীও অপরাধী হিসাবে অভিযুক্ত আসামীদের সনাক্ত করেনি, তাই গোটা তদন্ত প্রক্রিয়াটাই দাঁড়িয়ে ছিল নিছক সন্দেহের ভিত্তিতে, পারিপার্শ্বিক সাখ্য সাবুদের উপর, কোনো দৃঢ় প্রমাণের আধারে নয়। সুপ্রিম কোর্ট আরও জানায়, গাড়ি থেকে শুরু করে যে সমস্ত অস্ত্র বা নানান ধরনের জিনিষপত্র পাওয়া গেছিল, সেগুলো যে ধর্ষণকাণ্ডে ব্যবহার করা হয় তার উপযুক্ত প্রমাণ, ফরেন্সিক রিপোর্ট ও অনুসন্ধানকারী কর্তাব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। “গভীর এক ষড়যন্ত্রের সাথে এই ব্যক্তিরা জড়িত থাকলেও, যেহেতু আদালতে তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাই তাদের রেহাই করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই” — এই ছিল সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ।

দু-দুটো আদালত যে ফাঁসির আদেশ দিল ও বহাল রাখল, তা কি এতই ফাঁপা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল? প্রশ্ন উঠেছে, গুরুতর এই অপরাধের তদন্ত অনুসন্ধান কি এতই গা-ছাড়া মনোভাব নিয়ে পরিচালিত হয়? এতই ভাসা ভাসা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-সাবুদের উপর যে তদন্ত দাঁড়িয়ে ছিল তা কি রায়দানের সময় মহামান্য আদালতের বিবেচনায় ধরা পড়েনি? কেনই বা ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনার ফের যথাযথ, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও তার ফাঁকগুলোকে ভরাট করার আদেশ দেওয়া হল না কেন?

এই সমগ্র ঘটনা আবার চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত অপরাধীদের শাস্তি দিতে পুলিশ-প্রশাসন, বিচারদানের প্রক্রিয়া কী নিদারুণভাবে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে পরিচালিত হয়, যার শত ছিদ্রপথ দিয়ে অপরাধীরা মুক্তি পেয়ে যায়, বা বেকসুর খালাস করার রাস্তা তাদের তৈরি করে দেওয়া হয়।

এই ঘটনা এই শিক্ষা দিল, গোটা তদন্ত প্রক্রিয়ায় নাগরিক সমাজের যথাযথ নজরদারি, আইনের ফাঁক গুলোকে ভরাট করার জন্য তীব্র জনমত গড়ে তোলা এবং প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার উপর লাগাতার চাপ বজায় রাখা কতটা জরুরি।

বিলকিস বানো-র অপরাধীদের ফুলের মালা পরিয়ে জেল থেকে বরণ করা হল, এই ঘটনায় ধর্ষকেরা দিব্যি মুক্তি পেল “প্রকৃত সাক্ষ্যের অভাবে”। কি বিচিত্র আইনের ব্যাখ্যা। ততধিক বিচিত্র আদালত-পুলিশ প্রশাসন ও তদন্তকারী অফিসারদের অবস্থান। মানুষকে তাই এই সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত আওয়াজ তুলতে হবে।

(তথ্য সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রস, ৮ নভেম্বর)
– স্বপ্না চক্রবর্তী

খণ্ড-29
সংখ্যা-44