সম্পাদকীয়
রাজ্যে কৃষি-সংকট মাথা তুলছে
Agricultural crisis

দুয়ারে সরকারের চিল-চিৎকারেও চাপা দেওয়া গেল না ফের আলু চাষির আত্মহত্যার বেদনার্ত কাহিনী। অল্প দিনের ব্যবধানে রাজ্যের খাদ্যগোলা হিসাবে খ্যাত বর্ধমান জেলায় এক সপ্তাহের মধ্যে দু’দুজন আলুচাষির মৃত্যুর খবর এল। সুদ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার পর দেনায় জর্জরিত আলু চাষি সঈদ আব্দুল মোমিন কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন। হঠাৎ খোলা বাজারে আলুর দাম হুহু করে নীচে নেমে যাওয়ায় আজ আলু ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত।

এই মরশুমে আলুর দাম সর্বনিম্নে ঠেকেছে — অতীতে যা কখনও ঘটেনি। প্রথম দিকে ৫০ কেজি বস্তা পিছু দাম ছিল ৮০০ টাকা, তার দাম কমতে কমতে এখন এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ টাকায়! নভেম্বরে যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ আলু হিমঘর থেকে খালাস হতো, এবার প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি আলু এখনও মজুত রয়েছে হিমঘরে। আলুর দাম এতোই নিচে নেমেছে যে, চাষিরা আলু হিমঘর থেকে বার করছে না। সাধারণত, আলু হিমঘরে রাখার পর চাষি যে রসিদ পায়, সেটাই তারা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই সমস্ত মধ্যস্বত্বভোগীরা তখনই আলু হিমঘর থেকে বার করে বাজারে ছাড়ে যখন দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়। কিন্তু এবার প্রায় ৫০ শতাংশ আলু হিমঘরে মজুত থাকায় সেই সমস্ত মধ্যস্বত্বভোগীরা আলু চাষিদের কাছে থেকে রসিদ কিনছে না। এদিকে নতুন আলুও বাজারে উঠতে শুরু করেছে। ফলে, চাষিরাও পড়ল চরম বিপাকে। ধার দেনা করে চাষ করার পরও তা বিক্রি না হওয়ায় ঋণে জর্জর চাষি পরিত্রাণের পথ খুঁজতে আত্মঘাতী হচ্ছেন।

দুয়ারে সরকারের বিজ্ঞাপন এই সর্বনাশ থেকে চাষিদের বাঁচাতে পারছে না।

সঈদ আব্দুল তাঁর সাত বিঘা জমিতে আলু ফলায়, আর হিমঘরে জমা রাখে ২০০ বস্তা। অবশিষ্ট জমিতে তিনি আমন ধান রোপন করেন আর সুদ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৬ লক্ষ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু সেই আলু জমা রাখার পর যে রসিদ তিনি পেয়েছিলেন, তা কেনার লোক না পাওয়ায় ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। গতবছর থেকেই আলু চাষিদের বিঘা পিছু ৭০০ টাকা লোকসান হচ্ছে। খোলা বাজারে আলুর দাম ভীষণভাবে ওঠানামা করে। বাজারের অনিশ্চিয়তার এই নিয়তির উপরই নির্ভর করে চলেছে আলু চাষিদের ভবিতব্য।

এদিকে, রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে, ধান বিক্রি করতে হলে অনলাইনে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। এরাজ্যে সরকার ও তার প্রশাসনের সর্বাঙ্গে দুর্নীতির গভীর বিস্তারি শাখা প্রশাখায় কলেজ ভর্তি, আবাস যোজনা, নির্মাণ শ্রমিকদের নাম নথিভুক্তিকরণ — সর্বত্র দুর্নীতির করাল গ্রাস, তা রুখতে পারেনি ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগীদের আগ্রাসী থাবা। এরফলে, প্রান্তিক চাষিদের নাম নথিভুক্তির জন্য একশ্রেণির দালাল গজিয়ে উঠবে, এমন আশঙ্কা বেশ কিছু মহল থেকে করা হচ্ছে। এই ফরমানের ফলে বাংলার অগুন্তি চাষির জমির নথি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ভোটার কার্ড ও আধার কার্ডের তথ্য একটি সরকারি দফতরে গচ্ছিত হবে। কালক্রমে এই সমস্ত তথ্য’র অপব্যবহার যে হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। রাজ্য সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করলেও মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা তার অধিকাংশটাকেই আত্মসাৎ করে ফেলে।

কৃষক সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের কাছে এমএসপি সহ বেশ কিছু প্রস্তাব কৃষকদের স্বার্থে পাঠিয়েছে। কিন্তু সেসব নিয়ে তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করার, তাদের পরামর্শ শোনার অবকাশ কোথায় মুখ্যমন্ত্রীর?

রাজ্যে কৃষি সংকটের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকলে আগামীতে ঘনিয়ে ওঠা প্রলয় যে বন্ধ হবে না, তা আমাদের সর্বোজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রীর জানা উচিত।

খণ্ড-29
সংখ্যা-45