প্রতিবেদন
এই পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের ভূমিকা

বিজেপি ৯ মাসের  ক্ষমতায় একের পর এক যে সমস্ত নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে চলেছে। জনমতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে চলছে। এনআরসি, সিএএ, এনপিআর নিয়ে আজ সমগ্র দেশ উওাল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া, সেখানকার জনগণকে সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী করে দেওয়া হয়েছে। ৩৭০ ও ৩৫এ ধারাকে গায়ের জোরে বিলুপ্ত করে দেওয়া হল। ভারতীয় জনগণের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সংবিধানের ১৪নং ধারাকে অমান্য করে নতুন ভাবে যে  নাগরিকপঞ্জি গড়ে তোলার ফরমান জারী হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে হিন্দু রাজ গড়ে তোলার ছক। ধর্মের নামে নাগরিকদের বিচার করা সংবিধান বিরোধী। দেশজুড়ে বিক্ষোভ, ছাত্র ছাত্রীদের, দেশের জাতীয় পতাকা হাতে শাহীনবাগ,পার্ক সার্কাস সহ কম করে শতাধিক জায়গায় মুসলিম সমাজের হাজার হাজার মহিলাদের মাসব্যাপী রাতদিন গণঅবস্থান চলছে। তাদের সমর্থনে ও সংহতিতে হিন্দুদের সহযোগিতা  ঐতিহাসিক হয়ে উঠেছে। তাদের ওপর হামলা করছে আর এস এস-বিজেপি গুন্ডারা। তাতেও পিছিয়ে যাওয়ার পথে পা না বাড়িয়ে আরও প্রতিবাদ জোরদার করছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার বধির।

পাশাপাশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলিকে কর্পোরেটদের কাছে দান করে দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই নোটবন্দি ও জিএসটি করে জনগণের ও ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের অর্থ কেড়ে নেওয়া হল। কাজ হারাল অনেক মেহনতি মানুষ। চাষির ওপর নেমে এল গোদের উপর বিষফোড়া। চাষিরা ফসলের নায্য মূল্য পাচ্ছে না। কর্ম নিশ্চয়তা আইনের বরাদ্দ কমানোর ফলে গ্রামীণ মজুররা কাজ হারাচ্ছে। এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে ১০০ দিনের কাজের টাকা ৯৫০০ কোটি কমিয়ে দিয়েছে। গ্রামীণ চাহিদা ও ক্রয় ক্ষমতা যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতো তার পরিবর্তে কেবল কর্পোরেট ও বহুজাতিকের মুনাফা বাড়ানোর জন্য ২ লক্ষ কোটি টাকা কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। খাদ্য, ফসল সংরক্ষণ, গ্রাম উন্নয়ন প্রভৃতিতে ৭৫০০০ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও বাড়ানো হয়েছে বলা হয়েছে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতিকে হিসেবে ধরলে প্রকৃত বৃদ্ধি শূন্য। এই সবের জন্য দেশের অর্থনীতি বৃদ্ধির হার কমতে কমতে ৬.১ শতাংশ থেকে ৪.৬ শতাংশ হয়েছে। এক শতাংশ ধনীদের হাতে টাকা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে দেশে বেকারত্বের হার ৩.৮ থেকে ৭.৫ শতাংশে বৃদ্ধি হয়েছে। যা রের্কড। গ্রামের কৃষকদের কোন আয় বাড়ছে না। আয় বৃদ্ধির বিষয়ে যদিও বাংলার সরকারের দাবি জাতীয় গড়ের চেয়ে বাংলার বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ। বাংলার কৃষকের আয় নাকি ইতিমধ্যেই তিনগুণ হয়ে গেছে। এই সব দাবির পেছনে যুক্তি কোনদিনই  সামনে আসেনি।  বরং তথ্যের কারসাজি সকলের জানা। যেমন  বাংলার সরকার “ক্রাইম রির্পোট’’ কেন্দ্রকে কয়েক বছর পাঠায়নি। যার মধ্যে দিয়ে কৃষক আত্মহত্যার খবর জানা যায়। এটা না করে কৃষকের আয় “তিনগুণ” হয়ে গেছে দাবি করা যায় না। কেন্দ্রের এই সরকার দেশ ও জনগণকে চরম সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এই সব সমস্যা সরিয়ে রেখে, জাতীয় নাগরিক তালিকা নিয়ে মোদির এই ফ্যাসিস্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশ আজ উওাল। ছাত্র-ছাত্রীদের এবং মুসলিম মহিলাদের দেশব্যাপী এই জোরালো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। এর সাথে কিছু বিজেপি বিরোধী রাজ্যে সরকারগুলির ও পার্টির বিরোধিতা নজর দেওয়ার মতো। দিল্লী ভোটে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেও গোহারা হতে হয়েছে। ২২০ এম পি, মোদি-শাহ প্রচার করেও এই ফল।

বামপন্থী পার্টিগুলির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেের সাথে সাথে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক শক্তির এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিবাদ জোরালো হয়েছে। জেএনইউ, জামিয়া, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘দেশদ্রোহী অভিযোগ’ নিয়েও নবজাগরণে শামিল, ৮ জানুয়ারী দেশজুড়ে শ্রমিক শ্রেণীর ধর্মঘট এবং ২০০ মতো কৃষক সংগঠনের সফল গ্রামীণ ভারত বনধ মোদির বিরুদ্ধে এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র সরকারের কোনো হেলদোল নেই। এরই আলোকে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গতিবিধির বিচার করা প্রয়োজন। এখানে শাসক দল ও বামপন্থীদের ভূমিকার পাশাপাশি সারা দেশের মত বাংলাতেও ছাত্রদের ও মহিলাদের অগ্রণী ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ১১-১২ জানুয়ারী “নরেন্দ্র মোদী ফিরে যাও বা বাংলা ছাড়ো” শ্লোগানে রাজ্য তোলপাড় হয়েছে। সারা বাংলা চিৎকার করেছে। অনেকগুলি ব্যানার ছাড়া মিছিল হয়েছে, যেগুলি নজরকাড়া প্রতিবাদ ও মুখরিত মিছিল। শ্লোগানে ছিল প্রাণ ও উদ্দীপনা। বাংলার নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের প্রতিবাদী আন্দোলনকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি আক্রমণে শুধু নোংরা মানসিকতার প্রকাশ তাই নয়, হুমকি, গালাগালি দিতেও ছাড়েননি। মুসলিম সমাজের বিভিন্ন ধরনের বড় বড় মিছিল দেখেছে বাংলা। এইসব নিয়ে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রশ্ন সামনে এসেছে। ভারতীয় রাজনীতিতে অফুরন্ত ইচ্ছেশক্তি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ও মহিলাদের লাগাতার আন্দোলন নতুন আশা ও সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলেছে। রাত, দিন, খাওয়া, বিশ্রাম সবই ভুলে তারা আন্দোলনে শামিল। রাজনৈতিক নেতারা পেছনে পেছনে থেকে, অরাজনৈতিক বড় বড় জমায়েত বেড়েছে। নতুন প্রজন্মের ছাত্র, যুব, মহিলারা যেন স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিয়েছে। নিজেরাই ভিডিও বানিয়ে, পারদর্শীর মতো এসব কাজ করছে। ব্যানার ছাড়া মিছিল, কিন্তু মোদি, অমিত শাহ ও বিজেপিকে নিয়ে যে শ্লোগান তা বেশ ধারালো ও রাজনৈতিক। এ যেন এক ছক ভাঙ্গার আন্দোলন। শেখার অনেক কিছু আছে। খোলা চোখে দেখতে হবে। আজকে এই অবস্থায় বাংলার বুকে বিজেপির মোকাবিলা কিভাবে হবে, তার রাজনৈতিক কৌশল কি রকম হবে তা ভাবার সময় এসেছে। যা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

তৃণমূল কংগ্রেসের মোদি বিরোধিতাকে যে কোনোভাবেই হোক বিজেপির সাথে আঁতাতের গল্প জুড়ে দেওয়ার বামপন্থী একটি অংশের মধ্যে ভুল রাজনীতি সরলীকরণ ছাড়া কিছু নয়। এইভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে মূল শত্রুকে আড়াল করাই হয়ে যায়। তাতে বিজেপির সঙ্গে নীচে নীচে বন্ধুতের পরিবেশ গড়ে উঠে। এতে ফল যা হয় বামপন্থী কর্মী ও জনগণকে বিজেপির দিকে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়ে যায়। সামনে পৌরসভা নির্বাচন সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিৎ। বাংলার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও জনগণ সেটাই বলেন। তলে তলে বামেদের ‘হিন্দু ধর্মের জনগণের গেরুয়াকরণেরই  কাজে সহযোগিতা হয়ে যায়। দীর্ঘদিন বামপন্থী আন্দোলনের সাথে থেকেও তারা যখন বিজেপিকে ভোট দেয় বা বাংলার বুকে বিজেপির শক্তি বৃদ্ধির কাজে সহযোগি হয়ে উঠে, তখন শুধু খারাপ লাগে তা-ই নয়, বামপন্থী রাজনীতিতে থেকেও তারই সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার মতো মনে হয়। ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থেকে, এইগুলি কোনো বিচ্যুতি বা ভুল মনে হয় না। এরা যখন বলে মমতার জন্যই বাংলায় বিজেপি বাড়ছে, তখন নিজেদের ত্রুটিগুলো বিচার করা দরকার। এইজন্যই তা করা দরকার এই রাজ্যে বামপন্থী আন্দোলন জোরদার করার জন্যে চলমান ও গতিময় আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ছকবাঁধা কিছু কৌশল দিয়ে বিজেপিকে আটকানো যাবে না। গণআন্দোলনের তাজা শক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু পুরনো শক্তি দিয়ে কিছু হবে না। তেমনই নতুন নতুন যে সমস্ত রূপে আন্দোলন চলছে তাকে আত্মস্থ করতে হবে। কৃষিমজুর ও কৃষকদের আন্দোলনে, কিংবা শ্রমিক আন্দোলনে অসংগঠিত শক্তির ব্যপকও বিস্তৃত যে জায়গা সামনে আসছে আজকের সাথে মেলাতে হবে। অর্থনৈতিক বা নাগরিক আন্দোলন যখনই সামাজিক-রাজনৈতিক হয়ে উঠছে তখনই ব্যাপক বিস্তৃত হয়েছে। নতুন নতুন বিকাশগুলি অবশ্যই বুঝতে হবে। নতুন প্রজন্মের এগিয়ে আসাকে উৎসাহ দেওয়া ও তাদের হাতে দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে কোনো দ্বিধা থাকা উচিৎ নয়। বাংলার বুকে বিজেপিকে মোকাবিলা ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতি ও হামলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে শ্রমিক শ্রেণীর ও কৃষক জনগণকে শামিল করার প্রশ্নে ঘাটতি থাকছে। বামপন্থীদের কাছে এই শ্রেণী ও সামাজিক শক্তির সাথে একটা দীর্ঘদিনের সম্পর্ক আছে। এই ধরনের দরিদ্র ও মেহনতী মানুষের বেশি অসুবিধায় পড়বেই, তাই তাদেরকে শামিল করার খুবই প্রয়োজন আছে। এই ব্যাপারে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। যারা প্রতিবাদে ইতিমধ্যে শামিল তাদের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রাখতে হবে। এনআরসি, সিএএ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা কম। যতক্ষণ না প্রত্যাহার হবে ততক্ষণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। এটা শুধু নাগরিক প্রশ্ন নয়, ফ্যাসিবাদের শাসন ও রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে আমাদের থাকতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-3