বাংলাদেশের এক শিক্ষাব্রতী মমতাজ জাহান গত জানুয়ারীতে একটি খোলা চিঠি লেখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে। পত্রলেখিকা বেশ কয়েকটি বিশিষ্ট পরিচিতির অধিকারী, ‘বাফেড’ (বাংলাদেশ ফোরাম ফর এডুকেশনাল ডিপার্টমেন্ট)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যা, সমাজতত্ত্বের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে নির্মীত ফোরাম ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির’ অন্যতম সক্রিয় সদস্যা। জাহানের চিঠির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে পরমাত্মীয়ের আন্তরিক, পরিশীলিত, যুক্তিপূর্ণ ও সুপ্রতিবেশিসুলভ সংবেদনশীলতা। বক্তব্যের মূল আকূতি হল, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ঐতিহ্য পরম্পরাকে অবিকল রাখা হোক। এই আর্তি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর আবেদনে। একইসাথে তিনি নানা দিক থেকে সতর্কও করেছেন। উল্লেখ করেছেন যে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে আমরা ভারতকে দেখে আসছি, সাম্প্রতিক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও তার ভিত্তিতে নাগরিকত্ব পঞ্জীকরণের পদক্ষেপ করলে আমাদের এতদিনকার জানা-বোঝা ভারতের সাথে ঠিক মেলে না। জাহান মনে করিয়েছেন ১৯৪৭- এর তিক্ততা জীবনযন্ত্রণা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে দেশভাগের কথা, এইজন্যই যে, বিদ্বেষ-বিভাজনের সমাজনীতি-রাজনীতির পুনরাবৃত্তির বিষফল থেকে যাতে শুধু ভারত নয়, ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান—তিন পরস্পরের প্রতিবেশি দেশ মুক্ত থাকতে পারে, সেই নিশ্চয়তা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে। জাহান প্রচন্ড উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, নাগরিকত্ব নির্ণয় ও প্রদানের নামে ‘সিএবি’-র (সিএএ) মতো এমন বিদ্বেষপূর্ণ বিল আনা হল কেন! তিনি উস্মা প্রকাশ করেছেন, নাগরিক পঞ্জীকরণের নামে কোনো সম্প্রদায়ের কাউকে নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার কথা কি করে বলা যায়! এটা পুরোপুরি অবৈধ, একেবারেই মানা যায় না। একতার সৌষ্টব থাকে বৈচিত্রের মধ্যেই। ভারতে তো বহুত্বের বসতের ধারা রয়েছে, সাংবিধানিক অধিকার থাকতে হবে হিন্দু, মুসলিম, খ্রীষ্ঠান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক এবং আরও অনেক আদিবাসী-উপজাতি জনগণের। নাগরিকত্বের বিষয়টি তো ধর্মের উর্দ্ধে নির্ধারণেরই। মোদী সরকার যেন মায়ানমার সেনাশাসকদের রাখাইন নাগরিকদের ধরে মেরে তাড়ানোর বর্বর নীতি অনুসরণ না করে। ভারতীয়, পাক বা বাংলাদেশী নাগরিকরা কি জীবন-জীবিকার খোঁজে কানাডা, ইউএসএ, অষ্ট্রেলিয়া পাড়ি দিচ্ছে না! তাই এমন বিভাজনের দেওয়াল তুলে দেওয়ার নীতি থেকে ভারত সরকারের বিরত হওয়া উচিত। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় তথা কাশ্মীরী সহ সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমানাধিকার স্বীকার করা উচিত। দক্ষিণ এশিয়ার এই উপমহাদেশীয় অঞ্চলের উপরোক্ত তিনটি দেশেই যাতে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষেরা নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারে, যাতে এই আভ্যন্তরীণ নিশ্চয়তার ভিত্তিতে তিন দেশের সুপ্রতিবেশিসুলভ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সুনিশ্চিত থাকে, সেইসব সংবেদনশীলতা রেখে কাজ করুন।
মমতাজ জাহানের খোলা চিঠির কোনো খোলামেলা প্রত্যুত্তর দিতে মোদী মহল কিন্তু অস্বীকারই করেছে। পরিস্থিতির পরবর্তী আঁকবাঁক বা ঘনঘটায় প্রমাণ হয়ে গেছে মোদী-শাহ জুটির বিজেপি জমানা দেশকে সর্বগ্রাসী সর্বনাশের দিকে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল এমনকি কেন্দ্রীয় বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে তোতা কথা বলিয়ে নেওয়া হল। রাষ্ট্রপতিও অবলীলায় পাঠ করে গেলেন, সংসদে গৃহীত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নাগরিকদের মানতে হবে। তথাকথিত রাষ্ট্রপ্রধান নমুনা দেখালেন সাংবিধানিক নৈতিকতার মাথা খাওয়ার, এই কঠিন সত্য সম্পর্কে নীরব থাকলেন যে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব হরণ বা প্রদানের ধারণা সংবিধান বিরোধী। এনআরসি নিয়ে উঠেছে যেহেতু প্রবল প্রতিবাদের ঝড়, তাই কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কৌশল নিল তা আপাত ধামাচাপা দেওয়ার, আর উপক্রম করল এনপিআর নামানোর, সাফ জানালো নাগরিকের তথ্যপ্রমাণ চাওয়া হবে। তুরন্ত্ বিরুদ্ধতার উত্তরোত্তর ঝড় উঠলে উক্ত মন্ত্রক নিল নতুন ছল, বলল তথ্যপ্রমাণের কাগজ দেখানো না-দেখানোটা ‘ঐচ্ছিক’! পাশাপাশি পাশবিক আক্রমণ লাগাতার শুরু হল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঘটানো হল প্রকাশ্যে গুলি চালানোর একাধিক ঘটনা। এবং আক্রমণকারী সদর্পে দাবি করল ‘রাম ভক্ত’! স্কুলে পড়া নাবালক-নাবালিকাদের এনআরসি বিরোধী নাটকে অংশ নেওয়ার ‘অপরাধে’ পড়তে হয়েছে পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদের কোপে। মুসলিম মহিলাদের শাহীনবাগ ধাঁচের আন্দোলনে অন্তর্ঘাত করতে মানামানি নেই নোংরামীর কোনও সীমারেখার। লাগাতার করে আসা হয়েছে কুৎসা বর্ষণ। হুমকি দেওয়া হয়েছে রাস্তায় আন্দোলন আর বরদাস্ত না করার। আর সারা দুনিয়া জানে ছয়মাসের ওপর সেনা ছাউনিতে অবরুদ্ধ কাশ্মীর, মানে কাশ্মীরী জনতা। শোনানো হচ্ছে, মার্চ-এপ্রিল থেকে অসমে ফের ডাইন খোঁজার মতো শুরু হবে ‘দেশী-বিদেশী’ মুসলিম বাছাই অভিযান। বলাই বাহুল্য, বিতাড়নের জন্য। একটার পর একটা বিধানসভা নির্বাচন এসেছে, আর তাতে জয়ের গন্ধ পেতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিষবাস্প। প্রতিফল মিলেছে বিস্তর, মাশুল গুণতে হয়েছে, হেরো হতে হয়েছে পরপর ছয়টি বিধানসভা নির্বাচনে। তবু হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের অভিযান বিরত হচ্ছে না, হওয়ার নয়।
এই পরিস্থিতি দাবি জানাচ্ছে তাই পাল্টা মোকাবিলার জেদকে ক্রমাগত বাড়িয়ে তোলার। নাগরিক ভারতের সামনে জোর চ্যালেঞ্জ। এ লড়াই সাংবিধানিক গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষার লড়াই, নাগরিক সভ্যতা ও মানবতার লড়াই। এ লড়াই কঠিন লড়াই, এ লড়াই লড়তে হবে, এ লড়াই তোমার আমার, প্রতিদিন লড়তে হবে।