গত ২৭-২৮ জানুয়ারি, কলকাতায় পলিটব্যুরোর সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শুরু হয় সাম্প্রতিক অতীতে প্রয়াত কমরেড সুখদেব প্রসাদ, মোহন প্রসাদ, মথুরা পাসোয়ান, অসীম ব্যানার্জি, লালু ওরাঁও, মুজিবর রহমান, খগেন ঠাকুর এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। চলমান সিএএ বিরোধী গণউত্থানে নিহত সমস্ত শহিদদের কুর্নিশ জানাচ্ছে পলিটব্যুরো। পি বি বৈঠকের আলাপ আলোচনা ও সিদ্ধান্তগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছিল নিম্নরূপ—
গোটা দেশজুড়ে সিএএ-র বিরুদ্ধতা নজিরবিহীনভাবে এক গণ প্রতিবাদের জোয়ার তৈরি করেছে। শহরের যুব সমাজ, মুসলমান সম্প্রদায় ও বিশেষ করে মুসলমান মহিলারা, উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা, বিশেষ করে আসামে, এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন এই বিক্ষোভ আন্দোলনের পুরোভাগে। এই বিক্ষোভ নির্মম ফ্যাসিস্ট দমন-পীড়নকে উপেক্ষা করার সাহসিকতা ও সংকল্প দেখিয়েছে, নতুন নতুন রূপ ও প্রতিবাদের নতুন মঞ্চের জন্ম দিচ্ছে, সংঘ-বিজেপির আখ্যানকে মোকাবিলা করতে নতুন শ্লোগানের পাশাপাশি আগেকার কবিতা ও গানগুলোকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। এই ফ্যাসিবাদ-বিরোধী গণপ্রতিরোধকে শক্তিশালী করতে আমাদের এই পরিস্থিতিকে সবচেয়ে ভালভাবে সদ্ব্যবহার করতে হবে, নিজেদের রাজনৈতিক ভূমিকা, সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক ও উপস্থিতিকে জোরালো করতে হবে।
এটা লক্ষ্য করার বিষয় যে, শিক্ষিত শহুরে যুব সমাজ ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর সীমানার বাইরে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের বার্তা এখনো পর্যন্ত সাধারণ হিন্দুদের গভীরে পৌঁছাতে পারেনি। সংঘ-বিজেপি বাহিনী এখনো সর্বশক্তি দিয়ে এই ইস্যুটাকে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়াবার চেষ্টা চালাচ্ছে, গোটা বিষয়টাকেই শুধুমাত্র মুসলমানদের উদ্বেগ ও বিক্ষোভ বলে চালাবার চেষ্টা করছে। আর, এভাবে তারা চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের বরাবরের মুসলমান-বিরোধী অবস্থান থেকে সাধারণ হিন্দু জনসাধারণকে এর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে। যদিও বিজেপি এখনো সাধারণ মানুষকে সিএএ-র পক্ষে সামিল করাতে পারেনি, কিন্তু, এখনো পর্যন্ত সিএএ-এনআরসি-এনপিআরের এই বিপজ্জনক প্রকল্প সম্পর্কে সাধারণ হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে অজ্ঞতা ও ঔদাসিন্য কাজ করছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই গোটা প্রকল্পের বার্তাটা নিয়ে যাবার জন্য উদ্যোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। সাধারণ হিন্দু জনসাধারণের কাছে আমাদের এটা স্পষ্ট করে বলতে হবে যে, এনআরসি-তে অন্তর্ভূক্তি না হওয়ার সমূহ বিপদ (আসাম রাজ্যে যা পরিষ্কার দেখা গেল) থাকার পাশাপাশি এনপিআর তাদের ‘সন্দেহজনক’-এর তালিকায় নাম নথিভূক্ত করবে। আর, সিএএ তাঁদের এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সুরক্ষা কবচ দেবেনা, কারণ, তা দেবে একমাত্র পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের ক্ষেত্রে। আসন্ন আইপোয়া, এআইসিসিটিইউ ও এআইকেএম-এর সম্মেলনগুলোকেও ওই লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার এক বড় সুযোগ আমাদের কাছে এসেছে।
বিশেষ করে মুসলমান মহিলারা, আর সাধারণভাবে সম্প্রদায়গত দিক থেকে মুসলমানেরা বিরাট মাত্রায় বাইরে বেরিয়ে এসেছেন অভূতপূর্ব প্রাণশক্তি, সাহসিকতা ও প্রত্যয় নিয়ে। আমরা আন্তরিকভাবে এই বিষয়টাকে স্বাগত জানিয়েছি, আর প্রায় সর্বত্রই আমাদের কমরেডরা শাহিনবাগ ধরনের অবস্থানগুলোতে সামিল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু এখানেও, বিক্ষোভ অবস্থানের এই জায়গাগুলোতে, আমাদের সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে নিয়ে আসতে হবে পার্টি, এআইপিএফ ও বিভিন্ন ধরনের গণ সংগঠনগুলোর ব্যানারে। মহিলা, শ্রমিক, ও কৃষক সমাজকে সংঘ-বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগঠিত করার জন্য আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
আমাদের কমরেডরা ছাত্র-যুবদের ইয়ং ইন্ডিয়ার ব্যানারের তলায় সমাবেশিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। বেশ কিছু রাজ্য ও গুরুত্বপূর্ণ শহরে তার ভাল সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের কাজের সমস্ত ক্ষেত্রগুলোতে এই মঞ্চ ও আন্দোলনের সম্ভাবনাকে পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। আরও বেশি মানুষকে টানতে ও এই মঞ্চগুলোকে মজবুত করতে যেখানে সম্ভব সেখানেই ইনসাফ মঞ্চ ও এআইপিএফ-এর ব্যানারগুলোকে জনপ্রিয় করতে হবে। অন্যান্য বাম ও বিরোধী দলগুলো ও উদারবাদী সংগঠন/উদ্যোগ/ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আমাদের যেখানে যেখানে সম্ভব ও প্রয়োজন, সেখানেই যুক্ত কার্যকলাপ করতে হবে।
ব্যবহারিক দিক থেকে, এনপিআর-এর উপরই এখন প্রধান জোর দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের হাতে এটাই হল সেই হাতিয়ার যার মাধ্যমে সে বেশ কিছু মানুষকে “সন্দেহজনক” দাগিয়ে গোটা ভারত জুড়ে এনআরসি তৈরি করার ভিত্তি রচনা করবে। কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, আর, দু’টি রাজ্য সুপ্রিম কোর্টে এর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছে। বিরোধীদের পরিচালিত সমস্ত রাজ্যগুলোতে এনপিআর বন্ধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে, আর যেখানে সম্ভব সেখানে এনপিআরকে বয়কট করার জন্য জনসাধারণকে প্রণোদিত ও সংগঠিত করতে হবে। এই ইস্যুতে বিহারে ২৫ ফেব্রুয়ারি বিধানসভা অভিযানের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।