গত দু-এক বছর যাবৎ কর্মসংস্থানের এক হতাশাজনক চিত্র প্রকাশ পাচ্ছিল এনএসএসও বা সিএম আইই কর্তৃক পেশ করা প্রতিবেদন সমূহে। ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারির হার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে বলে জানা গিয়েছিল বিগত লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই। সরকার স্বীকার করেনি। উপরন্তু অর্থনীতিবিদ-পরিসংখ্যানবিদদের একহাত নিয়েছিল সরকারের তাঁবেদাররা। নির্বাচনে জয় হাসিল করার পরে সেই পরিসংখ্যানকেই মেনে নিয়েছিল সরকারী কর্তারা।
অন্যদিকে সাম্প্রতিককালে ভারতীয় অর্থনীতি ক্রমাগত গতিহীনতার রাস্তায় হাঁটছে। তার প্রভাব সার্বিকভাবেই অনুভূত হচ্ছে। খোলাখুলি তাকে মানতে না চাইলেও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের প্রতিক্রিয়ায় তাদের দুশ্চিন্তাও যথেষ্টই বোঝা যাচ্ছে। ৫ বছরে ৫ লক্ষ কোটি জলারের অর্থনীতির জয়ঢাক বাজানো আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে, ধনী ব্যবসায়ীদের উপর ভরসা করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার আকাঙ্খায় কর ছাড়ের ঘোষণা হচ্ছে বাজেট পরবর্তীতেও, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়েও কর প্রক্রিয়াকে সহজ ও করের হারকে আকর্ষণীয় করার ঘোষণা করছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিত্যি সুদের হার কমাচ্ছে। তবুও অর্থনীতিতে গতি নেই।
গতি থাকবে কি করে? দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যদি না বাড়ে, যদি দেশের কৃষকের আয় না বৃদ্ধি পায়, ক্ষেতমজুরের, অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিপুল শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি না পায় তাহলে দেশজ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে কোন পথে! কিন্তু যদি অগণিত কর্মহীন বেকারের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে লক্ষ লক্ষ কাজ হারানো শ্রমিক তাহলে তো শ্রমের বাজারের মন্দা থাকবেই, মজুরি বৃদ্ধি পাবে না। আর সেই মন্দার ছাপ সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে। তেমনটাই ঘটছে দেশে।
অতি সম্প্রতি আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাসটেনেবেল ডেভেলপমেন্ট (স্থিতিশীল উন্নয়ন সংক্রান্ত সমীক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র)-এর সন্তোষ মেহরোত্রা ও যযাতিক পারিদা “ভারতের কর্মসংস্থান সমস্যা : বর্ধমান শিক্ষার স্তর ও অকৃষি ক্ষেত্রের হ্রাসমান কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার” শীর্ষক একটি কর্মপত্র (ওয়ার্কিং পেপার) প্রকাশ করেছেন। যে সমীক্ষা অনুসারে ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত ৬ বছর সময়কালে ভারতে নব্বই লাখ কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে ওই ৬ বছরে গড়ে প্রতি বছঢ় প্রায় ২৬ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন।
অ-কৃষি ক্ষেত্রের মধ্যে কেবলমাত্র পরিষেবা ক্ষেত্রে নিয়োগের বৃদ্ধি ঘটেছে, নির্মাণ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে মন্দনের প্রবণতার সাথে অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাজ কমেছে। কর্মসংস্থানের দিক থেকে চাহিদাহীনতার সাথে শ্রম যোগানের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ শেষে কাজের বাজারে যোগ দেওয়া যুবকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় সমাজে অতৃপ্ত কর্মহীন তরুণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। দেশের মোট কাজের প্রায় ৯১ শতাংশ কাজ অ-প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে রয়েছে। কৃষি-বহির্ভূত ক্ষেত্রের মোট কাজের ৮৩.৫ শতাংশ অ-প্রাতিষ্ঠানিক।
২০১১-১২ সালের পর থেকে কৃষি-বহির্ভূত ক্ষেত্রের মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে সংগঠিত ক্ষেত্রের অনুপাত ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ৩০ শতাংশ হয়েছে। উচ্চতর শিক্ষিত, কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যুবকদের মধ্যে উন্মুক্ত বেকারি দ্রুত বেড়েছে। ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮, এই ৬ বছরে কৃষিক্ষেত্রে প্রতি বছরে ৪৫ লক্ষ কাজ কমেছে, ফলে মোট কাজ কমেছে ২ কোটি ৭০ লক্ষ। তার দরুণ সামগ্রিক কর্মসংস্থানে কৃষি ও সহযোগী ক্ষেত্রের অনুপাত ৪৯ শতাংশ থেকে কমে ৪৪ শতাংশে পরিণত হয়েছে। ওই সময়কালে পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্রেও ৩৫ লক্ষ কাজ কমেছে, সেক্ষেত্রেও মোট কাজে ওই ক্ষেত্রের অনুপাত ১২.৬ শতাংশ থেকে ১২.১ শতাংশ হয়েছে। নির্মাণ শিল্পে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পরিমাণও করেছে, যেখানে ২০০৪-০৫ থেকে ২০১২-১৩ সালে গড়ে প্রতিবছরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল ৪০ লক্ষ, ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ সময়কালে সেই বৃদ্ধি গড়ে ৬ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। কেবলমাত্র পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হচ্ছে বছরে ৩০ লক্ষ করে। যদিও অধিকাংশ কাজই নিম্ন স্তরের (আধুনিক পরিষেবা ক্ষেত্রের বাইরে)।
ওই সমীক্ষা অনুযায়, যা বিভিন্ন সরকারী প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, ২০১১-১২ সালে মোট নিযুক্ত শ্রমিক/কর্মচারিদের সংখ্যা ছিল ৪৭ কোটি ৪২ লক্ষ, যা ২০১৭-১৮ সালে ৯১ লক্ষ কমে হয়েছে ৪৬ কোটি ৫১ লক্ষ। অনুরূপ সময়কালে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মোট নিযুক্তি ১৩ কোটি ৮০ লক্ষ থেকে ২ কোটি ২৩ লক্ষ হ্রাস পেয়ে ১১ কোটি ৫৭ লক্ষে পৌঁছেছে। ফলে, ওই বয়সের যুবকদের বেকারি ২০১১-১২ সালে ১ কোটি ১০ লক্ষ থেকে বেড়ে ২০১৭-১৮ সালে ২ কোটি ৫০ লক্ষ হয়েছে।