প্রতিবেদন
মহিলাদের স্থান হচ্ছে ক্রমেই প্রান্তসীমায়

নতুন এক শব্দবন্ধ সম্প্রতি প্রচলিত হয়েছে। “ফেমিনাইজ ইন্ডিয়া’জ গ্রোথ’’, অর্থাৎ, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধিকে মহিলাদের স্বার্থবাহী করে তোলো। বৃহৎ উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষ করে ভারতের বহু ঢাক পেটানো ইনক্লুসিভ আর্থিক বৃদ্ধি যেন আরো বেশি মহিলাদের স্বার্থবাহী হয়ে ওঠে, তা নিয়ে নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দেশের নীতিকারদের দৃষ্টি দিতে বলেছে। দিনের পর দিন আমাদের দেশে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বিপজ্জনক সীমায় পৌঁছেছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর যে ক্ষেত্রগুলো রয়েছে (যেমন, উৎপাদন-পরিষেবা-পরিবহন-যোগাযোগ) সেখানেই শুধু নয়, ভারতীয় অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কারের পরিসরেও মহিলাদের স্থান ক্রমে ক্রমেই চলে যাচ্ছে প্রান্তসীমায়।

উর্দ্ধমুখী আর্থিক বৃদ্ধি, ক্রমে নিম্নমুখী মহিলাদের কর্মসংস্থান :

ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে কমেছে কর্মসংস্থান। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে। এটা এখনকার প্রবণতা নয়। সেই ২০০০ সালে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির গতি যখন ছিল বার্ষিক আট শতাংশ হারে, তখন শ্রম বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ আশংকাজনক মাত্রায় কমেছে। এই বিরোধাভাস নিয়ে চলেছে অনেক জল্পনা, আলোচনা, উঠে এসেছে নানান মতামত। বিশেষ করে আইএলও এই নিয়ে বেশ কিছু গবেষণাধর্মী লেখাপত্র প্রকাশ করেছে। শ্রমের বাজার থেকে মহিলারা কেন উৎখাত হচ্ছে, কেনই বা বেশ ভালো সংখ্যক মহিলা শ্রম বাজার থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন, কেনই বা গ্রামীণ মহিলারা কাজ পাচ্ছেন না তা নিয়ে চলেছে বিস্তর আলাপ আলোচনা।

৯০ এর দশকে নয়া উদার অর্থনীতি রূপায়িত হওয়ার সময়ে কিছু মার্ক্সবাদী নারীবাদী ওই আর্থিক সংস্কারের মধ্যে বেশ কিছু প্রগতিশীলতা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁরা আশা করেছিলেন, নতুন এই আর্থিক সংস্কার উৎপাদন সম্পর্ক—কাজের সাবেক প্রচলিত ধরণের মধ্যে আনবে বড় সড় পরিবর্তন, নয়া উদারবাদী ‘নিরপেক্ষ’ শ্রম বাজার গভীরে গেঁড়ে বসে থাকা জাতপাত ভিত্তিক গ্রামীণ কাঠামোতে আঘাত করে নিম্নবর্গের, প্রান্তিক ও বঞ্চিত মহিলাদের সামনে টেনে আনবে যারা এতদিন থেকে গেছিলেন ধূসর সীমান্তে। তাঁরা এতটা আশা করেছিলেন যে, পুঁজির ভূবনীকরণ আলগা করে দেবে হিন্দু উচ্চ বর্ণের আধিপত্যের আগল আর এর ফলে নিম্ন বর্গীয় মহিলারা তাঁদের শ্রমের প্রকৃত মূল্য আদায় করে নিতে পারবে।

কিন্তু বাস্তবে ফল হলো উল্টো। যে সমাজ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ নিম্ন বর্গীয় মানুষদের আনতে পারলো না সমাজের মূলধারায়, যেখানে চরম বৈষম্যমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর নিগড়ে বাজার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, সেখানে কমার বদলে অসাম্য আরও বাড়বে, বৈ কমবে না। আর, সেজন্য নিম্নবর্গের সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে আসা কম শিক্ষাপ্রাপ্ত, অপ্রশিক্ষিত মহিলারা যে মুক্ত অর্থনীতির খোলা বাজারে আরও বঞ্চিত কোণঠাসা হবেন, তা বলাই বাহুল্য। শ্রম বাজার হয় তাঁদের বিতাড়িত করবে অথবা সীমাবদ্ধ রাখবে নিম্ন আয় সম্পন্ন নিম্ন মানের কাজে। এনএসএসও-এর তথ্য এই প্রবণতারই প্রমাণ দেয়। সেই তথ্য অনুযায়ী, শ্রম বাজার থেকে সবচেয়ে বড় সংখ্যায় উৎখাত হয়েছেন তপশীলি উপজাতি। তারপর হয়েছেন তপশীলি জাতি এবং ওবিসি অন্তর্ভুক্ত মহিলারা। গ্রাম-শহর উভয় ক্ষেত্রেই তপশীলি জাতি ও উপজাতির মহিলারা সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছেন — শহরে তপশীলি জাতির মহিলাদের কাজ খোয়ানোর হার ৫.২ শতাংশ বিন্দু আর, গ্রামে তপশীলি উপজাতির ক্ষেত্রে ওই সংখ্যার হার হচ্ছে ৪.৮ শতাংশ বিন্দু। এবারে বাজেট ভাষণে আমাদের প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “ভারতের আর্থিক বিকাশ বা আরো নির্দিষ্ট অর্থে গ্রামীণ অর্থনীতির বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মহিলাদের ভূমিকা বিরাট। এই সরকার চায় এটা আরো উৎসাহিত করতে আর তাঁদের ভূমিকা আরো বাড়াতে। “কিন্তু পরিহাস এটাই যে এমন সময়ে তিনি এই বিবৃতি দিলেন যখন সরকারি সংস্থা এনএসএসও জানাচ্ছে যে, গ্রামীণ ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকদের সংখ্যা যখন ২ কোটি ৪.৭ লক্ষ কমছে, তখন শহরে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হচ্ছে ২০ লক্ষ ৯ হাজার। অর্থাৎ, কাজ খোয়ানোর মোট সংখ্যা হলো ২ কোটি ১.৮ লক্ষ। ওই একই সময়ে, গ্রামাঞ্চলে ৩০ লক্ষ ৭ হাজার পুরুষ কাজ পেয়েছে, কিন্তু লাভবান হয়েছে শহর। সেখানে ১.২ কোটি মানুষ কাজ পেয়েছে। গ্রামাঞ্চলে কাজ খোয়ানোর পুরোটাই চালান হয়েছে মহিলাদের ক্ষেত্রে। আর, তার মধ্যে ৮৪ শতাংশই কাজ খোয়া গেছে কৃষিক্ষেত্রে। এনএসএসও-এর এই উঠে আসা তথ্য এটাও দেখিয়ে দেয় যে আর্থিক বৃদ্ধির এই গতিপ্রকৃতি বিরাট ভাবে শহুরে পক্ষপাত নিয়ে চলছে। ব্যাপক ভাবে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষিক্ষেত্র, গ্রামীণ অর্থনীতি।

এনএসএসও একটি অনুপাত সূত্রায়িত করেছে — লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট বা এলএফপিআর। এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এর অর্থ হলো, ১৫ বছর ও তার উর্দ্ধে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কর্মী ও কর্মহীন মানুষের অনুপাত। ২০১২ সালে এটা ছিল ৫৫.৫ শতাংশ, যা ২০১৮-তে নেমে দাঁড়িয়েছে ৪৯.৭ শতাংশ হারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে মহিলাদের সংখ্যা— ৩০.৭ শতাংশ (২০১২ সালে) থেকে ২২.৯ শতাংশ (২০১৩-তে)। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত পাকিস্তানের (২৪ শতাংশ) পাশাপাশি এমন একটি দেশ যার এলএফপিআর সর্বনিম্ন। আমাদের উপরে রয়েছে বাংলাদেশ (৩৬ শতাংশ), শ্রীলঙ্কা (৩৫ শতাংশ), আফগানিস্তান (৪৯ শতাংশ), মালয়েশিয়া (৫১ শতাংশ) আর চীন রয়েছে অনেক উপরে (৬১ শতাংশ)। ভারতের কর্মহীনতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনএসএসও যে সমস্ত তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিড়ম্বনা বিরাট ভাবে বেড়েছে। স্বভাবতই এই সংস্থাটি এখন পড়েছে রাজরোষের নজরে। দিন ক’য়েক আগে ক্ষুব্ধ পরিবেশ-বন-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলেই বসলেন, কর্মহীনতা সম্পর্কে এনএসএসও যে তথ্যগুলো প্রকাশ করছে তা ঠিক নয়। তারা ৭০ বছর আগেকার পদ্ধতির ভিত্তিতে কর্মহীনতার যে তথ্যগুলো প্রকাশ করছে তা বেঠিক। এরপর তিনি আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, দুনিয়াজোড়া আর্থিক মন্দা ইউরোপ ও আমেরিকাকেই গ্রাস করেছে। ভারত এখনো বিশ্বে আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দ্রুততম দেশ হিসাবে স্বীকৃত!!

কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট বা বিশ্ব মজুরি রিপোর্ট। ২০১৮-১৯ সালে প্রকাশিত আইএলও-র এই রিপোর্টথেকে জানা যায়, ভারতে মজুরির ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য সর্বাধিক। যে ৭৩টি দেশে আইএলও সমীক্ষা চালিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে পুরুষদের তুলনায় ঘণ্টা পিছু মজুরির প্রশ্নে ভারতের মহিলাদের মজুরির পরিমাণ সবচেয়ে নীচে। ভারতে, মহিলাদের মজুরি গড়ে ৩৪ শতাংশ কম (অন্য দেশের তুলনায়)। এমনকি, যে সমস্ত মহিলাদের রয়েছে উন্নত শিক্ষার মান, তাঁরা ও ওই একই কাজে পুরুষদের তুলনায় বেশ কম মজুরি পেয়ে থাকেন। মাসিক বেতনের ক্ষেত্রে এই মজুরির তফাৎ ২২ শতাংশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মহিলাদের মজুরির তুলনায় আমাদের দেশে মহিলারা অনেক কম মজুরি পেয়ে থাকেন। ২০০৯ সালে, তদানিন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের সার্বিক অবস্থা অনুধাবনে অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের সমীক্ষা জানায় যে, ইনফরমাল কাজের বিপুল ক্ষেত্রটিতে মহিলাদের অত্যন্ত কম মজুরি, কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতা ও যৌন হয়রানি, কাজের অনিশ্চয়তা, সামাজিক সুরক্ষা না থাকা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কারণে মহিলারা শ্রম বাজার থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। ১০ বা তার বেশি সংখ্যক মহিলা কর্মী থাকলে প্রতিটি সংস্থা, তা সরকারি বা বেসরকারি হোক না কেন, আইসিসি গঠন সেখানে বাধ্যতামূলক। কিন্তু আজও এই আইনটিকে রূপায়িত করতে সংশ্লিষ্ট সরকারের তরফ থেকে কঠোর মনোভাব দেখানো হচ্ছে না। মহিলা আন্দোলনের পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়নকেও আইসিসি গঠনের দাবি জোরালোভাবে সামনে আনতে হবে।

পশ্চাদপদতার নিঃসীম অন্ধকারে দেশের অর্দ্ধেক আকাশকে নিক্ষিপ্ত করে, কর্মসংস্থান-সমমজুরি- কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা-সম্ভ্রম সমমর্যাদা, এই সমস্ত অপরিহার্য বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকারে রেখেই আর্থিক বৃদ্ধির গতিমুখকে মহিলাদের স্বার্থবাহী করে তুলতে দরকার রাজনৈতিক সংগ্রাম। আন্দোলনের শ্বাশত পথ ধরেই একমাত্র তা হাসিল করতে হবে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-34