পশ্চিমবাংলায় আর কিছুদিনের মধ্যে তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে উপনির্বাচন। কেন্দ্র তিনটি হল পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুর, নদীয়ার করিমপুর ও উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ। খড়গপুর কেন্দ্রটি শিল্পাঞ্চল অন্তর্গত মিশ্র প্রকৃতির জনবিন্যাসপূর্ণ, বাকি কেন্দ্র দুটি গ্রামীণ ক্ষেত্রের এবং সেখানে কৃষিজীবীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। করিমপুর ও কালিয়াগঞ্জ কেন্দ্রের জনবিন্যাসে রয়েছে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য। আছে ব্যাপক সংখ্যায় মুসলিম জনগণ, আছে দেশভাগের সময় থেকে দফায় দফায় ওপার বাংলা থেকে এসে জীবন-জীবিকায় থিতু হওয়া বিশেষত তপশিলী জাতির উদ্বাস্তু জনতা। এই সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈচিত্রের জমিতে (উপনির্বাচন হলেও) গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক লড়াই দাবি রাখে। বলাবাহুল্য, এরাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল, উপনির্বাচন হতে চলেছে বিধানসভা ক্ষেত্রে, তথাপি বিজেপিকেই করতে হবে প্রত্যাঘাতের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। কারণগুলো খুব পরিষ্কার। ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল অবশ্যই বিপজ্জনক, তবু তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক কেন্দ্রে পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়ে যাওয়া এবং বাংলায় ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া বিজেপি। তাছাড়া ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ও রাজনীতির পৃথকত্ব তথা আরএসএস পরিচালিত হওয়ার বিচারে বিজেপি ভারতীয় শাসকশ্রেণীগুলির মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রকৃতির প্রতিনিধিত্বকারী। দেশকে হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাওয়া, উচ্চবর্ণ-উচ্চজাতি, পিতৃতন্ত্র ও কর্পোরেট পুঁজির আঁতাতের নিগড়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিকভাবে বেঁধে ফেলার সবথেকে ধ্বংসাত্মক কর্মসূচী ও আক্রমণ চালাচ্ছে বিজেপি। তার জন্য জিগির তোলার পুঁজি করছে সামাজিক সাম্প্রদায়িকীকরণ ও উগ্র জাতিদম্ভীকরণকে। হিন্দুত্বই যেখানে প্রথম ও শেষ কথা। হিন্দুত্বের পথে বাধা মনে করে ‘অপর’ এক মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবনকে করে তোলা হচ্ছে দুর্বিষহ। বশ্যতা না মানলে তুমি মরেছ। আর মোদী নীতির স্বরূপ উদ্ঘাটনে ও বিরোধিতায় সরব হলে বেমালুম ‘দেশদ্রোহী’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয়। এই নজীরবিহীন সামগ্রিক আগ্রাসনের হাত থেকে দেশ, দেশের জনগণ, গণতন্ত্র, সংবিধান, বহুত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্প্রীতিকে রক্ষা করতে এক সর্বাত্মক মোকাবিলার প্রয়োজন। প্রতিটি ক্ষেত্রই জীবন-মরণ পণ করার রণাঙ্গন। তাই এরাজ্যে আসন্ন উপনির্বাচনে বিজেপিকে দিতে হবে জোর ধাক্কা।
বিজেপি ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় পেয়েছে ১৮টি আসন। দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে এগিয়ে। বিরাট লাফ দিয়ে বাড়িয়েছে ভোট শতাংশ। তবু এই জয়ের ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনে তার কিছুটা হলেও মুখ পুড়ল। বন্দী করে রাখা কাশ্মীরে ব্লক উন্নয়ন পরিষদ নির্বাচনে, যেখানে অধিকার কর্তন, অবমাননা ও অবাধ মতপ্রকাশের প্রশ্নে প্রহসনের কারণে সমস্ত বিজেপি বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছিল; সেখানে বিজেপির কিছুই কেরামতি দেখানোর ছিল না। অথচ আগ্রাসী প্রচারে কোনও অভাব রাখেনি। কাশ্মীরে ধারা ৩৭০ প্রত্যাহারের এবং অসমে এনআরসি লাগু করার গা-জোয়ারি, ‘ক্যাব’ (হিন্দুনাগরিকত্ব সংশোধনী বিল’ ১৬) দাওয়াই দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি সবই উগড়ে দেয়, তা সত্ত্বেও আলোড়ন তুলতে ব্যর্থহয়েছে। এটা আরও একবার দেখিয়ে দিল লোকসভা নির্বাচন আর বিধানসভা নির্বাচন/উপনির্বাচন, বিধানসভা নির্বাচন আর পৌরসভা/ পঞ্চায়েত নির্বাচন সাধারণত একই খাতে বহে না। একটা নির্বাচনে আকাশে উঠলেও আরেক নির্বাচনে আছাড় খেতে হতে পারে। পৌর কিংবা পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরিণতি খারাপ হতে পারে। বিজেপির ২০১৯ নির্বাচনী ভাগ্য যেন এরকমটাই যাচ্ছে। সুতরাং পশ্চিমবাংলায় আসন্ন তিনটি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে প্রধানত বিজেপির বিরুদ্ধেই জনরোষ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। অবশ্যই রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলকে যা শাস্তি দেওয়ার দেওয়া দরকার, কিন্তু বিজেপিকে তার বিন্দুমাত্র ফায়দা লুটতে দেওয়া যেতে পারে না। বিকল্প হিসেবে বামপন্থী শক্তিগুলোকে যেখানে যতটা সম্ভব উপনির্বাচনী লড়াইয়ে থাকতে হবে, রাখতে হবে।
সামাজিকভাবে বিষিয়ে তুলতে বিজেপি-আরএসএস চক্র চূড়ান্ত মিথ্যাচারের বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। ‘ভারতের ভূখন্ড থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতকে ইসলামিক জেহাদির সাহায্যে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের’ ভূত দেখাচ্ছে। ‘ইসলামিক বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা নাকি ভারতীয় মুসলিমদের জন্য বরাদ্দে ভাগ বসিয়ে ওদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করছে।’ বাঙালি আবেগকে বাগে আনতে আজগুবি প্রচার করছে, ‘সুনির্দিষ্ট হিন্দু সাংষ্কৃতিক পরিচয় ছাড়া কোনও বাঙালি পরিচয় অসম্ভব।’ এরকম বিকৃত প্রচারে কোনো বিরাম নেই। সাচার কমিটির সমীক্ষায় চিহ্নিত হয়েছে বাংলায় যাবতীয় রংবদলের শাসনে মুসলিম জনগণের আর্থ-সামাজিক জীবনে কেবল বঞ্চনা ও নিগ্রহ ক্রমবর্ধমান। বিজেপি এবিষয়ে নিশ্চুপ, আর বলে বেড়াচ্ছে মুসলিমরা রাজ্যের জনসংখ্যার মাত্র ২৭ শতাংশ হলেও বিশেষত বাংলাদেশ সংলগ্ন সাত-আটটি জেলায় তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নাকি ‘জনভারসাম্য বিগড়ে যাওয়া’র শঙ্কা সৃষ্টি করছে! কেন্দ্রের এনসিআরবি-র সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে দেশে তথাকথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী আটকের সংখ্যা ২০১৭ পর্যন্ত মোট ১,৪০৩; তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে আটকের সংখ্যা ১,২৮৪। তর্কের খাতিরে যদি এ পরিসংখ্যান মেনেও নিতে হয় তবু প্রশ্ন হল, সীমান্ত রক্ষার দায় যেখানে কেন্দ্রের সেখানে মোদী সরকার তার ব্যর্থতা স্বীকার করছে না কেন? আর, আটকের যে খতিয়ান শোনানো হচ্ছে তা সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ককে কতটুকু ফোলাতে পারে? একটা মিথ্যা ঢাকতে নিরন্তর মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াই বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির কারবারী বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল। এর সফল উন্মোচন এবং তার ভিত্তিতে জনমত সংগঠিত করার উপরই নির্ভর করছে বিজেপিকে বিধ্বস্ত করে চলার সার্থকতা।