বেআইনিভাবে আড়িপাতা কেলেঙ্কারি : সংবিধান এবং নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের অপরাধ

সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপ (ফেসবুক-এর মালিকানাধীন একটি কোম্পানি) এক বিস্ফোরক বিষয়ের উন্মোচন ঘটিয়েছ। ভারতের বেশ কিছু সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী এবং বিরোধী পক্ষের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের তারা জানিয়েছে যে, এক ইজরায়েলি কোম্পানির বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেবলমাত্র সরকারগুলিকে বিক্রি করা একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে তাদের ফোনে আড়িপাতা হয়েছে। তাদের ফোনে এবং ফোন থেকে হোয়াটসঅ্যাপের পাঠানো মেসেজ বক্স এবং কলগুলোকেই শুধু হ্যাক করা হয়নি; হোয়াটসঅ্যাপের এনক্রিপশন সফটওয়্যারের একটা ফাঁককে কাজে লাগিয়ে ঐ ইজরায়েলি সফটওয়্যার তাদের ফোন এবং কম্পিউটারগুলোকে নজরদারির যন্ত্রে পরিণত করেছে।

যাদের ব্যক্তিগত পরিসরে এরকম বেপরোয়াভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ভীমা কোরেগাঁও কাণ্ডে অভিযুক্তদের আইনজীবীরা এবং তার সাথে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সরব হওয়া সাংবাদিক এবং আন্দোলনের কর্মীরা। কংগ্রেস দলও বলেছে, হোয়াটসঅ্যাপ কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে জানিয়েছে যে তাঁর ফোনেও আড়িপাতা হয়েছে।

এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মোদী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক জানিয়েছে, এই আড়িপাতা সম্পর্কে হোয়াটসঅ্যাপ তাদের কিছু জানায়নি। হোয়াটসঅ্যাপ এই অভিযোগকে খণ্ডন করেছে।

মোদী সরকার কিন্তু এই বিষয়ে নিজের অপরাধ থেকে দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। পেগাসাস নামক নজরদারি চালানোর সফটওয়্যারটা যে শুধু সরকারগুলোকেই বিক্রি করা হয় তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই। কাজেই ভারতে কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার বা কোনো রাজ্য সরকার এবং তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরাই এই সফটওয়্যারটা ব্যবহার করতে পারত। কেন্দ্রে এবং রাজ্যগুলোতে শাসন চালানো বিজেপি সরকারগুলোর সমালোচকদের উপরই যদি এই নজরদারি চালানো হয়ে থাকে তবে সহজেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, সরকারগুলোই এই নজরদারি চালিয়েছে।

কেউ কেউ এই যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, “জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে হলে’’ এই নজরদারি যুক্তিযুক্ত। এই যুক্তি থেকে এটাই বেরিয়ে আসে যে, সরকারকে অপরাধ করতে দেওয়া যায় যদি তা “জাতীয় নিরাপত্তার” জন্য হয়। কোনো গণতন্ত্রই এই অবস্থানকে সমর্থন করতে পারে না। নাগরিক স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার-এর সংজ্ঞা বলে, প্রধানত সরকার এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের ক্ষমতা থেকে এগুলিকে রক্ষা করতে হবে। সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের যেহেতু হিংসা এবং নজরদারি চালানোর ক্ষমতা রয়েছে, সংবিধান তাই ঐ ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। পিইউসিএল-এর রুজু করা এক মামলায় ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক গুরুত্বপূর্ণ রায়ে এটা একেবারেই সুস্পষ্ট করে দেয় যে, লিখিত অনুমোদন ছাড়া কোনো সংস্থাই কোনো ব্যক্তির ফোনে আড়ি পাততে পারে না। জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে জরুরি হয়ে উঠলে সংশ্লিষ্ট সংস্থা কেন্দ্র বা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা রাজ্য বা কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের উচ্চপদস্থ কোনো আধিকারিকের কাছ থেকে লিখিত অনুমোদন চাইতে পারে। জরুরি পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া এই ধরনের প্রতিটি অনুমোদনের ক্ষেত্রেই তার পুনর্বিবেচনার জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে পর্যালোচনা কমিটির কাছে পেশ করতে হবে। এই ধরনের লিখিত অনুমোদন ছাড়া ফোনে আড়িপাতা হলে তা অবশ্যই গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

আমরা স্মরণ করতে পারি, মোদী এবং শাহ যখন গুজরাটের যথাক্রমে মুখ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন সে সময় তাঁরা ব্যক্তিগত কারণে একটি মেয়ের উপর অবৈধ নজরদারি চালাতে পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে এক সন্দেহজনক দৃষ্টান্তের সাক্ষর রেখেছিলেন। মোদী-শাহ জুটি যে এখন আবার একটি সরকারে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সরকার-বিরোধী মতামত প্রকাশকারী নাগরিকদের উপর অবৈধ নজরদারি চালানোর ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছেন, তাতে বোধকরি কেউই বিস্মিত হবেন না।

হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে চলা নজরদারি কেলেঙ্কারি নিয়ে মোদী সরকার যখন ক্রুদ্ধ হওয়ার ভাণ করে এবং হোয়াটসঅ্যাপের কাছে জবাবদিহি চায়, তখন তার হাবভাব সেই চোরের মতো মনে হয় যে নিজেই “চোর! চোর!” চিৎকার করে জনতাকে বিপথে চালিত করে পালানোর চেষ্টা করে।

এটা একেবারেই সম্ভব যে নজরদারির যন্ত্র পেগাসাসকে ব্যবহার করা হয়েছিল (সম্ভবত অন্যান্য প্রযুক্তির সাথে একযোগে) শুধু নিশানায় থাকা ব্যক্তিদের কথোপকথনে অবৈধভাবে আড়িপাততেই নয়, তাদের ফোন বা কম্পিউটারে অন্যান্য বস্তু ঢোকানোর জন্যও তাকে কাজে লাগানো হয়েছিল। ভারত সরকারের কোন সংস্থা নজরদারি চালানোর সফটওয়্যার পেগাসাস কিনেছিল? কে সেটাকে ব্যবহার করেছিল? ফোনে আড়িপাতার অনুমোদন কি তাদের ছিল? যদি মোদী সরকার অথবা কোনো রাজ্য সরকার অথবা সরকারি সংস্থা অবৈধভাবে মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত পরিসরে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ চালিয়ে থাকে তবে তা ভারতীয় সংবিধানের বিরুদ্ধেই এক গুরুতর অপরাধ।

এই অপরাধের সংঘটকদের পরিচয় জানা যাবে কি করে? আরএসএস নেতা গোবিন্দাচার্য এই বিষয়ে এনআই-কে দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন: কিন্তু এই আবেদনের মধ্যে যেন ম্যাচ গড়াপেটার এক আভাস রয়েছে। এনআইএ একটা সরকারি সংস্থা এবং সরকারের হাতে সংঘটিত হওয়ার সম্ভবনাময় কোনো অপরাধের তদন্ত তারা করতে পারে না! অপরাধীদের সনাক্ত করে শাস্তি দেওয়ার জন্য এক নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজন।

রাজনৈতিক দিক থেকে সুস্পষ্ট রূপে প্রতিপন্ন হচ্ছে যে, বিরোধী পক্ষের রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকার কর্মীদের উপর বড় আকারে অবৈধ নজরদারি চালানোর গোটা আখ্যানটায় মোদী ও শাহর হাতের ছাপ মূর্ত হয়ে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ আড়িপাতা কেলেঙ্কারি (ওয়াটার গেট) উন্মোচিত হলে রাষ্ট্রপতি নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়। ভারতে এই অপরাধের জন্য মোদী-শাহ সরকারকেই দায়বদ্ধ করে শাস্তি দিতে হবে। ইজরায়েলি সফটওয়্যার পেগাসাসের বিক্রেতা এটিকে “অস্ত্র”রই শ্রেণীভুক্ত করে। এই অস্ত্র গোপনে কিনে ভারতীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে সেটিকে ব্যবহার করাটা এক সন্ত্রাসবাদী কাজ ছাড়া অন্যকিছু নয়। ভারতের নির্ভীক মানবাধিকার রক্ষার কর্মী, দলিতদের পক্ষের আইনজীবী এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালানোর জন্য মোদী-শাহ সরকারকে শাস্তি দিন।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ৫ নভেম্বর ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-36