বিরাট এক কল্পকথার ফানুস উড়িয়েছেন মোদী। গ্রামীন বিদ্যুদায়ন প্রকল্পের দৌলতে সবচেয়ে অজ পাড়াগাঁতেও নাকি পৌঁছে গেছে বিদ্যুত। কিন্তু, ওড়িষ্যার রূঢ় ধূসর বাস্তবের মাটিতে গিয়ে দেখা গেল তথ্য অন্য কথা বলছে। ১ এপ্রিল, ২০১৫ সাল পর্যন্ত উড়িষ্যায় ৩৪৭৪ গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি পৌঁছায়নি। এটা গ্রামীণ বিদ্যুদায়ন কর্পোরেশনের তথ্য, যা তারা ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮-য় পেশ করেছিল। এর মধ্যে ৫৭১টি গ্রাম বসবাসযোগ্য নয়। সেগুলো জনমানবশূন্য। বিদ্যুৎ দপ্তরের তরফ থেকে যে “গ্রামীণ বিদ্যুদায়ন’’ পোর্টাল রয়েছে, তাতে বলা আছে, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ পর্যন্ত বাদ বাকি ২,০৯৩ গ্রামেই নাকি বিদ্যুৎ পৌঁছেছে।
বারিপদা-দেউলি রাস্তার উপর অবস্থিত বাঁকিসোল গ্রাম, জেলা ময়ূরভঞ্জ (বারিপদা)। জেলার সদর দপ্তর থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার। ওখানকার গ্রামবাসীরা এই সাংবাদিককে বলেন, জন্মের পর থেকে তাঁরা কোনোদিনই বিদ্যুৎ পায়নি। গ্রামীণ বিদ্যুদায়ন কর্মসূচির অধীনে ওই গ্রামে সবই বসেছে — খুঁটি, বিদ্যুতের তার, ট্রান্সফরমার, মিটার, কিন্তু ছ’ মাসের ও বেশি পার হয়ে গেলেও সেখানে আজ পর্যন্ত বিদ্যুতের দেখা নাই।
চন্দ্র মল্লিক এর একটি রেশন দোকান রয়েছে। তিনি জানান, “বিনা লাইট-ফ্যানেই আমাকে দোকান চালাতে হয়। এখনো কাজ সারতে হয় লন্ঠন জ্বালিয়ে’’।
মোবাইল বা এলইডি-কে রিচার্জ করার জন্য দৈনিক ৫ টাকা গ্যাঁটের থেকে খরচ করতে হয়। যেতে হয় পাশের গঞ্জে। গ্রামের অনেকেই সুদখোরের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সৌরচালিত চার্জার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। গ্রামবাসীরা এই সাংবাদিককে বলেন, উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কারণে এই সমস্যার কথা না পৌঁছে স্থানীয় প্রশাসন উল্টে তাদের প্রতি পরিবার পিছু ৫০ টাকা তুলে বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে।
হালে, সরকারও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, পূর্বে প্রকাশিত তথ্য অসম্পূর্ণ, এবং এখনো বহু গ্রাম রয়েছে যেখানে বিদ্যুত পোঁছায়নি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর খুবই পেয়ারের প্রকল্প স্বচ্ছ ভারত অভিযান, যার ঘোষণার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন লাল কেল্লার স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে। তারপর, চার বছর অতিক্রান্ত। স্বচ্ছ ভারতের কর্মসূচিকে রূপায়িত করতে জেলাগুলোর মধ্যে যেন একটা ধূম লেগেছে। স্বচ্ছ ভারতের জন্য বরাদ্দ সেসকে কাজে লাগিয়ে, ‘প্রকাশ্য শৌচকর্মমুক্ত’ জেলা হিসাবে কারা নিজেদের নাম আগে ঘোষণা করবে তার জন্য শৌচালয় তৈরি করতে বিরাট প্রতিযোগিতা শুরু হলো। কিন্তু, নজর দেওয়া হলো না, আদতে, গ্রামের মানুষ তা ব্যবহার করছেন কি করছেন না।
ঝাড়সুগুদা জেলার জামপড়া হলো এমনই এক জেলা, যা পেয়েছে প্রকাশ্য শৌচকর্মমুক্তর শিরোপা। একশো শতাংশ মানুষই নাকি ওই গ্রামে আর প্রকাশ্যে শৌচকর্ম করেন না। ওই গ্রামের ৪০টি ঘরের প্রত্যেকটিতে রয়েছে সরকারের তরফ থেকে তৈরি করে দেওয়া শৌচাগার। কিন্তু নির্মম রসিকতা হল, সেগুলো অব্যবহৃত হয়ে পড়ে রয়েছে। কারণ, ওই গ্রামে জল সরবরাহের ব্যবস্থাই নেই! গ্রামের বাইরে রয়েছে একটা মাত্র হস্ত চালিত নলকূপ। ঝাড়সুগুদার আরও কয়েকটি গ্রামে এবং ওড়িষ্যার দেওগড়, যেগুলিও প্রকাশ্য শৌচকর্মমুক্ত জেলার মুকুট পেয়েছে, সেখানে একই গল্প শোনা যায়।
১৫ মে, ২০১৮-র পর্যন্ত, স্বচ্ছ ভারত অভিযান (গ্রামীণ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ১৭টি রাজ্যের ৩৮৫টি জেলার ৩,৬১,০০৭টি গ্রামকে ঘোষণা করা হয়েছে “প্রকাশ্য শৌচকর্মমুক্ত” গ্রাম হিসাবে, যেখানে নাকি প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে শৌচালয় তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বোবা পরিসংখ্যান যা বলেনি তা হলো, কতগুলো গ্রামে শৌচালয় ব্যবহার করার জন্য রয়েছে যথেষ্ট জল সরবরাহের ব্যবস্থা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গোটা দেশের মধ্যে ওড়িষ্যা হলো এমনই এক রাজ্য যার সাফাই ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে খারাপ। এ রাজ্যে মাত্র ৫৪.৪৮ শতাংশ অঞ্চলে রয়েছে জঞ্জাল সাফাইয়ের ব্যবস্থা। দেওগড় ও ঝারসুগুদা জেলা দুটিকে প্রকাশ্য শৌচকর্মমুক্ত হিসাবে ঘোষণা করলেও এমন কিছু চিত্তাকর্ষক তথ্য উঠে এসেছে, যা দেখিয়ে দিয়েছে কেন প্রত্যেকটা ঘরে শৌচালয় তৈরি করা সত্ত্বেও মানুষ তা ব্যবহার করছেন না।
জামপড়া গ্রামের এক তরুণ সুনীল হাডিয়া জানিয়েছেন, “শৌচালয় ব্যবহার করা আমাদের কাছে বিলাসিতা। গোটা গ্রাম জুড়ে কোথাও জল সরবরাহের টিকি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর, গ্রীষ্মের সময় গ্রামের বাইরে যে একটা মাত্র নলকূপ রয়েছে তাও শুকিয়ে যায়’’। কিন্তু, পানীয় জল ও রান্নাবান্নার জন্য তো কিছু একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার।
তাই, নিকটস্থ পুকুর পাড়ই একমাত্র জায়গা, যেখানে মানুষ প্রাতঃকৃত্য সারে। আর, অব্যবহৃত শৌচালয়গুলোর চারপাশে ঝোপ-ঝাড় গজিয়ে হয়ে গেছে ঘন জঙ্গল। বিদ্যুতের অভাব তাঁদের যন্ত্রণাকে বাড়িয়েছে আরও বহুগুণ। গ্রামবাসীরা এটাও জানালেন, শুধু জলের অভাবই নয়, শৌচালয়গুলো তৈরি করা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিতে।
তীব্র জলসংকটে জর্জরিত ওড়িষ্যার ওইসব গ্রামবাসীরা চালু করেছেন “বিনিময় প্রথা’’র এক রেওয়াজ, যার মাধ্যমে তাঁরা সংগ্রহ করেন জল — তাঁদের কাছে যা কিনা অতি বিষমবস্তু, যা তাদের ঘরের উদ্বৃত্ত হয়ে যাওয়া কোনো কোনো জিনিসপত্রের মাধ্যমে লেনদেন করে। উপকূলবর্তী রাজ্যের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে মারাত্মক জল সংকটে জর্জরিত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রত্যেক দিনের রোজনামচা। পুরি জেলার আস্তারঙ্গ ও কাকাটপুর ব্লকের পাঁচটি উপকূলবর্তী গ্রামে কয়েক বছরের মধ্যেই জলসংকট তীব্র আকার ধারণ করে। জলের অধিকাংশ উৎস গুলোই হয় নোনতা বা দূষিত। তাই, এইসব জায়গায় ঘটেছে জলবাহিত রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব।
“সরকার ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে কেবলমাত্র মে-জুন মাসে পানীয় জল পাঠানোর ব্যবস্থা করে ওই গ্রামগুলোর জন্য। আর তারপরের মাসগুলোতে গ্রামবাসীরা জলের অন্যান্য উৎসের উপর নির্ভর করে দিন কাটায়। জলের বেশির ভাগ উৎসগুলোই হচ্ছে আশপাশের পুকুর বা কুয়ো — যা একেবারেই নোনতা। পানীয় জল হিসাবে যা ব্যবহার করা যায় না।’’ এই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন তান্ডাহারের ২৭ বছরের যুবক সন্তোষ পড়ই।
পরিহাস এটাই, গ্রামের ৭২টি ঘরের চারপাশে রয়েছে দুটো নদী ও সমুদ্র। কিন্তু, জলের সমস্ত উৎসগুলোই নোনা জলে ভরা। গ্রামবাসীরা তাই হন্যে হয়ে প্রখর রোদে পানীয় জলের সন্ধানে এদিক-ওদিক ছোটা ছুটি করতে বাধ্য হন।
পুরী জেলার নদিয়ামাথা গ্রামের ১০০টা ঘরে সেই তীব্র জলসংকট। সরকার দয়াপরবশ হয়ে বিনে পয়সায় পরিবার পিছু প্রতিদিন ২০ লিটার করে জল দেয়। এই পরিমাণ জলে পরিবারগুলোর সব প্রয়োজন মিটছে না। তীব্র জলসংকটের এই প্রাত্যহিকতা নিয়েই কেটে চলেছে তাঁদের দিবারাত্রির কাব্য।