ভীড়-হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যখন ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগে পড়তে হয়

তবরেজ আনসারি, ঝাড়খণ্ডের সেই তরুণ শ্রমিকটির কথা মনে আছে? পেটের তাগিদে যে পুণেতে ছিল এবং বাড়ি ফিরে যে বিয়ে করেছিল, ঠিক সেই সময়ে যখন নরেন্দ্র মোদী প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরছেন? তার বিয়েটা অবশ্য খবর’ হওয়ার মত কোন ঘটনা ছিলো না। কিন্তু বিয়ের মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই, সে হয়ে গেল একটা পরিবারে শুধুই একটা ‘নাম’! ঠিক দাদরির মহম্মদ আখলাক, মেওয়াতের পেহলু খান আর রামগড়ের আলিমুদ্দিন আনসারির মতো! তবরেজকে একটা ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে টানা কয়েক ঘন্টা ধরে মারা হয়েছিল এবং “জয় শ্রীরাম”, “জয় হনুমান” বলানোর জন্য জোর করা হয়েছিল। পুরো ঘটনাটা গোটা পৃথিবীকে দেখানোর জন্য নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ভিডিও করা হয়েছিল এবং আপলোড করা হয়েছিল। মুমূর্ষু তবরেজকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি। তাকে বাইক চুরির অভিযোগে স্থানীয় থানায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল। হাসপাতালে আনা হয়েছিল আরও কয়েক ঘন্টা পরে, শুধু ডাক্তারদের দিয়ে তাকে ‘মৃত’ ঘোষণা করানোর জন্য!

তবরেজকে আরেকবার হত্যা করা হল যখন ঝাড়খণ্ডের পুলিশ, গণপ্রহারের দৃশ্যে যে কুশীলবদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছিল সেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ খারিজ করে দিল। পুলিশের বক্তব্য, তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে মেডিকেল রিপোর্টে ‘হৃদরোগের’ কথা বলা হয়েছে, প্রহারজনিত আঘাত নয়। তাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা উচিত নয়। তাই তাদের বিরুদ্ধে ‘অনিচ্ছাকৃত খুনের ’অভিযোগ। এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। তবরেজ আনসারির স্ত্রী শায়িস্তা পারভীন ঘোষণা করেন, যতক্ষণ না পুলিশ ‘হত্যা’র অভিযোগ ফিরিয়ে আনছে, তিনি আমরণ অনশন চালিয়ে যাবেন।

তবরেজের ন্যায় বিচারের লড়াই সবে শুরু হয়েছে। ভীড়হিংসার আগেকার বেশ কয়েকটি ঘটনায় দলে দলে ‘বেকসুর খালাস বা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি’ এবং অভিযুক্তদের সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের হিড়িক আমাদের দেখা আছে। এ ক্ষেত্রেও এখনও দেখার বাকি আছে।

ভীড়-হিংসার শিকার যারা, তাদের ন্যায় বিচারের সত্যিকারের চ্যালেঞ্জটা নিহিত আছে বর্তমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, যেখানে সঙ্ঘী-বিজেপির সাজানো একগুচ্ছ মিথ্যা অজুহাতের (লাভ জিহাদ, গো হত্যা থেকে শুরু করে সব চেয়ে বেশি আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া দুটি অজুহাত – দেশদ্রোহিতা এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ) ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে নিশানা করে ভীড় হিংসায় জনতাকে প্ররোচিত ও সমাবেশিত করা হচ্ছে। আর অভিযুক্তদের মাথায়, আগলে রাখা এবং শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপরিকল্পিত আশ্বাসের আশীর্বাদী হাতটি রাখা হচ্ছে। এখন নতুন একটি উপাদান যুক্ত হল – গণপ্রহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠকে রাজনৈতিক নিগ্রহ করা, শাসানো এবং মিথ্যা অপবাদে কলঙ্কিত করার নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রচেষ্টা।

সম্প্রতি এটা আমরা দেখলাম, যখন ৪৯জন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ভীড়হিংসার ক্রমবর্ধমান ঘটনার বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদীকে খোলা চিঠি দেওয়ার পরই আক্রমণের নিশানা হলেন এবং যখন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ‘জয় শ্রীরাম’কে রণহুঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে মুখ খোলায় তাঁকে অর্থনীতির মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখার পরামার্শ দেওয়া হল। এই নিশানা করার ব্যাপারটা আরও তীব্রতর হল যখন খোলা চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু করার জন্য মুজফ্ফরপুরের সিজেএম নির্দেশ দিলেন এবং আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাদিবসের ভাষণে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত নির্লজ্জ দাম্ভিকতায় এক বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে সেই শয়তানি তৎপরতায় সামিল হয়ে গেলেন।

মোহন ভাগবতের মতে, ’লিঞ্চিং’ (ভীড়-হিংসা) একটি ‘পশ্চিমী ধারণা’ এবং ভারতের বাইরে উদ্ভূত ধর্মের দ্বারা প্রণোদিত ও অনুশীলিত। শুধু তাই নয়, ‘লিঞ্চিং’ সম্পর্কিত যে কোনো কথা ভারতবিরোধী, হিন্দু-বিরোধী অপমানকর কথা। এই ভাগবত মোদীকেই আরও প্রগাঢ়ভাবে তুলে ধরলেন – স্মরণ করুন কীভাবে মোদী ২০০২সালে তার নজরদারিতে ঘটে যাওয়া গুজরাট গণহত্যার প্রত্যেকটি বিরোধিতাকে ‘গুজরাটের গৌরবের’ উপর আক্রমণ বলে চিত্রিত করেছিলেন এবং আরও সাম্প্রতিক কালে কীভাবে তিনি ঝাড়খণ্ডে ক্রমাগত বেড়ে চলা ভীড়-হিংসার বিরুদ্ধে সাধারণ্যে ক্রমবদ্ধর্মান সমালোচনাকে ‘ঝাড়খণ্ডী সত্তা’কে ‘অপমান’ বলে তকমা দিয়ে দিলেন! ‘লিঞ্চিং’-এর ধারণা ও প্রয়োগকে খৃস্ট ও ইসলাম (ধর্মের) সঙ্গে (যে দুটি বড় ধর্ম বাইরে থেকে ভারতবর্ষে এসেছে এবং ভাগবতের মতে ইসলাম ভারতকে আক্রমণ করেছিল) জুড়ে দিয়ে মোহন ভাগবত, সামাজিক সাংস্কৃতিক-ইতিহাস এবং দার্শনিক ঐতিহ্যের নিরিখে অন্যান্য ধর্মকে খাটো ও নিকৃষ্ট করে দেখিয়ে হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারে ইন্ধন যোগালেন।

মোদী সরকারের গণতন্ত্রের উপর, বিশেষ করে কাশ্মীরের প্রেক্ষিতে, উপর্যুপরি আঘাত হেনে চলার বিরুদ্ধে ক্রমশ বেড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনা সম্পর্কে সজাগ ভাগবত গণতন্ত্রকে একটি ‘প্রাচীন ভারতীয় ব্যবস্থা’ হিসাবে উদ্ধৃত করেছেন। শুধুমাত্র তাই নয়, ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা’ এই সুবিদিত সূত্রায়ন যা ভারতের মিশ্র সংস্কৃতিকে তুলে ধরে এবং যা বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদকে ভারতের বুনিয়াদি বৈশিষ্ট্য হিসেবে মান্যতা দেয়, সেটিকে নস্যাৎ করে তার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে স্বকল্পিত এক শব্দবন্ধ ‘একতার মধ্যে বৈচিত্র্য’ হাজির করেছেন। এখানে ‘বৈচিত্র্য’ বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘একতার’ মধ্যে উপর উপর কিছু বিভিন্নতা, যদিও পরবর্তীটি সমন্বয়সাধন ও একরূপতার প্রেক্ষিতে আপক্ষিক অবস্থানে সীমায়িত। অর্থনীতির ব্যাপারে উদ্বেগকে ‘হতাশাবাদ’ বলে খারিজ করা হয়েছে এবং মন্থরতার জন্য বিশ্ব অর্থনীতির প্রবণতার দোহাই দেওয়া হয়েছে।

এই প্রথম আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন কর্পোরেট দুনিয়ার কেউ – হিন্দুস্তান কম্পিউটার লিমিটেড-এর থেকে ধনকুবের শিল্পপতি শিব নাদার। তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন – মোদী সরকারের ‘ন্যূনতম সরকার’ নীতির প্রশস্তি গাইবার জন্য, যা আসলে ‘সর্বোচ্চ বেসরকারিকরণ’কেই ঘুরিয়ে মোলায়েম করে বলা! নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দপ্তর পরিদর্শন এখন ভারতীয় কর্পোরেটদের পরিচিত মুখগুলোর কাছে একটি প্রিয় তীর্থযাত্রা হয়ে উঠছে – আদানি আম্বানি যদি মোদী সরকারের সবচেয়ে বেশি আনুকূল্য ভোগ করে থাকেন তো রতন টাটা, রাহুল বাজাজের মতো সাবেক কর্পোরেট ধনিকশ্রেষ্ঠ পুঁজিপতিদের কাছে নাগপুরের ক্ষমতা কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ক্রমশ সুখকর হয়ে উঠছে। হিউস্টনে মোদীর “সব ঠিক হ্যায়”-এর নাটকীয়তা থেকে ভাগবতের নাগপুর ভাষণ – সবেতেই, ক্রমশ আরও বেশি সংখ্যক ভারতীয়ের মনে, মোদী-অমিত শাহর শাসনে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আবহাওয়া নিয়ে জমতে থাকা উদ্বেগকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে ।

লক্ষ লক্ষ ভারতীয় যখন বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদটুকুর জন্য, মৌলিক মানবিক মর্যাদার ও অধিকারের জন্য মরিয়া লড়াই লড়ছেন, সঙ্ঘ বিজেপি পরিবার তখন ভারতের উজ্জ্বল ছবি আঁকতে ব্যস্ত! ভারতীয় অর্থনীতির চরম সংকট হোক, কাশ্মীর উপত্যকায় গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা এবং কাশ্মীরী জনতাকে দমিত ও অবরুদ্ধ করে রাখা হোক অথবা পাটনার মতো শহরে টানা কয়েক ঘণ্টার অবিরাম বর্ষণে প্রায়-বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক, ভারতের বাস্তব অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ ও বিস্ফোরক যা অমিত মোদী ভাগবতের শূন্যগর্ভ, প্রতারণা মলূক, বিভ্রান্তিকর বাগাড়ম্বরে কখনোই ধরা পড়ে না। প্রতিটি দিন সঙ্ঘ-বিজেপি পরিবার ভারতকে ক্রমশ এক চরম এবং সর্বাত্মক বিপর্যয়ের গভীর থেকে গভীরে ঠেলে দিচ্ছে। ভারতকে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং সর্বশক্তি দিয়ে এই বিপর্যয়কে অতিক্রম করতে হবে।

(এম এল আপডেট খণ্ড ২২ সংখ্যা ৪১, ৮-১৪ অক্টোবরে ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-32