জিয়াগঞ্জের ঘটনা : সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা

জিয়াগঞ্জ নিয়ে (বিজেপি) উঠেপড়ে লেগেছিল। যাই হোক করে ঘটনাটি থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেই হবে। মেরুকরনের রাজনীতিই এদের ভোট কৌশল। ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিকে হিন্দুমুসলমানে ভাগ করা ওদের একমাত্র লক্ষ্য। জিয়াগঞ্জের তিনটি খুন তাই তিনটি রাজনৈতিক লাশ। ঠিক এই কারণেই একবার বলল “বন্ধুপ্রকাশ প্রতিমা শিল্পী তাই হত্যা”, একবার এল “অবৈধ মসজিদ নির্মানে বাধা দিয়েছিল তার জন্য হত্যা”, শেষে বলল উনি নাকি “সাচ্চা আরএসএস কর্মী” তাই “জেহাদিরা” হত্যা করেছে। কিন্তু কোনো প্রোপাগান্ডাই ধোপে টিকল না। হাজার চেষ্টা করেও সলিড কমিউনাল ন্যারেটিভ দাঁড় করানো গেল না। বন্ধুপ্রকাশ পালের পরিবার এসে সব সংঘী- প্ল্যান ভেস্তে দিল। বেচারি! মোল্লা গুলোকে পিষে দেওয়ার একটা বিরাট সুযোগ এসেছিল। হাত ফসকে বেরিয়ে গেল। এত খাটাখাটনি করেও মোল্লা সংযোগ স্থাপিত করা গেল না। হায় রে সংঘী!

তদন্তে ধরা পড়ল বছর কুড়ির উৎপল বেহেরা। পেশায় রাজমিস্ত্রী। লেনদেন, ব্যক্তিগত আক্রোশ, প্রতিশোধ। কেন কি কারণ, বিস্তারিত আপনারা জানেন। কাগজে পড়েছেন নিশ্চয়। কিন্তু ঘটনার কারণ ও খুনীর নাম বেশ কিছু লেখক লেখিকার পছন্দ হয়নি। কারণ যে কারণগুলি তাঁরা ভালোবেসে বিশ্বাস করেছিলেন সেগুলি একটিও লাগল না। ঘটনাচক্রে একই ব্যক্তিগত কারণে “উৎপলের” জায়গায় নামটা কেবল “আনারুল” হয়ে গেলে পুরো মুসলিম সম্প্রদায়কে দূর্ভোগ পোহাতে হত। আনারুলের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নিতে হত গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে। কিন্তু উৎপলের অপরাধের দায় উৎপলেরই, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে দায় নিতে হয় না। দৃষ্টিভঙ্গির এই তফাৎটি যথেষ্ট ভয়ের। আরএসএস বিজেপির রাজত্বে আগামী দিনগুলোতে এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিটি আরও বেশি করে জায়গা করে নেবে। যে কোনো কারণেই হোক না কেন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ খুন হলেই বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তাকে হাইজ্যাক করবে। বিদ্বেষ ছড়াবে। সংখ্যালঘু মুসলিমদের মনে এমন আসন্ন বিপদের ভয়টি আরও বেশি মারাত্মক। জিয়াগঞ্জ এমনই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কোপ থেকে বাঁচল। কোনো দায় না থাকা সত্ত্বেও এক অজানা আতঙ্ক মুসলিম জনমানসকে গ্রাস করে রেখে ছিল দিন কয়েক। ভবিষ্যত কি হবে জানা নেই। তবে আপাতত কিছুটা ভয় থেকে মুক্তি। কোনো মোল্লার নাম নেই। ঘটনাটিতে ঢোক গিলতে হবে সেটা আগেই বুঝেতে পেরেছে আরএসএস। পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য ন্যারেটিভ তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। ড্যামেজ কন্ট্রোল।

যুগশঙ্খের মতো আরএসএস-বিজেপির পয়সায় চলা আগাছা পত্রিকাগুলো রীতিমতো দায়িত্ব নিয়ে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। এখনও চালাচ্ছে। প্রতিদিন নিয়ম করে বিষ ঢালছে জনমানসে। এই পত্রিকার সম্পাদককে “সেরা পোষ্য সারমেয়” পুরস্কার দেওয়া যায়। “জিয়াগঞ্জে জেহাদি, ইসলামী স্বর্গরাজ্য” এসব লিখে বেড়াচ্ছিল পত্রিকায়। পেপারকাট শহরের মোড়ে মোড়ে দেওয়ালে চেটানো হচ্ছে। সেইসঙ্গে সোশাল মিডিয়ায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ঘৃনা ছড়ানোর জন্য নিযুক্ত আছে বিজেপির আইটি সেলের ভাইটিরা। আর রইল এইসব পত্রিকার পাঠক এবং নাস্তিক সেজে থাকা ছুপা চাড্ডীসকল। এ গুলোর প্রোফাইল ঘুরে এসে আঁচ পেয়েছিলাম মাঠ তৈরি হয়ে গেছে। “বন্ধুপ্রকাশের পরিবারকে ভয় দেখিয়ে বলিয়ে নেওয়া হয়েছে”, “জেহাদিদের আড়াল করা হচ্ছে”, “সংখ্যালঘু তোষণ চলছে”, “ পারিবারিক বিবাদের কথা তুলে ধরে জেহাদিদের আড়াল করা হচ্ছে” ইত্যাদি প্রভৃতি আসতে চলেছে আজকালের মধ্যেই। ড্যামেজ কন্ট্রোল।

সম্প্রীতির উপর, ধর্মনিরপেক্ষতার উপর এদের আবার খুব রাগ। ভারতের যে সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত তার উপর খুব আক্রোশ। “কোথায় গেল সম্প্রীতি”, “কোথায় গেল সেকুলারিজম”, “কোথায় গেল প্রতিবাদ” এসব প্রশ্নবানে ফেবুর দেওয়াল ভরিয়ে দিচ্ছিল। হোয়াট্যাবুটারি দিয়ে সেকুলারদের উপর প্রতিবাদের দায় চাপাচ্ছিল। এরা নিজেরা সেফ জোনে থাকে। রাস্তায় নামার নাম নেই। অথচ কে ফেসবুকে প্রতিবাদ করছে কে করছে না এসব দেখে বেড়াচ্ছিল সংঘী চোখ দিয়ে। আরএসএস-এর প্রপাগান্ডায় এদের অগাধ আস্থা, অগাধ বিশ্বাস। কোনো এক আইটি সেলের ভাইটির কাছ থেকে শুনে নিয়েছে “অবৈধ মসজিদ নির্মানে বাধা দেওয়ায় বন্ধুপ্রকাশবাবুকে খুন করা হয়েছে”, ব্যাস! চোখ বুজে বিশ্বাস করে নিয়েছে। বিদ্বেষের আঁশটে গন্ধ ভরা ন্যারেটিভ নামিয়ে দিয়েছে ফেবুর দেওয়ালে।

ঘটনা হচ্ছে, এরা এসব ন্যারেটিভে বিশ্বাস রাখতে ভালোবাসে। ভুল ধরিয়ে দিলেও নিজের জায়গা থেকে নড়ে না। তাই অযাচিতভাবে “সম্প্রীতি”, “ধর্মনিরপেক্ষতা” এসব টেনে আনে। ত্রিকোণ প্রেমের জেরে বিকাশ ভৌমিক খুন হলেও এরা ফেসবুকে হাঁক দেবে “আজ সেকুলাররা কোথায়?”। অদ্ভুত! ফেবুতে এরা এসব অবাঞ্ছিত অপ্রাসঙ্গিক ষ্টেটাস নামিয়ে সঙ্ঘীদের ফেক প্রোপাগান্ডাকে পুষ্ট করে। উত্তরাধিকার সুত্রে এরা দুটি অভ্যাস অর্জন করেছে। এক, সর্বদা বিচারকের আসনে বসে যাওয়া এবং দুই, বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণাবিদ্বেষ পুষে রাখা। এরা বিশেষ ঘটনা ঘটার জন্য ওতপেতে থাকে যাতে ফেবুর দেওয়ালে ঘৃণাবিদ্বেষ উগরে দেওয়ার সুযোগ পায়। আর যারা এই প্রবণতার প্রতিবাদ করে তাদের জেহাদি মাকু সেকু তিনু গোঁড়া এসব তকমা দিয়ে একঘরে করতে চাই।

আচ্ছা, বলুন তো, কোনো খুন যদি পারিবারিক বিবাদ বা ব্যবসায়িক লেনদেন বা ধারদেনার কারণে হয় তাহলে প্রতিবাদের দায় কি সেকুলারদের উপর পড়ে? কিন্তু এরা টেনেহিঁচড়ে ঘটনাটির সঙ্গে “সম্প্রীতি” “ধর্মনিরপেক্ষতা” এসব জুড়ে দিচ্ছিল সচেতনভাবে। বেমানানভাবে। ঘটনাটি রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কারণে নয় এটা এতদিনে সবাই জেনে গেছে। তেমন হলে সেকুলারদের উপর প্রতিবাদের দায় অবশ্যই থাকত। কিন্তু তা তো নয়। জিয়াগঞ্জের খুনের ঘটনাটি ব্যবসাসংক্রান্ত লেনদেনের জের। নৃশংস ঘটনা। বিবেকবান যে কোনো মানুষই শিউরে উঠবেন ঘটনাটির নৃশংসতায়। আশা করি যে খুনী একই পারিবারের তিনজনকে খুন করেছে সে উপযুক্ত শাস্তি পাবে দ্রুত।

খুনের যে কারণটি আরএসএস ও বিজেপি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিল সেটা ছিল ফেক রাজনৈতিক প্রোপাগাণ্ডা। মানুষ বুঝেছে। শুভ লক্ষণ। ভবিষ্যতেও এমন খুনের ঘটনা ঘটতে পারে। খুনের কারণ যাই হোক আরএসএস বিজেপি চাইবে সাম্প্রদায়িক রং ঢেলে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে। এমন অশুভ শক্তি প্রতিরোধের জন্য বাংলার সমস্ত শুভবুদ্ধিকে একজোট থাকতে হবে। এমন নৃশংস ঘটনা ঘটলে মানুষ প্রতিবাদ করবে শুভবুদ্ধির জায়গা থেকে। মানবিকতার খাতিরে। সেকুলারিত্বের দায় থেকে নয়। যে কোনো ঘটনাতেই সেকুলারদের উপর দায় চাপানোর অর্থই হল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পথ প্রশস্থ করা। যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল ভারতীয় হিসাবে গর্বের সেটাকে লজ্জায় পর্যবসিত করা হচ্ছে। জনমানসকে এমনভাবে সঞ্চালিত করা হচ্ছে যাতে ব্যক্তিবিশেষ নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলতে লজ্জা বোধ করেন। লজ্জা এড়িয়ে বললেও ব্যঙ্গের শিকার হন। এটা একটা ঘৃণ্য মেরুকরণ কৌশল। এই কৌশলকে ধোঁয়া দিলে সমূহ বিপদ।

সম্রাট আমীন (গুরুচণ্ডালী ওয়েবসাইট থেকে গৃহীত)

খণ্ড-26
সংখ্যা-33